একের পর এক কোম্পানি অধিগ্রহণে মুনাফা কমেছে এসএস স্টিলের

এসএস স্টিল লিমিটেড, পুঁজিবাজার, শেয়ারবাজার,

এসএস স্টিল লিমিটেড পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত একটি কোম্পানি। কোম্পানিটি ২০২০ সাল থেকে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে অধিগ্রহণ শুরু করে। ফলে তখন এসএস স্টিলের বিক্রি বৃদ্ধি পায় এবং টার্নওভার বাড়ে। কিন্তু, কোম্পানিটির সামগ্রিক মুনাফা হার কমেছে।

চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে এসএস স্টিলের বিক্রি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪১ শতাংশ বেড়ে ১ হাজার ৬৪২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। তারপরও কোম্পানিটি মাত্র ৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা মুনাফা করতে পেরেছে, যা শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ইস্পাত কোম্পানিগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন।

জুলাই-মার্চ সময়ে এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলসের মুনাফা মার্জিন ছিল শূন্য দশমিক ৬৪ শতাংশ, জিপিএইচ ইস্পাতের মুনাফা মার্জিন ছিল ১ দশমিক ৪৫ শতাংশ, বিএসআরএম স্টিলসের মার্জিন ৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ এবং বিএসআরএম লিমিটেডের মুনাফা মার্জিন ছিল ৫ দশমিক ২০ শতাংশ।

সাধারণত একটি কোম্পানির মুনাফা মার্জিন ওই কোম্পানির রাজস্বের শতকরা হারের পরিমাপক, যা কাঁচামাল ও পরিবহন খরচের মতো সব খরচ বাদ দেওয়ার পর মুনাফা হিসেবে দেখানো হয়।

কোম্পানিটির তথ্য অনুযায়ী, এসএস স্টিল গত পাঁচ বছরে সালেহ স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ, আল-ফালাহ স্টিল, সুপার স্টিল এবং পেনিনসুলা স্টিল মিলস অধিগ্রহণ করেছে। শুধু তাই নয় এসব কোম্পানিতে উৎপাদন বাড়াতে বড় অঙ্কের বিনিয়োগও করেছে।

ফলে এসএস স্টিলের বিক্রি বাড়লেও অন্যান্য আর্থিক সূচকের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এর মুনাফা কমছে। এর মূল কারণ মূলত ঋণের উচ্চ সুদ ও কাঁচামালের উচ্চমূল্য।

২০২০-২১ অর্থবছরে নিট অর্থায়ন ব্যয় বা ঋণের সুদ ছিল টার্নওভারের ৫ শতাংশ, যেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ শতাংশে।

অতএব, বিনিয়োগকারী ও শেয়ার বাজার বিশ্লেষকরা এসএস স্টিলের অন্য কোম্পানি অধিগ্রহণের যুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। কারণ এই উদ্যোগের কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা উপকৃত হয়নি, তাহলে কাদের সুবিধা হলো তাও স্পষ্ট নয়।

২০১৯ সালে ব্যবসা শুরুর সময় সব তালিকাভুক্ত ইস্পাত কোম্পানির মধ্যে সর্বোচ্চ নিট মুনাফা মার্জিন ছিল এসএস স্টিলের। এটি কোম্পানিটিকে পাবলিক অফারের মাধ্যমে ২৫ কোটি টাকা তুলতে সহায়তা করেছিল।

একটি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বর্তমানে ইস্পাত শিল্পে সবচেয়ে কম মুনাফা মার্জিন রয়েছে এসএস স্টিলের।

এসএস স্টিলের মুনাফা কমে যাওয়ার যৌক্তিক ব্যাখ্যা কী হতে পারে তা উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, ব্যবসায়িক কারণে শেয়ারবাজারের মুনাফার মার্জিন কমেছে কি না তা খতিয়ে দেখা উচিত।

তিনি আরও বলেন, 'কিছু কোম্পানি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে ভালো পারফরম্যান্স দেখায়। কিন্তু ট্রেডিং শুরুর পর কোম্পানির পারফরম্যান্স দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই এসএস স্টিলের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে কিনা তা নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদন্ত করা উচিত।'

এসএস স্টিলের মুনাফা মার্জিন ২০১৯ অর্থবছরে ছিল ১২ দশমিক ৫১ শতাংশ, যা ২০২০ ও ২০২১ অর্থবছরে ছিল যথাক্রমে ১২ শতাংশ এবং ১৪ শতাংশ।

ওই তিন বছরে জিপিএইচ ইস্পাতের মুনাফা মার্জিন ছিল যথাক্রমে ৬ শতাংশ, ৩ শতাংশ ও ৫ শতাংশ। ওই তিন বছরে বিএসআরএম লিমিটেড ও বিএসআরএম স্টিলসের মুনাফা মার্জিন বেড়েছে ১ দশমিক ৯২ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশ।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) উচিত এসএস স্টিলের বর্তমান অবস্থার পেছনের কারণগুলো খতিয়ে দেখা, কারণ এটি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারে।

এদিকে কমে যাওয়া মুনাফা মার্জিনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কোম্পানিটি বছরের পর বছর ধরে লভ্যাংশ দেওয়ার হার কমিয়েছে। এসএস স্টিল ২০১৯ অর্থবছরে ১৫ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ ঘোষণা করেছিল। অথচ ২০২২ অর্থবছরে তা কমে ১০ শতাংশে নামে। সর্বশেষ গত অর্থবছরের জন্য ২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে।

এসএস স্টিল ২০২০ সালে ২৫ কোটি টাকায় সালেহ স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ কিনে নেয় এবং আরও ১৩৪ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে। এরপর ২০২২ সালে আল-ফালাহ স্টিল অধিগ্রহণ করে এবং এখন পর্যন্ত কোম্পানিতে প্রায় ১৮৪ কোটি ১৪ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে।

এক বছর পর ব্যবসা সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে প্রায় ১৩০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সুপার স্টিল লিমিটেড ও পেনিনসুলা স্টিল মিলসের স্থাবর সম্পদ কিনে নেয় প্রতিষ্ঠানটি।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, কোম্পানিটির রিটেইনড আর্নিংস থেকে ও ব্যাংক ঋণ নিয়ে এ অর্থ বিনিয়োগ করে। ফলে কোম্পানিটির ঋণ-ইক্যুইটি অনুপাত বেড়েছে।

এসএস স্টিলের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ অর্থবছরে কোম্পানিটির ঋণ-ইক্যুইটি অনুপাত ছিল শূন্য ৪৮ শতাংশ এবং ২০২২ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ২৪ শতাংশ।

এই অনুপাত থেকে বোঝা যায়, একটি কোম্পানি তার শেয়ারহোল্ডারদের ইক্যুইটি মূল্যের তুলনায় সম্পদের অর্থায়নে কতটা ঋণ ব্যবহার করছে।

কোম্পানিটির আর্থিক খরচও বাড়ছে। ২০২০ অর্থবছরে নিট ঋণ ব্যয় ছিল ২৬ কোটি টাকা, যা ২০২৩ অর্থবছরে বেড়ে ১২১ কোটি টাকা হয়েছে। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে নিট ঋণ ব্যয় হয়েছে ১০০ কোটি টাকার বেশি।

ব্যাংক ঋণ পরিশোধ, বিদ্যমান প্রকল্প সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নের লক্ষ্যে গত মাসে এসএস স্টিল ৫০০ কোটি টাকার বন্ড ইস্যুর অনুমোদন পেয়েছে।

এসব কোম্পানি অধিগ্রহণের আগে এসএস স্টিল ২০২০ অর্থবছরে ৪৩ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল। পরের বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭০ কোটি টাকায়। কিন্তু তারপর থেকে কমতে শুরু করে।

এসএস স্টিল ২০২২ ও ২০২৩ অর্থবছরে মুনাফা করেছে যথাক্রমে ৬১ কোটি টাকা ও ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা।

কোম্পানিটি তার আর্থিক প্রতিবেদনে, ২০২৩ সালে মুনাফা কমার জন্য স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নের পাশাপাশি কাঁচামাল ও ইউটিলিটি ব্যয়কে দায়ী করেছে।

গত ২৮ এপ্রিল এসএস স্টিলের কোম্পানি সচিবের কাছে ইমেইল করে এর পারফরম্যান্স নিয়ে মন্তব্য জানতে চেয়েছিল দ্য ডেইলি স্টার। তবে ২০ মে পর্যন্ত তিনি কোনো উত্তর দেননি।

বিএসইসির মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, এসএস স্টিল অন্য কোম্পানি অধিগ্রহণের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদনের প্রয়োজন হয়নি এবং প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র জমা দিয়েছে।

তিনি বলেন, 'আমরা কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করছি এবং কিছু বিষয়ে কিছু প্রশ্ন তৈরি করছি। কোম্পানি যথাযথ জবাব দিতে না পারলে আমরা ব্যবস্থা নেব।'

Comments