জ্যোৎস্না বেগমের আয় ৩০ বছরেও বাড়েনি, বেড়েছে ঋণ

জ্যোৎস্না বেগম। ছবি: শাহীন মোল্লা/স্টার

রংপুরের পীরগাছা থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে জীবিকার সন্ধানে রাজধানী ঢাকায় আসেন জ্যোৎস্না বেগম (৫৭)। গৃহকর্মী হিসেবে কাজও পেয়েছিলেন পশ্চিম কারওয়ান বাজারের একটি বাসায়। কাজের বিনিময়ে ওই বাসায় থাকা-খাওয়ার পাশাপাশি মাসে পেতেন মাত্র ২০০ টাকা।

স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করায় ৫ বছরের ছেলেকেও নিয়ে আসেন ঢাকায়। এভাবে চলতে চলতে ছেলে বিল্লাল হোসেন বড় হয়ে যায়। কিন্তু, জ্যোৎস্না বেগমের অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি হয় না।

এক পর্যায়ে ছেলে বিল্লাল কারওয়ান বাজারে আখের রস ভাঙানোর কাজ নেন। দিনে ৫০০ টাকার মতো রোজগার হতো তার। দৈনিক খরচ শেষে ৩৫০ টাকা জমাতে পারতেন।

প্রায় ১৫ বছর আগে ছেলের বিয়ে দেন জ্যোৎস্না বেগম। তখন তিনি গৃহকর্মীর কাজ ছেড়ে দিয়ে কারওয়ান বাজার থেকে সবজি নিয়ে বিক্রি করতে শুরু করেন।

বিল্লাল (৩৫) এখন ৩ মেয়ের বাবা। ছেলে বিল্লাল, ছেলের স্ত্রী আজমেরী বেগম ও ৩ নাতনিকে নিয়ে কারওয়ান বাজারে একটি বাসায় ১২ হাজার টাকায় ভাড়া থাকেন মা জ্যোৎস্না বেগম।

দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তিনি ও ছেলে বিল্লাল ২ জন মিলে এখন মাসে সব মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার টাকা আয় করেন।

সম্প্রতি, সরেজমিনে ওই বাসায় গিয়ে দেখা যায়—এক রুমের বাসায় আরও ৬ পুরুষ থাকেন। বিল্লাল তাদের ভাড়া দিয়েছেন। তারা ব্যাংকে বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী। তাদের খাওয়া ও ঘুমানো ওই এক রুমেই।

জ্যোৎস্না জানান, ওই ৬ জন মাসে প্রত্যেকে ৪ হাজার টাকা দেন। এই ২৪ হাজার টাকার মধ্যে ১২ হাজার টাকা দিয়ে বাসা ভাড়া দিতে হয়।

বিল্লালের স্ত্রী আজমেরী সারাদিন রান্না ও ঘরের অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকেন। তার ১১ ও ১২ বছর বয়সী ২ মেয়ে তাকে সাহায্য করে।

তিনি জানান, মাসে বাসায় ১২ জনের জন্য কমপক্ষে ১০০ কেজি চাল লাগে, যার মূল্য ৬০ টাকা করে হলেও ৬ হাজার টাকা। অন্যান্য তরকারি ও সবজির জন্য দিনে অন্তত ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা খরচ হয়।

এ দিকে দ্রব্যমূল্যও বাড়ছে প্রতিদিন।

জ্যোৎস্না বলেন, 'সংসারের অন্যান্য খরচ মেটানোর জন্য প্রায় প্রতি মাসেই ঋণ করতে হয়। করোনার সময় বিল্লালের বেশ কিছুদিন কাজ ছিল না। সে সময় একটা বড় অংকের টাকা ঋণ করতে হয়েছিল। প্রতি মাসেই বাড়ছে ঋণের বোঝা।'

বর্তমানে সব মিলিয়ে তাদের প্রায় আড়াই লাখ টাকা ঋণ। কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্রঋণ ও মাল্টি পারপাস সংস্থা থেকে তারা এসব ঋণ নিয়েছেন বলে জানান জ্যোৎস্না।

বিল্লালের স্ত্রী আজমেরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঢাকায় শুধু মেয়েদের মানুষ করতে থাকছি। তাদের পড়াশোনা করানোর জন্যই ঢাকায় আছি। গ্রামে কোনো কাজ নেই, আয় নেই। তাই শহরে আছি। টঙ্গীতে গিয়ে একসময় গার্মেন্টসে কাজের চেষ্টা করেছি। তাতেও ভালো আয় হতো না।'

কিন্তু, ওই এক রুমের বাসায় বাইরের মানুষের সঙ্গে মেয়েদের নিয়ে থাকার বিষয়ে কিছুটা অস্বস্তি প্রকাশ করেন তিনি। জানান, সারাদিন এত রান্না ও ঘরের সব কাজ করার পর ক্লান্ত হলেও, ওই ৬ জন না ঘুমানো পর্যন্ত তিনি ঘুমাতে যেতে পারেন না।

'গ্রামে খাবার নাই, চিকিৎসা নাই। কিন্তু, শহরে সম্মান নাই,' যোগ করেন তিনি।

ওই ঘরে ৩টি চৌকি আছে। ২টিতে ওই ৬ জন ঘুমান। ১টিতে স্ত্রী ও ছোট মেয়েকে নিয়ে বিল্লাল ঘুমান। আর জ্যোৎস্না বড় ২ নাতনিকে নিয়ে নিচে বিছানা করে থাকেন।

জ্যোৎস্না বেগম বলেন, 'আমার ছেলে একটু সহজ-সরল। তাই তার রোজগার বাড়ে না। তাই এভাবেই কষ্ট করে কোনোরকম টিকে আছি। একই ঘরে বাইরের মানুষ থাকে। ছেলের বৌয়ের অস্বস্তি হয় বুঝি। কিন্তু, কী করব। তাদের দেওয়া টাকার ওপর আমাদের চলতে হয়। নাতনিরাও বড় হচ্ছে। জানি না ভবিষ্যতে কী আছে।'

এ দিকে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের গড় বার্ষিক মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ৭ ডলার ধরা হয়েছে বলে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত ৯ জুন জাতীয় সংসদে বাজেট বক্তৃতায় জানিয়েছেন।

চলতি অর্থবছরে বার্ষিক মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৮২৪ ডলার। ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ৫৪৩ ডলার।

জ্যোৎস্না বেগম বলেন, 'শুনি দেশে নাকি মানুষের আয় বাড়তেছে। আমার আয় ৩০ বছরেও বাড়তে দেখি নাই। শুধু ঋণের বোঝাই বাড়ে।'

Comments

The Daily Star  | English
tax collection target for IMF loan

Talks with IMF: Consensus likely on exchange rate, revenue issues

The fourth tranche of the instalment was deferred due to disagreements and now talks are going on to release two tranches at once.

11h ago