ঘরের ভেতর অদৃশ্য খুনি

২০১৯ সালে প্রায় ৯৫ হাজার মৃত্যুর কারণ ঘরের বায়ু দূষণ

সবচেয়ে নিরাপদ মনে করা হয় নিজের ঘরকে। অথচ, সেখানেও আপনি ঝুঁকিতে রয়েছেন, বিষাক্ত বাতাসের ঝুঁকিতে।

বাংলাদেশের বায়ুমানের অবস্থা প্রায়শই বিশ্বব্যাপী সংবাদ শিরোনাম হয়। তবে সরকারি নজরদারি না থাকায় ঘরের ভেতরের বায়ুমান থেকে যায় অন্তরালে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, দেশে বছরে ১ লাখ ১৩ হাজার ২০২ জন মানুষ মারা যান শুধু ঘরের বায়ু দূষণের কারণে।

বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ, আমরা বায়ু দূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি ঘরের ভেতরে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সির মতে, ঘরের বায়ু দূষণের মাত্রা বাইরের তুলনায় ২ থেকে ৫ গুণ পর্যন্ত বেশি হতে পারে।

যুক্তরাজ্যের সারে বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে 'বিশ্বের ১২টি শহরে রান্না ঘরে এরোসল বৃত্তান্ত' শিরোনামে একটি যৌথ গবেষণার সম্প্রতি প্রতিবেদনে ঢাকায় ঘরোয়া বায়ুর গুণমান সবচেয়ে খারাপ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

বাংলাদেশের রাজধানীতে পার্টিকুলেট ম্যাটার (পিএম) ২.৫ এর গড় ঘনত্ব প্রতি ঘনমিটারে ১৮৬ মাইক্রোগ্রাম রেকর্ড করা হয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ভারতের চেন্নাই শহরে এই মাত্রা ১৬ মাইক্রোগ্রাম।

পিএম ২.৫ ফুসফুসের ক্ষতিকারক ক্ষুদ্র কণা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পিএম ২.৫ এর নিরাপদ মাত্রা হচ্ছে প্রতি ঘনমিটারে ১৫ মাইক্রোগ্রাম। এই মাত্রাটি ঘরের বাইরের বাতাসের জন্য। তবে, ঘরের ভেতরের জন্য কোনো মাত্রা এখনো নির্ধারণ করা হয়নি।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নয়াদিল্লিতে ঘরের বাতাসে পিএম ২.৫ এর মাত্রা নিকটতম বাইরের বাতাসের চেয়ে 'যথেষ্ট বেশি' পাওয়া গেছে।

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দূষিত বায়ুর শহরের শীর্ষ স্থান নিয়ে প্রতিযোগিতা হয় ঢাকা ও নয়দিল্লির মধ্যে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘরের বাতাসের গুণমান স্বাস্থ্যের ওপর বেশি প্রভাব ফেলে। কেননা, মানুষ দিনের বেশিরভাগ সময় বাড়িতে থাকে।

অপর একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, বায়ু দূষণের কারণে মানুষের গড়ে আয়ু কমছে ২ দশমিক ৯১ বছর। এর মধ্যে বাইরের দূষণে ১ দশমিক ১৬ বছর এবং ঘরের দূষণে ১ দশমিক ৫৩ বছর আয়ু কমছে।

মার্কিন সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন 'স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার ২০২০: বায়ু দূষণ কিভাবে গড় আয়ুতে প্রভাব ফেলছে' শীর্ষক গবেষণাটি পরিচালনা করেছে।

এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৭৫ শতাংশেরও বেশি পরিবার এখনো রান্নার জন্য কাঠ বা এই জাতীয় জ্বালানি ব্যবহার করে। এর ফলে ঘরের বায়ু দূষণে শুধুমাত্র ২০১৯ সালেই ৯৪ হাজার ৮০০ জনেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন।

এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুর ১২ শতাংশই ঘরের বায়ু দূষণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

'অত্যন্ত বিপজ্জনক'

'বিশ্বের ১২টি শহরে রান্না ঘরে এরোসল বৃত্তান্ত' গবেষণার একজন সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আব্দুস সালাম জানান, ঘরের বায়ুমানের একটি চিত্র পাওয়ার জন্যই গবেষণাটি করা হয়েছে।

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'ঘরের বায়ু দূষণ বাইরের দূষণের চেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়। সাধারণত মনে করা হয়, ঘরের ভেতরে আমরা নিরাপদ। তবে আমরা দেখেছি, শহর অঞ্চলে ছোট্ট রান্না ঘরে দুর্বল বায়ু চলাচল ব্যবস্থার কারণে সেটি স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।'

তিনি জানান, গবেষণা দলটি দেখেছে যে রান্নার সময় পিএম ২.৫ এর মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে এক হাজার ৫০০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে যায় এবং এটি 'অত্যন্ত বিপজ্জনক'।

এপ্রিলে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে ঢাকায় পিএম ২.৫ এর ঘনত্ব বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে উঠে এসেছে ছোট ছোট রান্নাঘর, ভাজাপোড়া বেশি হওয়া এবং দীর্ঘ সময় ধরে রান্না করা।

যে ১২টি শহরে এই গবেষণা চালানো হয়েছে সেগুলো হচ্ছে—ঢাকা, চেন্নাই, নানজিং, মেডেলিন, সাও পাওলো, কায়রো, সুলাইমানিয়া, আদ্দিস আবাবা, আকুরে, ব্ল্যান্টিয়ার, দারুস সালাম এবং নাইরোবি।

প্রতিটি শহরে ৫টি নিম্ন আয়ের পরিবারের রান্নাঘরে এক সপ্তাহ নিরবচ্ছিন্ন বায়ুমান পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকারের একটি স্বাধীন নির্বাহী সংস্থা ইপিএর তথ্য অনুযায়ী, ঘরের বায়ু দূষণের উত্সগুলোর মধ্যে কাঠ-কয়লা সরঞ্জাম, তামাক সেবন, গৃহস্থালি পরিষ্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ পণ্য এবং রুম গরম বা ঠাণ্ডা করার যন্ত্র অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

কিছু উত্স, যেমন ভবনের উপকরণ, আসবাবপত্র ও এয়ার ফ্রেশনারের মতো পণ্যগুলোও দূষণের বড় কারণ হতে পারে।

এ ছাড়াও, ঘরের বায়ু দূষণের জন্য দায়ী হচ্ছে—ধূমপান, পরিষ্কার করার সরঞ্জামসহ বিভিন্ন শৌখিন কার্যক্রম।

রান্নাঘরে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল ব্যবস্থা রাখার পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যাপক সালাম। তিনি জানান, এক্সজস্ট ফ্যানের মতো যান্ত্রিক বায়ু চলাচল ব্যবস্থাও রান্নার কারণে যে ক্ষতি নারী ও শিশুদের হয় তা থেকে রক্ষা করতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের হেলথ ইফেক্টস ইন্সটিটিউটের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী পল্লবী প্যান্ট দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঘরের বায়ু দূষণের কারণে হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, নিউমোনিয়া, স্ট্রোক, টাইপ ২ ডায়াবেটিসসহ বেশি কিছু রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এমনকি এর কারণে চোখে ছানি পড়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।'

তিনি বলেন, নারী ও শিশুরাই ঘরের বায়ু দূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন।

পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল মোতালিব জানান, দেশে ঘড়োয়া বায়ুমানের পরিস্থিতি ঠিক কী অবস্থায় রয়েছে তা তারা বলতে পারছেন না। কারণ এ বিষয়ে তারা কোনো নজরদারি করেননি।

তিনি বলেন, 'এ বিষয়ে মন্তব্য করার জন্য সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রয়োজন, যা আমাদের কাছে নেই।'

Comments

The Daily Star  | English
US airstrike on Iran

Strikes on Iran mark Trump's biggest, and riskiest, foreign policy gamble

The dramatic US strike, including the targeting of Iran’s most heavily fortified nuclear installation deep underground, marks the biggest foreign policy gamble of Trump’s two presidencies and one fraught with risks and unknowns.

1h ago