রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকল বন্ধ করে খরচ কমানো নীতিতেও বাড়ছে লোকসান

চিনিকলে আখ পরিবহনের জন্য থাকা ট্রাক্টর-ট্রলি পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ছবি: স্টার

ক্রমাগত লোকসানের বোঝা কমাতে ২০২০ সালে রাষ্ট্রয়াত্ত ১৫টি চিনিকলের মধ্যে ৬টির উৎপাদন বন্ধ করার নির্দেশ দেয় সরকার। এতে উৎপাদনের লোকসান কমলেও গত ২ বছর ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকায় মিলগুলোর যন্ত্রাংশ ও বিভিন্ন সরঞ্জাম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একইসঙ্গে বন্ধ মিলগুলোর রক্ষণাবেক্ষণেও প্রতি বছর গুণতে হচ্ছে কয়েক কোটি টাকা।

এ ছাড়া, চিনিকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওইসব মিল এলাকায় আখের উৎপাদনও প্রায় শূন্যতে নেমে এসেছে। ফলে চিনি জাতীয় পণ্যের উৎপাদনও কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া এসব মিলে অবিলম্বে উৎপাদন শুরু করতে না পারলে ভবিষ্যতে বড় লোকসানের আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

২০২০ সালের ডিসেম্বরে আখ মাড়াই শুরু হওয়ার আগে শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক পরিপত্রে দেশের ৬টি রাষ্ট্রয়াত্ত চিনিকলের উৎপাদন বন্ধ ঘোষণা করা হয়। মিলগুলো হচ্ছে— পাবনা চিনিকল, কুষ্টিয়া চিনিকল, রংপুর চিনিকল, পঞ্চগড় চিনিকল, শ্যামপুর চিনিকল ও সেতাবগঞ্জ চিনিকল।

সম্প্রতি সরেজমিনে পাবনা চিনিকল ঘুরে দেখা গেছে, ২০২০ সাল থেকে উৎপাদন বন্ধ থাকায় ৪৫ একর জায়গার ওপর স্থাপিত এ চিনিকলের বিশাল এলাকা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে গাছ ও আগাছায় ভরে গেছে। প্রায় ৫ শতাধিক কর্মীর কর্মস্থল বিশাল এ মিল এলাকা এখন অনেকটা জঙ্গলে পরিণত হয়েছে।

পাবনা চিনিকলে আখ পরিবহনের জন্য যেসব ট্রাক্টর ও ট্রলি ব্যবহার করা হতো, সেগুলো খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অকেজো হয়ে পড়ছে পাবনা চিনিকলের আখ পরিবহনের ২০টি ট্রাক্টর ও ১২২টি ট্রলি। দীর্ঘদিন পরে থাকলে এসব মূল্যবান যানবাহনের অনেকগুলোই ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

পাবনা চিনিকলের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আক্তারুজ্জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অব্যবহৃত হয়ে পড়ে থাকা বিপুল সংখ্যক যানবাহন পুরোপুরি অকেজো হয়ে পড়ার আগেই দেশের অন্যান্য রাষ্ট্রয়াত্ত চিনিকলে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে চালু মিলগুলোতে এ বিষয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।'

অব্যবহৃত হয়ে পড়ে থাকায় মিলের মূল্যবান যন্ত্রাংশগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অকেজো হয়ে পড়ছে বলে জানান তিনি।

'ইতোমধ্যে মিল থেকে অনেক যন্ত্রাংশ খুলে অন্য মিলে কাজে লাগানো হয়েছে। ফলে মিলটি এখন চালু করা সম্ভব নয়। মিলটি পুনরায় চালু করতে হলে মেরামতের জন্য অন্তত ১ বছর সময় লাগবে। পাশাপাশি অনেক যন্ত্রাংশ নতুন করে সংযোজন করতে হবে। এতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হবে', বলেন তিনি।

মিল সূত্র জানায়, যখন মিলটি বন্ধ করা হয়, তখন সেখানে প্রায় ৫৮৯ জন কর্মী ছিলেন, যাদের মধ্যে স্থায়ী নিয়োগ পাওয়া বেশিরভাগ কর্মীরই অন্যান্য মিলে পদায়ন হয়েছে। তবে, মিলটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বর্তমানে ৩০ জন নিরাপত্তাকর্মী এবং ৩১ জন অফিস কর্মকর্তা রয়েছে।

মো. আক্তারুজ্জামান জানান, মিলের বর্তমান কর্মীদের বেতন-ভাতা এবং বিদ্যুৎ বিলসহ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি বছর প্রায় ৬ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে।

প্রায় ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৯৯২ সালে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার দাশুরিয়াতে পাবনা চিনিকল প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রাথমিকভাবে বছরে দেড় টন আখ থেকে ১৫ হাজার টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। তবে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে কখনো লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে বা লাভের মুখ দেখতে পারেনি মিলটি।

প্রায় ৪০০ কোটি টাকা লোকসানের বোঝা নিয়েই মিলের উৎপাদন বন্ধ করা হয়। কিন্তু, বন্ধের পরেও আরও লোকসান গুণতে হচ্ছে পাবনা চিনিকলকে। একই অবস্থা উৎপাদন বন্ধ হওয়া বাকি চিনিকলগুলোরও।

পাবনা চিনিকল। ছবি: স্টার

মিল বন্ধ হওয়ায় আখ উৎপাদনও বন্ধ

পাবনা চিনিকল সূত্রে জানা গেছে, পাবনা চিনিকলের অন্তর্গত ১০টি আখ উৎপাদন জোন রয়েছে। ২০২০ সালে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময় মিল জোনের প্রায় ৬ হাজার হেক্টর জমিতে আখের আবাদ করা হয়। সে বছর কৃষকরা অনেক ঘোরাঘুরি করেও পাবনার নিকটবর্তী নাটোরের গোপালপুরে অবস্থিত নর্থ বেঙ্গল চিনিকলে উৎপাদিত আখ সরবরাহ করে লোকসান গুনেছে। এরপর থেকেই আখ উৎপাদনে আগ্রহ হারায় তারা। গত বছর কিছু এলাকায় আখের আবাদ হলেও এ বছর চাষিরা আঁখ চাষ পুরোপুরি বন্ধ রেখেছে।

মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, 'এ বছর মিল জোনের মাত্র ৪০ থেকে ৫০ হেক্টর জমিতে কৃষকরা আখের আবাদ করেছেন গুড় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রির আশায়। চিনিকল বন্ধ থাকায় আখের বাজার সংকুচিত হয়ে পড়ায় কৃষকরা আখ আবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সবজি ও অন্যান্য ফসল আবাদে মনোনিবেশ করেছে।'

পাবনা সুগার মিলের আখ চাষি সমিতির সভাপতি শাজাহান আলী বাদশা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কৃষকরা উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে না পারলে তো আর তা উৎপাদন করবে না। চিনিকল বন্ধ থাকায় আখ চাষ করে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করতে পারবে না। তাই তারা আখ চাষ করছে না।'

মিল জোনের অন্যতম প্রধান আখ চাষি শাজাহান আলী বাদশা। প্রতি বছর তিনি ৬০ থেকে ৭০ বিঘা জমিতে আখের আবাদ করেন। কিন্তু, এ বছর মাত্র ৫ বিঘা জমিতে আবাদ করেছেন।

ডেইলি স্টারকে তিনি আরও বলেন, 'আখ চাষের সবচেয়ে বড় সমস্যা বিজ সংগ্রহ। মিল চালু থাকলে সেখান থেকে কৃষকদের মাঝে বিজ সরবরাহ করা হয়। কিন্তু, গত ২ বছর মিল থেকে বিজ ও সার না পাওয়ায় আখ চাষে কেউ আগ্রহ দেখায়নি। কৃষকদের বেশিরভাগই এখন আখের জমিতে সবজি আবাদ করছে। ফলে ১ বছরে ৩টি ফসল উৎপাদন করতে পারছে কৃষকরা। এতে কৃষকদের লাভও বেশি হচ্ছে।'

'আখের আবাদ অন্য ফসলের মতো লাভজনক না হলেও সরকার এর দাম নির্ধারণ করে দেওয়ায় এবং বিজ ও সারের সহায়তা পাওয়ায় তা আবাদে লোকসানের ভয় থাকে না। সেই কারণেই কৃষকরা আখ চাষ করতেন। তবে, মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কৃষকরা অন্য ফসলের আবাদ শুরু করে, যা থেকে লাভও বেশি আসে। ফলে এখন পুনরায় তাদের আখ উৎপাদনে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে', বলেন তিনি।

পাবনা চিনিকলের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, 'আখ একটি অর্থকরী ফসল হলেও এখন রাষ্ট্রয়াত্ত ৬টি চিনিকল বন্ধ থাকায় মিল জোনের আখের উৎপাদন শূন্যতে নেমে এসেছে। পুনরায় মিল চালু হলেও কৃষকদের আখের আবাদে ফিরিয়ে আনা বড় চ্যালেঞ্জ হবে।'

আখ চাষি সমিতির সভাপতি শাজাহান আলি বাদশা বলেন, 'কৃষকদের স্বার্থে ও দেশের অর্থকরী ফসলের উৎপাদন অব্যাহত রাখতে অচিরেই বন্ধ মিলগুলো চালু করে কৃষকদের আবারও আখ আবাদে ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে দীর্ঘ মেয়াদে চিনি জাতীয় পণ্য উৎপাদনে আরও বড় সংকটের মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।'

Comments

The Daily Star  | English

Drug sales growth slows amid high inflation

Sales growth of drugs slowed down in fiscal year 2023-24 ending last June, which could be an effect of high inflationary pressure prevailing in the country over the last two years.

17h ago