লোহিত সাগরে সংঘাত: বাড়ছে আমদানি-রপ্তানি খরচ
লোহিত সাগরে পণ্যবাহী জাহাজে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের হামলার কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ অব গুড হোপ হয়ে জাহাজ চলাচল করায় পণ্য পরিবহনের খরচ বেড়েছে। বাংলাদেশের আমদানি ও রপ্তানিকারকদের ওপর এর প্রভাব পড়ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে প্রায় পাঁচ হাজার ৬০০ কিলোমিটার বাড়তি পথ পাড়ি দিতে হওয়ায় পণ্য পরিবহনে দুই সপ্তাহ বেশি সময় লাগছে। এতে পরিবহন খরচ ৪০ শতাংশেরও বেশি বেড়ে যাচ্ছে।
জাহাজগুলো অতিরিক্ত খরচ হিসেবে প্রতি টিইইউযের (২০ ফুট কনটেইনার) জন্য ৭০০ থেকে দেড় হাজার ডলার পর্যন্ত 'মাশুল আরোপ করার ঘোষণা দিয়েছে'।
এ ধরনের বাড়তি খরচ বাংলাদেশের রপ্তানিতে ব্যাপক ও আমদানিতে তুলনামূলক কম প্রভাব ফেলবে।
জাহাজ পরিবহনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, বাংলাদেশ থেকে মোট রপ্তানির প্রায় ৭০ শতাংশের বেশি যায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূল ও কানাডার বন্দরগুলোয়। যা মূলত লোহিত সাগর দিয়ে যায় এবং দেশের আমদানির আট থেকে ১০ শতাংশ আসে ওই পথ দিয়ে।
রপ্তানিকারকরা এই অতিরিক্ত খরচে সরাসরি প্রভাবিত নাও হতে পারেন। কারণ বিদেশি ক্রেতারা সাধারণত পরিবহন খরচ বহন করেন, তবে আমদানিকারকরা এর কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিদেশিরা অতিরিক্ত খরচ বহন করলেও শেষ পর্যন্ত দেশের রপ্তানিকারকদের ওপরও এর প্রভাব পড়বে।'
তিনি আরও বলেন, 'যেহেতু ক্রেতারা অতিরিক্ত খরচ পরিশোধ করবেন, তাই তারা পরবর্তী অর্ডারের জন্য ছাড় চাইতে পারেন বা দাম কমাতে চাপ দিতে পারেন, যা শেষ পর্যন্ত রপ্তানিকারকদের প্রভাবিত করবে।'
কনটেইনার শিপিংয়ে অন্যতম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান মেডিটেরানিয়ান শিপিং কোম্পানি (এমএসসি) ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপ, স্ক্যান্ডিনেভিয়া, বাল্টিক ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে যাওয়া সব চালানে আগামী ১ জানুয়ারি থেকে প্রতি ২০ ফুট কনটেইনারের জন্য এক হাজার ডলার ও ৪০ ফুট কন্টেইনারের জন্য দেড় হাজার ডলার কন্টিজেন্সি অ্যাডজাস্টমেন্ট চার্জ (সিএসি) আরোপের ঘোষণা দিয়েছে।
এমএসসির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নতুন বুকিংয়ের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত চার্জ প্রযোজ্য হবে।
এপি মোলার-মারস্ক গ্রুপ পূর্ব এশিয়া থেকে উত্তর ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূলের রুটের জন্য প্রতি ৪০ ফুট কন্টেইনারে ৪০০ ডলার ট্রানজিট ডিসট্রাকশন চার্জ (টিডিএস) নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
এই টিডিএস যেসব জাহাজ ইতোমধ্যে সাগর পথে রয়েছে এবং আফ্রিকা ঘুরে যাচ্ছে তাদের জন্য প্রযোজ্য উল্লেখ করে মারস্ক সম্প্রতি জারি করা এক বার্তায় বলেছে, তারা পূর্ব এশিয়া থেকে উত্তর ইউরোপের জন্য প্রতি ৪০ ফুট কন্টেইনারের ওপর এক হাজার ডলারের পিক সিজন সারচার্জ (পিএসএস) ধরবে। এটি আগামী ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে।
ফরাসি প্রতিষ্ঠান সিএমএ সিজিএম আগামী ১ জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশসহ এশিয়ার সব বন্দর থেকে ইউরোপের বন্দরগুলোয় প্রতি টিইইউতে ৫০০ ডলারের পিএসএস আরোপ করেছে।
জাপানি শিপিং প্রতিষ্ঠান ওশান নেটওয়ার্ক এক্সপ্রেস (ওয়ান) ঘোষণা দিয়েছে যে তারা এশিয়া-ইউরোপ বাণিজ্যে সব ধরনের কনটেইনারের জন্য ৫০০ ডলারের জরুরি পিএসএস ধার্য করবে। প্রতিষ্ঠানটি চলতি মাসে জানিয়েছিল যে এটি আগামী জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কার্যকর থাকবে।
হ্যাপাগ-লয়েড ও এইচএমএমও একই ধরনের চার্জ আরোপের ঘোষণা দিয়েছে।
বেশ কয়েকজন শিপিং কর্মকর্তা বলেছেন, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলগামী রপ্তানি ও আমদানি কার্গো লোহিত সাগর দিয়ে চলাচল করায় বাংলাদেশ থেকে আসা-যাওয়ার কার্গোর ক্ষেত্রে এই চার্জ প্রযোজ্য হবে।
তাদের মতে, চলমান সংকটময় পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আরও বাড়তি চার্জ আরোপের ঘোষণা আসতে পারে।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) সহ-সভাপতি খায়রুল আলম সুজান ডেইলি স্টারকে বলেন, দীর্ঘ পথের কারণে জ্বালানি ও পরিচালন খরচ বেড়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত খরচ মেটাতে জাহাজ পরিবহন প্রতিষ্ঠানগুলো এই চার্জ দিয়েছে।
গতকাল লোহিত সাগর দিয়ে পণ্য পরিবহন আবার চালুর বিষয়ে মারস্কের ঘোষণা সম্পর্কে সর্বশেষ অগ্রগতির কথা উল্লেখ করে সুজান আশা করছেন যে শিগগির পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিপিং কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'করোনা মহামারির মতো পরিস্থিতি হয়ত ততটা খারাপ হবে না। তখন বেশিরভাগ বন্দর বন্ধ থাকায় জাহাজে কনটেইনার পরিবহনের ভাড়া ২০ হাজার ডলার পর্যন্ত পৌঁছেছিল।'
Comments