ডলার সংকটে বেড়েছে গমের দাম, ভোগান্তিতে ভোক্তারা

বাংলাদেশ স্থানীয়ভাবে চালের চাহিদার সিংহভাগ পূরণ করতে পারলেও, গমের চাহিদা মেটাতে মূলত বৈশ্বিক বাজারের ওপর নির্ভর করতে হয়।
রাশিয়া থেকে ৩ লাখ মেট্রিক টন গম আমদানি করবে সরকার
চট্টগ্রামের চরপাড়া ঘাটে একটি জাহাজ থেকে আমদানি করা গম বস্তায় ভরছেন শ্রমিকরা। ছবি: রাজিব রায়হান/স্টার

মার্কিন ডলারের দাম বাড়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দামও ঊর্ধ্বমুখী। একই সময়ে গমের দামও বাড়তে শুরু করেছে, এতে ভোক্তারা দ্বিগুণ ভোগান্তির সম্মুখীন হচ্ছেন।

চাল ও গমের মতো অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের ক্রমবর্ধমান দাম বৃদ্ধি ভোক্তাদের ওপর সুস্পষ্ট প্রভাব ফেলতে পারে বলে বলছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত এক মাসে চালের দাম ২ শতাংশ বেড়ে ৫ দশমিক ৬১ শতাংশ হয়েছে এবং একই সময়ে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোগ্য শস্য গমের দাম কেজিতে ৯ দশমিক ২০ শতাংশ বেড়ে ১৪ দশমিক ২৯ শতাংশ হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট তথ্য মতে, বাংলাদেশ স্থানীয়ভাবে চালের চাহিদার সিংহভাগ পূরণ করতে পারলেও, গমের চাহিদা মেটাতে মূলত বৈশ্বিক বাজারের ওপর নির্ভর করতে হয়। বাংলাদেশের বার্ষিক গমের চাহিদা ৭০-৭৫ লাখ মেট্রিক টন, যার ৮৫ শতাংশ আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়।

দেশের অন্যতম পণ্য আমদানিকারক ও প্রক্রিয়াকরণ প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের জ্যেষ্ঠ সহকারী মহাব্যবস্থাপক তসলিম শাহরিয়ার বলেন, চলমান বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের কারণে মার্কিন ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় গমের দাম বাড়ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার, কিন্তু এ বছরের ৫ অক্টোবর তা কমে দাঁড়ায় ২১ দশমিক ০৫ বিলিয়ন ডলারে। ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ ছিল প্রায় ৪০ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার।

সাম্প্রতিক তথ্যে আরও দেখা গেছে, বৈদেশিক মুদ্রার আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় গত বছরের জানুয়ারি থেকে টাকার মূল্য প্রায় ২৮ শতাংশ কমে গেছে।

গতকাল দেশের প্রধান দুই শহরের পাঁচটি কাঁচাবাজার থেকে সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, গতকাল ঢাকা ও চট্টগ্রামের ক্রেতারা প্রতি কেজি গম কিনেছেন প্রায় ৪৮-৫০ টাকায়, যা এক মাস আগে ছিল ৪২-৪৫ টাকা।

রাজধানীর অন্যতম বৃহৎ কাঁচাবাজার কারওয়ান বাজারের আল আমিন স্টোরের খুচরা বিক্রেতা আশরাফুল ইসলাম জানান, গতকাল প্রতি কেজি আটা বিক্রি হয়েছে ৪৮-৫০ টাকায়।

তিনি আরও জানান, এক মাস আগে দুই কেজির ব্র্যান্ডেড আটার প্যাকেটের দাম ছিল ১০০ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়।

ঢাকা ও চট্টগ্রামের পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, এক মাসের ব্যবধানে প্রতি ৫০ কেজির বস্তায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটির দাম বেড়েছে ৩০০-৩২০ টাকা।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারের লাকসাম স্টোরের পাইকারি বিক্রেতা আবুল হোসেন জানান, তিনি গতকাল প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) আটা বিক্রি করেছেন ২ হাজার ২০০ টাকায়, যা এক মাস আগে ছিল ১ হাজার ৮৮০ টাকা।

তিনি বলেন, 'আমাদের বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে, তাই বেশি দামে বিক্রি করছি। তবে, চাহিদা অনুযায়ী পণ্য পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু মিলাররা বলছেন, বাজারে গমের ঘাটতি থাকায় দাম বাড়ছে।'

চট্টগ্রামের আরেক পাইকারি ব্যবসায়ীয়ও একই ধরনের মন্তব্য করেছেন।

এছাড়া ফসল কাটার মৌসুম শেষ হওয়ায় ও শিপিং খরচ বাড়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম বেড়েছে বলেও জানান মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের তসলিম শাহরিয়ার।

তিনি জানান, চাহিদা অনুযায়ী আমদানি না হলে বাজারে প্রভাব পড়বে। চাহিদা অনুযায়ী আমদানির চেষ্টা করা হচ্ছে।

তিনি আরও জানান, বর্তমানে তারা আর্জেন্টিনা, রাশিয়া ও রোমানিয়া থেকে প্রতি টন ২৯০ থেকে ৩০০ ডলারে এবং কানাডা থেকে প্রিমিয়াম মানের গম ৩৬০ ডলারের বেশি দামে কিনছেন।

তিনি বলেন, এক মাস আগে তারা প্রতি টন স্বাভাবিক মানের গম ২৮০ থেকে ২৯০ ডলারে কিনেছিলেন, তবে প্রিমিয়াম মানের গমের দাম এক মাস আগের ৩৮০ ডলার থেকে কমেছে।

যদিও এসব তথ্য যাচাই করতে পারেনি দ্য ডেইলি স্টার।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক আমদানিকারক জানান, বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে এক মাস আগে প্রতি ডলারের জন্য ১১৫ থেকে ১১৬ টাকা থেকে ১২৫ টাকা নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বর পর্যন্ত মোট বৈদেশিক রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ১৯ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে, যা গত তিন মাসের তুলনায় প্রায় ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ কম এবং তিন মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি বিল মেটানোর জন্য যথেষ্ট।

দেশের অন্যতম গম আমদানিকারক নাবিল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুল ইসলাম জানান, আরেকটি কারণ হলো, সময়মতো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে না পারার কারণে চাহিদা অনুযায়ী গম আমদানি করা যাচ্ছে না। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারেও গমের দাম ঊর্ধ্বমুখী।

তিনি বলেন, 'প্রতি মাসে আমাদের ৩ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টন গমের প্রয়োজন হয়, কিন্তু আমরা মাত্র আড়াই লক্ষ টন গম আমদানি করতে পেরেছি।'

তিনি আরও বলেন, 'এছাড়া রাশিয়ার আবহাওয়া এখন খুবই খারাপ। এ কারণে সময়মতো গম পাঠানো হচ্ছে না। তাই স্থানীয় বাজারে চাহিদা অনুযায়ী সময়মতো গম আমদানি করা যাচ্ছে না।'

অন্যদিকে গত কয়েকদিনে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম টনপ্রতি ২০ থেকে ২৫ ডলার বেড়েছে বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, আগস্টে প্রতি টন গমের ফ্রেইট চার্জ ছিল ৩৮ ডলার, যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫ থেকে ৬২ ডলারে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ৩৮ লাখ ৭৫ হাজার টন গম আমদানি হয়েছে।

চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (২৭ নভেম্বর পর্যন্ত) গম আমদানি হয়েছে ১৮ লাখ ৮৭ হাজার মেট্রিক টন।

আমদানিকারকদের অনুমান, চলতি অর্থবছরের শেষ নাগাদ প্রায় ৪৫ থেকে ৪৮ লাখ টন গম আমদানি হতে পারে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশে, যা অন্তত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। এদিকে খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি গত মাসে ৪৮ বেসিস পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৩ শতাংশে।

Comments

The Daily Star  | English

Post-August 5 politics: BNP, Jamaat drifting apart

The taunts and barbs leave little room for doubt that the 33-year-old ties have soured. Since the fall of Sheikh Hasina’s government on August 5, BNP and Jamaat-e-Islami leaders have differed in private and in public on various issues, including reforms and election timeframe.

4h ago