‘মার্চে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছে যুক্তরাষ্ট্র’
সম্প্রতি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে আগ্রাসনে কিনজাল ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে রাশিয়া. এটি শব্দের চেয়ে ৫ গুণেরও বেশি দ্রুতগতিতে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম এমন একটি 'হাইপারসনিক' যুদ্ধাস্ত্র। অত্যাধুনিক এই অস্ত্রের ব্যবহারে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়।
এমনকি কোনো কোনো বিশ্লেষক দাবি করেছেন, স্থলযুদ্ধের ব্যর্থতা ঢাকতেই রাশিয়া এ ধরনের মরণাস্ত্র ব্যবহার করছে।
তবে রাশিয়ার এ অস্ত্র ব্যবহারে আপত্তি জানালেও একই প্রযুক্তি নিয়ে নীরবে কাজ করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
আজ বৃহস্পতিবার মার্কিন সংবাদ সংস্থা সিএনএনের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, মার্চের মাঝামাঝিতে যুক্তরাষ্ট্র হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালায়। তবে এ তথ্য গোপন রাখা হয়, কারণ সেসময় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউরোপ সফরে যাচ্ছিলেন এবং মার্কিন প্রশাসন চায়নি তার সফরের সময় এ বিষয়টি নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে নতুন করে কোনো উত্তেজনার সৃষ্টি হোক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা এসব তথ্য দিয়েছেন। তিনি জানান, হাইপারসনিক এয়ার ব্রিদিং কনসেপ্ট (এইচএডব্লিউসি) ক্ষেপণাস্ত্রটিকে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট কোস্টে একটি বি-৫২ বোমারু উড়োজাহাজ থেকে ছোড়া হয়। লকহিড মার্টিন প্রতিষ্ঠানের নির্মিত এ ক্ষেপণাস্ত্রের এটাই প্রথম সফল পরীক্ষা।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, প্রথমে একটি বুস্টার ইঞ্জিনের মাধ্যমে ক্ষেপণাস্ত্রটি গতিবেগ বাড়ায়। এরপর এয়ার-ব্রিদিং স্ক্র্যামজেট ইঞ্জিনটি চালু হয় এবং এর মাধ্যমে ক্ষেপণাস্ত্র হাইপারসনিক গতিবেগে পৌঁছে লক্ষ্যবস্তুতে (এ ক্ষেত্রে সমুদ্র) আঘাত হানে।
তিনি আরও জানান, ক্ষেপণাস্ত্রটি ভূপৃষ্ঠ থেকে ৬৫ হাজার ফুট উচ্চতায় প্রায় ৩০০ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করে। তবে হাইপারসনিক ফ্লাইটের ক্ষেত্রে ৩০০ মাইল দূরত্ব পার হতে ৫ মিনিটের বেশি সময়ও লাগার কথা না।
রাশিয়া ইউক্রেনে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের কয়েকদিন পরেই যুক্তরাষ্ট্র এই পরীক্ষা চালায়। কিন্তু সেসময় এ তথ্য বিশ্ববাসীর কাছ থেকে গোপন রাখা হয়। সেসময় মার্কিন কর্মকর্তারা রাশিয়ার এই নব্য প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়টিকে ছোট করে দেখানোর চেষ্টা করেন। তখন প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন বলেছিলেন, তিনি মনে করেন না হাইপারসনিক অস্ত্র কোনো ঘটনার 'মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো' যুগান্তকারী কোনো প্রযুক্তি। কয়েকদিন পর, পেন্টাগনের প্রেস সচিব জন কার্বি জানান, এই অস্ত্র ব্যবহারের পেছনে যুক্তি কী, তা বোঝা কঠিন।
তিনি সামান্য একটি অস্ত্রাগার ধ্বংসের জন্য হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহারকে মশা মারতে কামান দাগার সঙ্গে তুলনা করেন।
যুক্তরাষ্ট্র আরও দাবি করে, রাশিয়ার কিনজাল ক্ষেপণাস্ত্র হচ্ছে তাদেরই স্বল্প পাল্লার ইসকান্দার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের একটি সামান্য উন্নত সংস্করণ—এটি কোনো অত্যাধুনিক বা নতুন প্রযুক্তি নয়। তুলনামূলকভাবে, মার্কিনরা বেশ জটিল ও অত্যাধুনিক এয়ার ব্রিদিং স্ক্র্যামজেট ইঞ্জিনের পরীক্ষা চালিয়েছে। প্রথাগত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মতো এই এইচএডব্লিউসি ক্ষেপণাস্ত্রের কোনো ওয়ারহেড নেই। লক্ষ্যবস্তু ধ্বংসের জন্য এটি শুধু 'কাইনেটিক এনার্জির' ওপর নির্ভর করে।
এই পরীক্ষা চলার সময় বাইডেন ইউরোপে ন্যাটোর মিত্রদের সঙ্গে বৈঠকের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এরপর তিনি পোল্যান্ডের মাটিতে ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন।
ইউক্রেনে রাশিয়া হামলা করার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ওয়াশিংটন ও মস্কোর মধ্যে উত্তেজনা কমিয়ে রাখার জন্য চেষ্টা চালিয়ে গেছে। গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্র তাদের মিনিটম্যান থ্রি আইসিবিএম ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা বাতিল করে যাতে রাশিয়া এই উদ্যোগকে যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে না দেখে।
যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে কী ধরনের অস্ত্র ও সামরিক উপকরণ পাঠাচ্ছে, সে বিষয়েও বেশ গোপনীয়তা বজায় রেখেছে। শুধুমাত্র ৩০০ মিলিয়ন ডলারের নিরাপত্তা সহায়তা প্যাকেজের ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সুনির্দিষ্ট করে অস্ত্র ও উপকরণের তালিকা প্রকাশ করেছে।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে যুদ্ধ উড়োজাহাজ পাঠানোর ব্যাপারেও অনীহা প্রকাশ করেছে। তাদের ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে ইউক্রেনে উড়োজাহাজ পাঠানো হলে এই উদ্যোগকে ক্রেমলিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সরাসরি সংযুক্তি হিসেবে বিবেচনা করতে পারে।
প্রতিরক্ষা বিভাগের ওই কর্মকর্তা জানান, একই কারণে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সর্বশেষ হাইপারসনিক পরীক্ষার বিষয়ে ২ সপ্তাহে মুখ খোলেনি। তারা চাননি কোনোভাবে যেন এই উদ্যোগকে ক্রেমলিন বা রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন 'উসকানি' হিসেবে না দেখে। বিশেষত, যখন রুশ বাহিনী ইউক্রেনে আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়েছে।
মার্চের পরীক্ষাটি যুক্তরাষ্ট্রের হাইপারসনিক অস্ত্র পরীক্ষার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সাফল্য। তবে লকহিড মার্টিনের তৈরি ক্ষেপণাস্ত্রের ক্ষেত্রে এটাই প্রথম সাফল্য। গত সেপ্টেম্বরে মার্কিন বিমান বাহিনী নর্থরপ গ্রুম্ম্যানের নির্মাণ করা স্ক্র্যামজেট ইঞ্জিনে চালিত একটি রেথিওন এইচএডব্লিউসির সফল পরীক্ষা চালায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সির (ডারপা) প্রকাশিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, সব দিক থেকে এ পরীক্ষা সফল হয়েছে। তবে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে এই ক্ষেপণাস্ত্র কত গতিবেগে কত দূরত্বে পেরিয়েছে, তা জানায়নি। শুধু হাইপারসনিক গতিবেগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
রাশিয়া ও চীন সাম্প্রতিক মাসগুলোতে হাইপারসনিক অস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালানোর পর নতুন করে এ বিষয়ে নজর দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটন থেকে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চাপ দেওয়া হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তির দৌঁড়ে যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে না পড়ে।
২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রতিরক্ষা বাজেটে বাইডেন প্রশাসন হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ও অন্যান্য দূর পাল্লার অস্ত্রখাতে ৭ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার চেয়েছে। গত বছরের এক প্রতিবেদনে, হাইপারসনিক অস্ত্র নির্মাণের ৭০টি উদ্যোগের বিষয়ে জানা গেছে, যেগুলোতে ২০১৫ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ১৫ বিলিয়ন ডলার খরচের কথা বলা হয়েছে।
সেপ্টেম্বরে প্রথম এইচএডব্লিউসি পরীক্ষার পর যুক্তরাষ্ট্রে একটি ভিন্ন হাইপারসনিক অস্ত্রের পরীক্ষা ব্যর্থ হয়। সেসময় চীন দাবি করে, তারা হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকলের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে। অল্প সময় পরে রাশিয়াও দাবি জানায়, তারা সাবমেরিন থেকে ছোড়া হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে, যার নাম দেওয়া হয় সিরকন।
Comments