দেশের অর্থনীতির জন্য আগামী ৩ মাস ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’

ইলাসট্রেশন: বিপ্লব চক্রবর্তী

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল করতে সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তার বাস্তবায়ন ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। ফলে দেশের অর্থনীতির জন্য আগামী ৩ মাস অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

শুরুতেই আমদানির কথা ধরা যাক। আমদানি বিল বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা ঠেকাতে গত মে'তে সরবার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সেই উদ্যোগ থেকে সুফল আসতে শুরু করেছে।

গত ১ জুলাই থেকে ১৬ নভেম্বরের মধ্যে ২৫ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ঋণপত্র খোলা হয়েছে। যা আগের বছরের চেয়ে ২১ দশমিক ৭ শতাংশ কম।

গতকাল বৃহস্পতিবার অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ আয়োজিত এক সেমিনারে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, 'আমি আশ্বস্ত করতে পারি যে, জানুয়ারির মধ্যে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার আর কোনো সংকট থাকবে না।'

তিনি আরও বলেন, 'আমদানি আগে ৮ দশমিক ৪ থেকে ৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে থাকলেও এখন তা ৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। আমাদের আমদানি এখন রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের চেয়ে কম। ডিসেম্বরের মধ্যে এ অস্থিরতা কেটে যাবে।'

একইভাবে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাতে উদ্বুদ্ধ করতেও সম্প্রতি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আগামী ৩ মাস ব্যাংকগুলোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে চলমান চাপ এই সময়ের মধ্যে অব্যাহত থাকতে পারে।'

এলসি খোলার ক্ষেত্রে চলমান বর্তমান সংকট কেটে গেলে আগামী জানুয়ারির পর থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

তবে, এ বিষয়ে পুরোপুরি আশাবাদী নন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তার মতে, ডলারের প্রবাহ ও খরচের প্রবণতা দেখে ধারণা করা যাচ্ছে, আগামী মার্চের আগে কোনো ইতিবাচক খবর পাওয়া যাবে না।

এলসি নিষ্পত্তির তথ্য বলছে, অক্টোবরে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স দুটোই টানা দ্বিতীয় মাসের মতো কমলেও, গত বছরের তুলনায় আমদানি বেড়েছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'মার্চের পর রপ্তানি আয় বাড়তে পারে। কারণ পশ্চিমা বিশ্বের চলমান মন্দা কমতে পারে। তবে, রেমিট্যান্স সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার সুযোগ খুব কম। কারণ বিদেশে অর্থপাচারের সম্ভাবনাও আছে।'

'আগামী মাসগুলোতেও অর্থপাচার অব্যাহত থাকতে পারে। কারণ অর্থনীতি ও রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রেই অনিশ্চয়তা থাকবে', বলেন তিনি।

সম্প্রতি রেকর্ডসংখ্যক বাংলাদেশি কর্মী বিদেশে গেলেও দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে রেমিট্যান্স গত বছরের চেয়ে ২ দশমিক ০৩ শতাংশ কমে ৭ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

সম্প্রতি হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন বাড়ায় রেমিট্যান্স প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) এক কর্মকর্তা।

যারা হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন করছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে রেমিট্যান্স প্রবাহ কিছুটা বাড়তে পারে বলেও জানান আহসান এইচ মনসুর।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হানের মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির গতি অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

তিনি বলেন, 'ব্যবসায়ীরা কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। এতে বেকারত্ব তৈরি হতে পারে ও অনেকে চাকরি হারাতে পারেন।'

'গত ১১ মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রতি মাসে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার করে কমেছে,' বলেন সেলিম রায়হান।

সানেমের আয়োজিত 'বাংলাদেশ অর্থনীতি: উদ্বেগ ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ' শীর্ষক এক ওয়েবিনারে তিনি এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে রিজার্ভ আরও ৪ বিলিয়ন ডলার কমে গেলে আমদানি আরও কমে আসবে।

'আমাদের বর্তমান সংকট বহুমুখী। একদিকে ঠিক করতে গিয়ে অন্য দিকে নতুন সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এ কারণেই চলমান চাপ মোকাবিলার জন্য সামগ্রিক সমন্বয় প্রয়োজন,' যোগ করেন তিনি।

আগামী দিনে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স না বাড়লে কয়েক বছর পর বিদেশি ঋণ পরিশোধের জন্য অর্থনীতির ওপর বাড়তি চাপ পড়বে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক রায়হান।

মধ্যমেয়াদী ঋণ কৌশলের অংশ হিসেবে মে-জুন মাসে ইআরডির একটি প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের বিপরীতে ২ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। 

গত অর্থবছরে পরিশোধ করতে হয়েছিল ২ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার।

ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবে এবং ২০২৯-৩০ অর্থবছরে প্রায় ৫ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে।

এ অবস্থায় বর্তমান সংকট যেন বছরের পর বছর দারিদ্র্য বিমোচনের অগ্রগতিকে ব্যর্থ করে না দেয়, তা নিশ্চিতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে স্বল্প মেয়াদে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির আওতায় আনার আহ্বান সেলিম রায়হান।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'আমাদের মুদ্রাস্ফীতির বিষয়টিও মোকাবিলা করা উচিত। কারণ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।'

চলতি অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল গড়ে ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে নির্ধারিত ৫ দশমিক ৬ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি।

তবে আহসান মনসুর বলছেন, 'বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে চলমান চাপের সমাধান হলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।'

বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে চলমান অস্থিরতা কাটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় প্রতিদিন বড় অংকের ডলার বাজারে ছাড়ছে, যেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের আমদানি বিল মেটাতে পারে।

এ পর্যন্ত বাজারে ৫ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার সরবরাহ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ১-১৬ নভেম্বরের মধ্যে ৮৩৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়া হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাজারে নিয়মিতভাবে ডলার ছাড়ায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রিজার্ভ কমে ৩৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা এক বছর আগের তুলনায় ২৩ দশমিক ৮ শতাংশ কম।

তবে আইএমএফ আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানের সংজ্ঞা অনুসরণ করে জানিয়েছে, বাংলাদেশের নেট রিজার্ভের পরিমাণ বর্তমানে প্রায় ২৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার।

Comments

The Daily Star  | English

Tanvir takes five as Tigers clinch 2nd Sri Lanka ODI

Bangladesh captain Mehidy Hasan Miraz has won the toss and opted to bat first in the second ODI against Sri Lanka, looking to keep the three-match series alive with a win at the R Premadasa Stadium today. 

14h ago