হোম টেক্সটাইল রপ্তানিতে পাকিস্তানের তুলনায় পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ
বাংলাদেশ হোম টেক্সটাইল খাতের হারানো ওয়ার্ক অর্ডার ফিরে পেতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই খাতের বড় একটি অংশ প্রায় দুই বছর আগে পাকিস্তানের কাছে চলে গেছে।
মূলত বাংলাদেশে গ্যাসের দাম দ্বিগুণ হয়ে যাওয়া ও মার্কিন ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপির বড় দরপতনের কারণে এই পরিবর্তন হয়। আর সম্প্রতি বাংলাদেশের শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষ ও কয়েক মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেও ওয়ার্ক অর্ডার কমেছে।
এছাড়া পাকিস্তানের কিছু অভ্যন্তরীণ সুবিধাও আছে। যেমন স্ট্যাটিস্টার তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তান বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম তুলা উত্পাদনকারী দেশ। পাশাপাশি পাকিস্তান ইউরোপীয় ইউনিয়নের জেনারালাইজড স্কিম অব প্রেফারেন্সেস প্লানের (জিএসপি+) সুবিধা ভোগ করে, যেখানে বাংলাদেশ কেবল স্ট্যান্ডার্ড জিএসপি সুবিধা পেয়ে থাকে।
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ সরকার হঠাৎ করে গ্যাসের দাম ১৫০ দশমিক ৪১ শতাংশ বৃদ্ধি করে, অর্থাৎ প্রতি ইউনিট ১১ টাকা ৯৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করে। তখন প্রধান হোম টেক্সটাইল রপ্তানিকারকদের উত্পাদন ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেলে তারা ওয়ার্ক অর্ডার নেওয়া থেকে বিরত থাকে। ফলে সেই সময়ে অনেক অর্ডার পাকিস্তানে চলে যায়।
লিটল গ্রুপের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম বলেন, হঠাৎ করে গ্যাসের দাম বাড়ানোয় স্থানীয় হোম টেক্সটাইল রপ্তানিকারকরা বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হন। কারণ গ্যাসের দাম বাড়ানোর আগে কম দামের ভিত্তিতে ওয়ার্ক অর্ডার নেওয়া হয়েছিল।
উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, যদি কোনো বড় কোম্পানিকে আগে মাসে ৬৮ কোটি টাকা বিল পরিশোধ করা লাগত, গ্যাসের দাম বাড়ানোর পর সেই খরচ বেড়ে হয় ১২৬ কোটি টাকা।
'তাই স্থানীয় মিলাররা বেশ কিছুদিন ধরে নতুন ওয়ার্ক অর্ডার নেয়নি,' বলেন তিনি।
তবে হোম টেক্সটাইলের রপ্তানি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পাকিস্তানের আরেকটি বড় সুবিধা হলো সেখানে সহজেই তুলা পাওয়া যায়। বিপরীতে বাংলাদেশের তুলার চাহিদার ৯৮ শতাংশের বেশি মেটাতে আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়।
পাকিস্তানর মোট রপ্তানির পরিসংখ্যানেও হোম টেক্সটাইল খাতের পারফরম্যান্স বেশ ভালো।
পাকিস্তানের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এসএএমএএ টিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারের নীতি ও স্পেশাল ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলিটেশন কাউন্সিলের (এসআইএফসি) সুবিধার কারণে আগস্টে পাকিস্তানের টেক্সটাইল রপ্তানি ২৬ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ১ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার হয়েছে এবং আগের বছরের চেয়ে ১৩ শতাংশ বেশি।
পাকিস্তান পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের আগস্টে টেক্সটাইল রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার।
গত বছরের চেয়ে পাকিস্তানের নিটওয়্যার ও বেডওয়্যার রপ্তানি ১৫ শতাংশ এবং তৈরি পোশাক রপ্তানি ২৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে বিভিন্ন খাতে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
এসএএমএএ টিভির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বৈশ্বিক টেক্সটাইল বাজারে পাকিস্তানের উত্থানের জন্য দেশটির কৌশলগত অবস্থানকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও চীনের ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আমদানিকারকদের বিকল্প খুঁজতে বাধ্য করেছে।
অন্যদিকে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের হোম টেক্সটাইল রপ্তানি ২ দশমিক ০৫ শতাংশ কমে ৮৫১ দশমিক ০১ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
২০২১ অর্থবছরে দেশের হোম টেক্সটাইল রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছিল, যা তার আগের বছরের চেয়ে ৪৯ দশমিক ১৭ শতাংশ বেড়েছিল। পরের বছরও একই ধারা অব্যাহত ছিল এবং রপ্তানি আরও ৪০ শতাংশ বেড়ে ১ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার হয়েছিল।
যাইহোক, গ্যাস সংকটে পরের বছর রপ্তানি বৃদ্ধির প্রবণতা কমতে শুরু করে এবং হোম টেক্সটাইল রপ্তানি কমে ১ দশমিক ০৯ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়।
নোমান গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক শহীদুল্লাহ চৌধুরী বলেন, 'আমাদের আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতি মাসে ৩০ মিলিয়ন ডলারের হোম টেক্সটাইল রপ্তানির কথা ছিল। কিন্তু আমরা এখন প্রতি মাসে ২৫ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি করছি।'
তিনি আরও বলেন, 'এটি আগের মাসের চেয়েও কম, অথচ বাড়ার কথা ছিল।'
তিনি জানান, রপ্তানি করা অর্থের মধ্যে ১৫ মিলিয়ন ডলার আসে হোম টেক্সটাইল থেকে এবং ১০ মিলিয়ন ডলার আসে টেরি টাওয়েলের চালান থেকে।
তার ভাষ্য, 'আমরা হারানো ব্যবসা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছি। তবে গ্যাসের চাপ কম ও শ্রমিক অসন্তোষের মতো কিছু কারণ ব্যবসায়ের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।'
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মনসুর আহমেদও একই কথা বলেন।
তিনি বলেন, পাঁচ থেকে সাতটি বড় হোম টেক্সটাইল কোম্পানি বর্তমানে রপ্তানি করছে এবং কয়েক বছর আগে কয়েকটি বড় কোম্পানি বিভিন্ন কারণে বন্ধ হয়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, 'গ্যাসের চাপ কম থাকায় টেক্সটাইল মিলগুলো পূর্ণ সক্ষমতায় চলতে পারছে না এবং বাজারে প্রতিযোগিতা করার মতো পর্যাপ্ত পণ্য উৎপাদন করতে পারছে না। এছাড়া পাকিস্তান প্রায় ৬৬ অগ্রাধিকারমূলক শুল্ক উপভোগ করছে, ২০১৪ সাল থেকে জিএসপি+ সুবিধার অধীনে ইইউ বাজারে তাদের রপ্তানির ক্ষমতা বেড়েছে।'
২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ইইউতে পাকিস্তানের রপ্তানি বেড়েছে ১০৮ শতাংশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে আমদানি বেড়েছে ৬৫ শতাংশ। মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ২০১৩ সালের ৮ দশমিক ৩ বিলিয়ন ইউরো থেকে বেড়ে ১৪ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ইউরোতে দাঁড়িয়েছে।
Comments