পাচার করা অর্থ রেমিট্যান্স হিসেবে ফেরত আনার সুযোগ অনৈতিক: টিআইবি

বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ

বিদেশে পাচার করা অর্থ রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় আকারে ফেরত আনার ঢালাও সুযোগ অনৈতিক এবং অর্থ পাচারকারীদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার শামিল বলে উদ্বেগ জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

আজ এক বিবৃতিতে সংস্থাটি জানায়, বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের যুক্তিতে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার করা অর্থ রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় আকারে ফেরত আনার ঢালাও সুযোগ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এক্ষেত্রে পাচারকারীরাও প্রবাসীদের পাঠানো আয়ের মতোই আড়াই ভাগ হারে প্রণোদনা পাবেন। একইসাথে পাচার করা অর্থ ফেরাতে আসছে বাজেটে অর্থমন্ত্রী আভাস দিয়েছেন স্বল্প জরিমানা দিয়ে বিদেশে অর্জিত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ ঘোষণা বা 'ট্যাক্স অ্যামনেস্টি' দেয়ার। এ ধরনের সুযোগ প্রদান শুধু অনৈতিক ও সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে 'শুন্য সহনশীলতা' নীতির সম্পূর্ণ বিপরীতই নয়, অসাংবিধানিকও বটে। অন্যদিকে নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে উল্লিখিত প্রক্রিয়ায় পাচারকৃত অর্থ ফেরত পাওয়ার যে প্রত্যাশা করা হচ্ছে, বাস্তবে তার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী গর্হিত এই অপরাধের জন্য শাস্তির বদলে পুরস্কার দেয়ার ব্যবস্থা করার এসব উদ্যোগকে অর্থ পাচারকারী তথা দুর্নীতিবাজদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার শামিল বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে টিআইবি।

অনৈতিক ও আইন পরিপন্থী এসব সুযোগ বাতিলের দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি। সেই সাথে বিদ্যমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের কার্যকর প্রয়োগের মাধ্যমে অর্থপাচার প্রতিরোধ ও পাচারকারীদের চিহ্নিত করে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য কার্যকর উদ্যোগের আহবান জানিয়েছে।

বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'বিশ্ব অর্থনৈতিক অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার সংকটকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ পাচারকারীদের অনৈতিক ও বৈষম্যমূলক সুযোগ দেয়া হচ্ছে, যা দেশের অর্থপাচার রোধে প্রণীত মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-কে বৃদ্ধাংগুলী দেখানোর শামিল।'

দুর্নীতি ও অর্থ পাচারকে এভাবে রাজক্ষমার ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে চলমান মামলার ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক প্রশ্ন তুলে বলেন, 'অর্থপাচারের মামলায় অভিযুক্তরাও এ সুযোগ গ্রহণ করতে চাইলে তাদের কি কোনো শাস্তি ভোগ করতে হবে না? এক্ষেত্রে সরকার কি তবে আইনের শাসনের পথ ফেলে আপসের পথে হাঁটবে? এসব বিষয়ে পরিস্কার ব্যাখ্যা জরুরি। বাজেটে বারবার কালো টাকা সাদা করার অন্যায্য, অসাংবিধানিক, বৈষম্যমূলক ও দুর্নীতি সহায়ক সুযোগ দেয়া হলেও তাতে রাষ্ট্রের কোনো উল্লেখযোগ্য সুফল অর্জনে ব্যর্থ হওয়ার বিব্রতকর উদহারণের পরও পাচার হওয়া অর্থ ফেরানোর নামে এ ধরনের অনৈতিকতার মহোৎসব কোনো বাস্তব ফল বয়ে আনবে মনে করাটা অযৌক্তিক এবং সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে 'শুন্য সহনশীলতা' নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত। এতে পাচারকারীরা অর্থ পাচারে বরং আরো উৎসাহিত হবে, অর্থপাচার আরও গভীর ও বিস্তৃত হবে, যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।'

গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর শুধু আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালেই আট বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ পাচারের যে তথ্য প্রকাশ করেছে তার উল্লেখ করে নির্বাহী পরিচালক বলেন, 'অর্থ পাচারের এই তথ্য সরকারের অজানা নয়। এক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অদক্ষতা, দায়িত্বে অবহেলা, সৎসাহসের ঘাটতি এবং এমনকি যোগসাজশের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। সরকারের স্বদিচ্ছা থাকলে অর্থ পাচারকারীদের আইনের আওতায় এনে পাচার হওয়া অর্থ যে ফিরিয়ে আনা সম্ভব, তার প্রমাণ হিসেবে সরকারি উদ্যোগে সিঙ্গাপুর থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা হয়েছিল। দুর্নীতি দমন কমিশনের পাশাপাশি অর্থপাচার প্রতিরোধে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংকের 'ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট' (বিএফআইইউ) ও অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ যৌথভাবে অর্থ পাচারের গন্তব্য দেশের সাথে পারস্পরিক আইনি সহায়তা উদ্যোগের মাধ্যমে পাচারকারীদের চিহ্নিত করা থেকে শুরু করে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা এবং আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে পাচারকারীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার যে সম্ভাবনা রয়েছে তা অর্জনে ব্যর্থতা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।'

তিনি আরো বলেন, 'আইন প্রয়োগের সুনির্দিষ্ট ও পরীক্ষিত পথ পরিহার করে অর্থ পাচারকারীদের অনৈতিক সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে অর্থ পাচার বন্ধ করা যাবে না। এতদিনে এটি স্পষ্ট যে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের পেশাগত উৎকর্ষ ও সৎসাহসের পাশাপাশি সব পর্যায়ে রাজনৈতিক স্বদিচ্ছা ছাড়া অর্থ পাচার বন্ধ করা সম্ভব নয়। অর্থ পাচাররোধে তাই দৃঢ় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে।'

টিআইবি মনে করে, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের যে তথ্য জিএফআই এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা  প্রকাশ করে, সেটি আংশিক। তারা শুধু বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচারের তথ্য দেয়। বাস্তবে এ অপরাধের প্রক্রিয়া ও গভীরতা আরও অনেক বেশি। তাই অর্থ পাচার প্রতিরোধ ও পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা এবং এই অপরাধের সাথে জড়িতদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা অন্যতম রাষ্ট্রীয় প্রাধান্য। এজন্য সরকারের উচিত, অর্থপাচারকারীদের জন্য অভিনব সুযোগ বা সুরক্ষা প্রদানের পথ পরিহার করে অবিলম্বে অর্থপাচারকারীদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনি প্রক্রিয়ায় চিহ্নিত করে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা এবং পাচার হওয়া অর্থ আইনী ও নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফেরত আনতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

Comments

The Daily Star  | English
eid-ul-azha emergency cases at pongu hospital

An Eid evening at Pongu Hospital: overflowing emergency, lingering waits

The hospital, formally known as NITOR, is a 1,000-bed tertiary medical facility that receives referral patients from all over the country

2h ago