মিলাররা চালের বস্তায় দাম লিখতে চান না যে কারণে

সরকারের নির্দেশনা থাকলেও, দাম না লিখেই বাজারে চালের বস্তা সরবরাহ করে যাচ্ছেন মিলাররা। ছবিটি কারওয়ান বাজারের একটি চালের আড়ত থেকে তোলা। ছবি: পলাশ খান/স্টার

চালের দাম নিয়ে কারসাজি বন্ধে চালের বস্তায় মিল গেটের মূল্য লিখে দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছিলেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার।

১৪ এপ্রিল থেকে এ নির্দেশনা মেনে চলার কথা ছিল ব্যবসায়ীদের। কিন্তু প্রায় ২০ দিন পার হয়ে গেলেও, চালের বস্তায় মূল্য লেখা হচ্ছে না। 

মিলারদের জন্য নির্দেশ ছিল গুদাম থেকে চাল সরবরাহের আগে বস্তার ওপর মিলের নাম, জেলা ও উপজেলার নাম, উৎপাদনের তারিখ, মিল গেট মূল্য এবং ধান-চালের জাত লিখে দিতে হবে।

সম্প্রতি সরেজমিনে রাজধানীর বেশ কিছু চালের আড়ত ঘুরে দেখা গেছে, নতুন বস্তায় নতুন চাল আসছে। বস্তায় মিলের নাম, উৎপাদন তারিখ, ধানের জাত উল্লেখ করা আছে। কিন্তু দাম লেখা নেই।

মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের আড়তে চাল সরবরাহ করে প্রায় শতাধিক প্রতিষ্ঠান। অল্প কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বস্তায় দাম লেখা থাকলেও, বেশিরভাগ বস্তায় এটি দেখা যায়নি।

কৃষি মার্কেটের চাল ব্যবসায়ী তাওহিদুল ইসলামের প্রতিষ্ঠান আকন্দ ট্রেডিংয়ে গিয়ে দেখা যায়, কোনো চালের বস্তায় দাম লেখা নেই।

জানতে চাইলে তাওহিদুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি যেখান থেকে চাল আনি, তারা এখনো আগের চাল সরবরাহ করে যাচ্ছে। তাই হয়ত মূল্য লেখা নেই।'

যদিও অন্যান্য ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন যে, এপ্রিলের শেষ দিকে থেকেই বাজারে নতুন চাল আসতে শুরু করেছে।

দুয়েকজন ব্যবসায়ী বস্তার গায়ে চালের দাম লিখে দিচ্ছেন। সেটি মিলের দাম হলেও, ক্রেতারা ওই দামের বেশি দিতে চান না বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের। ছবি: শাহীন মোল্লা/স্টার

কৃষি মার্কেটসহ সব আড়তেই এখন নতুন চাল দেখা যাচ্ছে। এসব চালের বস্তায় অন্যান্য তথ্য থাকলেও, দাম লেখা নেই।

কৃষি মার্কেটের মেসার্স ইবু এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আবু জাফর ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাজারে নতুন চাল এসেছে। কয়েকটা জাতের নতুন চালের দামও দুই-এক টাকা করে কমেছে কেজিতে।'

বস্তার গায়ে মূল্য লেখা হচ্ছে না কেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'অনেক মিল মালিকের ইচ্ছা থাকলেও, বস্তার গায়ে দাম লিখছেন না। চালের দাম বাড়া-কমার কারণে তারা হয়ত দ্বিধা-দ্বন্দ্বে থাকতে পারেন।'

একই বাজারের মেসার্স সালেক রাইস এজেন্সিতে গিয়ে দেখা যায়, কিছু বস্তার গায়ে চালের দাম লিখা আছে। বগুড়ার আলাল অ্যাগ্রো ফুড প্রোডাক্টসের সরবরাহ করা একাত্তর চালের ২৫ কেজির বস্তার দাম ১৩০০ টাকা দাম লেখা।

জানতে চাইলে সালেক রাইস এজেন্সির ম্যানেজার নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই চালের উৎপাদনের তারিখ ২০ এপ্রিল। কিন্তু চালের দাম এখন কমে গেছে। যদিও মিলগেটের দাম ১৩০০ টাকা লেখা, আমাদেরও একই দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে। গাড়িভাড়া, শ্রমিক খরচ বাবদ কেজিতে আমাদের এক থেকে দেড় টাকা খরচ আছে।'

'কিন্তু, কেজিতে এই চালের দাম দুই টাকা কমে যাওয়ায়, ২৫ কেজি বস্তায় কিছুটা লোকসান দিয়েই আমাদের ১৩০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে,' বলেন তিনি।  

এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, 'দুই সপ্তাহ আগে এই চাল আসে। পরিবহন আর শ্রমিক খরচ দেওয়ার পর লাভ করতে চাইলে দাম পড়ে যায় ১৩৫০ টাকা। কিন্তু আমরা ওই দামে বিক্রি করতে পারিনি। কারণ, গায়ে দাম লেখা ১৩০০ টাকা।'

খুচরা বিক্রেতারা জানান, বস্তার গায়ে দাম লেখা থাকে মিল গেটের। সেখান থেকে পাইকারি বাজার হয়ে খুচরা বাজারে চাল আসার পর স্বাভাবিকভাবেই দাম বেড়ে যাওয়ার কথা। তাই বস্তায় মিল গেটের দামের পাশাপাশি পরিবহন খরচ ও যৌক্তিক মুনাফা যুক্ত করে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য উল্লেখ থাকা দরকার।

বস্তায় মিলরেট লেখা থাকা চাল বিক্রির বিড়ম্বনা সম্পর্কে কারওয়ান বাজারের একটি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী বাচ্চু মিয়া বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ২৫ কেজির এক বস্তা চাল কারওয়ান বাজার পর্যন্ত আনতে ৪০-৪২ টাকা খরচ হয়। এর সঙ্গে কেজিপ্রতি দুই টাকা মুনাফা ধরে বিক্রি করতে গেলে মিল গেটের দামের চেয়ে ৯০-৯২ টাকা পার্থক্য হয়ে যায়। কিন্তু ক্রেতারা বস্তায় লেখা থাকা দামেই চাল কিনতে অনড় থাকেন। এ কারণে তিনি মিল রেট লেখা থাকে এমন চাল বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন।

প্রায় একই রকম অভিজ্ঞতার কথা জানান শেওড়াপাড়ার বিসমিল্লাহ স্টোরের স্বত্বাধিকারী মো. রনি। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বস্তার গায়ে ১৩০০ টাকা লেখা থাকলেও, আমাদের কিনতে হয় ১৩৫০ টাকা দিয়ে। তারপর দোকান পর্যন্ত আনতে বস্তা প্রতি আরও ৪০ টাকা খরচ হয়। কেজিতে ২-৩ টাকা লাভ করতে চাইলে দাম গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ১৪৫০ টাকা। ক্রেতার কাছে এই দাম চাইলে, তারা বস্তার গায়ের দামের সঙ্গে ফারাকের কারণে আমাদের ওপর ক্ষেপে যান।'

মিল মালিকরা জানান, সরকারের নির্দেশনাকে স্বাগত জানালেও, চালের বস্তার গায়ে দাম লেখা নিয়ে তারা দ্বিধাগ্রস্ত।

যোগাযোগ করা হলে নওগাঁ ধান-চাল আড়তদার ও ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নিরোদ বরণ সাহা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অনেকে দাম লিখে বাজারে চাল সরবরাহ করছেন। কিন্তু অনেক মিলার বস্তার গায়ে দাম লিখছেন না। এর প্রধান কারণ হলো আগের চাল এখনো বস্তাসহ মিলে রয়ে গেছে। সেগুলো বিক্রি শেষ হলে নতুন বস্তায় দাম লেখা হবে।'

তিনি আরও বলেন, 'দাম লিখলে নতুন কিছু সমস্যাও দেখা দেবে। মিলারদের সবার উৎপাদন খরচ এক নয়। এমনিতেই ধানের দাম ওঠানামা করে। তার মধ্যে অনেক ব্যবসায়ী নগদ টাকায় ব্যবসা করেন, অনেকে বাকিতে করেন। আবার অনেকে ব্যাংক লোন নিয়েও চালের ব্যবসা করেন।'

'একই চাল উৎপাদনের ক্ষেত্রে একেকজনের খরচ একেকরকম পড়বে। তখন যে দাম বেশি লিখবে, তাকে আবার জবাবদিহির মধ্যে পড়তে হবে। আর দাম বাড়িয়ে লিখে বিক্রির জন্য বাজারে কিছু অসাধু মিল-মালিক তো আছেই। এ কারণে বস্তার গায়ে দাম লেখার সিদ্ধান্তটা আমাদের কিছুটা বিড়ম্বনায় ফেলে দিয়েছে,' বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English
Overall situation of foreign direct investment

Net foreign direct investment hits six-year low

The flow of foreign direct investment (FDI) in Bangladesh fell to $104.33 million in the July-September quarter of fiscal year 2024-25, the lowest in at least six years, as foreign investors stayed away from Bangladesh amid deadly political unrest, labour agitation, and a persistent economic crisis.

13h ago