যানজট মানেই উন্নয়ন?

এক অদ্ভুত মন্তব্য করেছেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম। বলেছেন, '২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে। তাই সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ি বেড়েছে। আওয়ামী লীগ আরেক মেয়াদে ক্ষমতায় এলে উপজেলা পর্যায়েও যানজট হবে।'

৬ এপ্রিল জাতীয় সংসদে রাজধানীর যানজট নিয়ে বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদের সমালোচনার জবাবে মন্ত্রী এই মন্তব্য করেন। মন্ত্রীর এই মন্তব্যে এটা স্পষ্ট, তিনি ট্রাফিক জ্যাম যা যানজটকে উন্নয়নের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করছেন।

অথচ সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশের উন্নয়নের সঙ্গে রাজধানীর রাস্তার বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি 'বেমানান'। বছর কয়েক আগে তিনি রাজধানীর যানজটকে 'জাতীয় দুর্ভোগ' বলেও মন্তব্য করেছিলেন। এই দুর্ভোগ নিরসনে সাবওয়ে (পাতাল রেল) নির্মাণের বিকল্প নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেন। একই বিষয়ে সরকারের ২ জন নীতিনির্ধারকের এমন বিপরীতমুখী মন্তব্য কী প্রমাণ করে?

পকেটে পয়সা থাকলেই ব্যক্তিগত গাড়ি কেনা যাবে, এটি কোনো নীতি হতে পারে না। বরং ব্যক্তিগত গাড়ির লাগাম টেনে ধরাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব। যদিও রাষ্ট্র সেটি মনে করে না। রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা মনেই করেন, বেশি বেশি গাড়ি বিক্রি মানে ব্যবসা ভালো। বেশি বেশি গাড়ি বিক্রি মানে গাড়ির ক্রেতা আছে। বেশি বেশি গাড়ির ক্রেতা আছে মানে পয়সাওয়ালা মানুষের অভাব নেই। পয়সাওয়ালা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে মানে দেশ ধনী হয়ে যাচ্ছে। অতএব তাদের কাছে রাজধানীর রাস্তায় যানজট কোনো দুর্ভোগ নয়, বরং উচ্ছ্বাসের ব্যাপার এবং তারা মনেই করেন যে উপজেলা পর্যায়েও যদি গাড়ির এমন চাপে যানজট হয়, তাহলে সেটিও হবে বড়ই আনন্দের বিষয়।

এমন অদ্ভুত উন্নয়ন ধারণা পৃথিবীর যেকোনো দেশেই বিরল। কেননা, উন্নয়নের একটি বড় শর্ত হলো, এটি অনন্তকাল চলতে পারে না। উন্নয়নকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। পকেটে পয়সা থাকলেই কেউ ৫টা গাড়ি কিনবেন, তার পরিবারের ৫ জন ৫টি গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নেমে যাবেন এবং বাকি ৯৫ জনের জন্য দুর্ভোগ তৈরি করবেন; যন্ত্রণাদায়ক যানজটের সৃষ্টি করবেন—এটি কোনো উন্নয়নের সূচক হতে পারে না।

বরং, এর নাম উন্নয়ন বিড়ম্বনা বা উন্নয়ন বিপত্তি। বরং ১০০ মানুষের জন্য পর্যাপ্ত পাবলিক বাস এবং স্বল্প দূরত্বে হাঁটার জন্য প্রশস্ত ফুটপাত তৈরি করে সেখানে জনচলাচল নির্বিঘ্ন রাখার নামই যে উন্নয়ন—সেই ধারণা থেকে আমরা বিস্তর দূরে।

আমাদের কাছে উন্নয়ন মানে রাস্তায় নিত্য নতুন বিলাসবহুল গাড়ি। প্রশ্ন হলো, এই গাড়িতে কারা চড়েন? কতজন চড়েন? রাষ্ট্রটা কি শুধু এই বিলাসবহুল গাড়িওয়ালাদের? হয়তো তা-ই। কারণ রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা এই বিলাসবহুল গাড়ির মালিক কিংবা তাদেরই প্রতিনিধি। যে কারণে তাদের কাছে উন্নয়নের যে সংজ্ঞা, সাধারণ মানুষ বা শিক্ষাবিদদের ধারণার সঙ্গে তার ব্যবধান ঢের।

তবে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী যেভাবে ঢাকার যানজটকে উন্নয়নের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করছেন, তাতে উন্নয়নের ধারণা বা সংজ্ঞা নতুন করে নির্ধারণ করতে হবে কি না—নাগরিকের মনে সেই প্রশ্নও উঠতে পারে। কেননা, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় 'উন্নয়ন' শব্দটির এমন সব বিচিত্র ব্যবহার হয়েছে যে, খোদ অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন গবেষকরাও বিভ্রান্ত হচ্ছেন।

বছর কয়েক আগে বেশ জোরেশোরে শোনা যাচ্ছিলো, গ্রামগুলো শহর হয়ে যাবে। অথচ আইডিয়াটা ছিল শহরের সুবিধাসমূহ গ্রামে নেওয়া। নীতিনির্ধারকদের অনেকে বিষয়টিকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যে তাতে মনে হয়েছে, গ্রামও শহর হয়ে যাবে। অথচ বাংলাদেশ মানে যেমন নদীমাতৃক, তেমনি বাংলাদেশ মানেই গ্রামবাংলা। শহরে বা নগরে এসে বাংলাদেশকে পাওয়া যায় না। বরং শহর ও নগরে এসে বাংলাদেশ নিহত হয়।

বস্তুত গ্রামকে গ্রামের মতো থাকতে দিলে সেখানে শহরের সুবিধা না পৌঁছালেও মানুষের অসুবিধা হওয়ার কথা না। বরং গ্রামকে শহর করা বা কথিত উন্নয়ন ও শিল্পায়নের করাতে গ্রামাঞ্চলের মাইলের পর মাইল ফসলি জমি হত্যা করা হয়। ধানের জমিতে মেশিনের আওয়াজকে বছরের পর বছর ধরে উন্নয়ন হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। নদী হত্যা করে সেখানে রিভারভিউ প্রকল্প, সবুজ বন ধ্বংস করে ৫ তারকা হোটেল কিংবা অন্য কোনো কংক্রিটের জঙ্গল এবং এভাবেই অর্থনীতির সূচক ও মাথাপিছু আয়ের গল্প শোনানো হয়।

অথচ নদীকে তার মতো বইতে দেওয়া, সবুজ বনকে তার মতো থাকতে দেওয়া এবং ফসলের জমিতে কোনো ধরনের অবকাঠামো গড়ে না তুলে সেখানে অক্সিজেনের কারখানা নির্বিঘ্নে চলতে দেওয়ার নামই যে উন্নয়ন—সেই উন্নয়ন ধারণা থেকে আমরা অনেক দূরে সরে গেছি। সরে গেছি বলেই এখন নীতি-নির্ধারকদের কাছে রাস্তায় লাখো গাড়ি এবং সেই গাড়ির জট লেগে যাওয়াই উন্নয়নের সূচক; দৃশ্যমান অবকাঠামো, বিদ্যুতের ঝলকানি আর গহীন গ্রামেও রাত জেগে ক্যাবল টিভিতে বিদেশি চ্যানেলে সিরিয়াল দেখাই উন্নয়ন; গ্রামকে শহর বানিয়ে ফেলাই উন্নয়ন।

উন্নয়ন ধারণার এই বিচ্যুতির পেছনে নানাবিধ কারণ রয়েছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ, কোনো রাষ্ট্রে যখন ব্যবসায়ী ও ঠিকাদাররাই নীতিনির্ধারকের আসনে বসে যান, তখন তাদের কাছে উন্নয়ন মানেই প্রকল্প। কেননা প্রকল্প মানেই কেনাকাটা। কেনাকাটা মানেই চুরি, লুটপাট। প্রকল্প না হলে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটায় একটি পর্দার দাম ৩৭ লাখ, বালিশের দাম ৬ হাজার টাকা, মোবাইল চার্জারের দাম ২৩ হাজার টাকা, ২০ টাকার হ্যান্ড গ্লাভসের দাম ৩৫ হাজার টাকা, ১৫ টাকার টেস্ট টিউবের দাম ৫৬ হাজার টাকা, মাল্টিপ্লাগের দাম ৬ হাজার টাকা, ৫০০ টাকার রেক্সিনের দাম ৮৪ হাজার টাকা, রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানায় লোহা বা স্টিলের এক কেজি নাটের দাম ১ কোটি টাকা, আধা কেজি ওজনের একটি লোহার স্প্রিংয়ের দাম ১৬ লাখ টাকা হয় না।

উন্নয়ন প্রকল্প না হলে খোলা মাঠে পুকুর কাটা এবং সেই পুকুর ভরাট করার জন্য ২ দফায় বাজেট পাশ করা যায় না। যদিও ২ দফায় বাজেট উত্তোলনের পরেও সেই মাঠ শূন্যই পড়ে থাকে। বুলেট ট্রেন চলবে কি না, তা যাচাই করতেই ১১০ কোটি টাকা খরচ হয়ে যায়। সুতরাং শূন্য মাঠে পুকুর কাটা ও ভরাট করা, বুলেট ট্রেনের সম্ভাব্যতা যাচাই করতেই শত কোটি টাকা খরচ কিংবা কোটি টাকা কেজির লোহার ভেতরে যে উন্নয়ন দর্শন—সেটি আর যাই হোক জনগণের কোনো উপকারে আসে না। বরং জনগণের অর্থের শ্রাদ্ধ হয় এবং এর জন্য কাউকে কোনো ধরনের জবাবদিহির মধ্যে আসতে হয় না। মানুষ কষ্ট করে উপার্জন করে সেই উপার্জনের অর্থ থেকে ট্যাক্স দেবে এবং নীতিনির্ধারক, ঠিকাদার ও রাজনৈতিক মাস্তানরা মিলে সেই টাকা ভাগবাটোয়ারা করে কানাডায় বেগমপাড়া, যুক্তরাষ্ট্রে সাহেবপাড়া, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম কিংবা অন্য কোথাও থার্ড হোম গড়ে তুলবেন। তাদের সন্তানরা এই দেশে থাকবেন না, তারা বিদেশে পড়েন, বিদেশের নাগরিক হন। অবস্থা বেগতিক দেখলে তারাও প্লেনের টিকিট কেটে বেগমপাড়ায় চলে যাবেন। ঢাকার সঙ্গে কানাডার সরাসরি ফ্লাইট চালুরও প্রচেষ্টা চলছে।

বস্তুত সরকারি কেনাকাটার পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতরা সবাই (খুব ব্যতিক্রম বাদে) দুর্নীতিগ্রস্ত। যে কারণে এই খাতে দুর্নীতি বন্ধ করা যায় না। ১০০ টাকার লোহার দাম যে এক কোটি টাকা ধরা হলো, সেই এক কোটির ভাগ নানাজনের মধ্যেই বণ্টন হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের এই কেনাকাটা এবং নানাবিধ অবকাঠামো উন্নয়নের নামে হাজার কোটি টাকা লুটপাটের অর্থ যে রাষ্ট্রের কোন পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে যায়, তা হয়তো আমাদের কল্পনায়ও নেই।

অবস্থা এমন হয়েছে যে, সরকারি কেনাকাটার প্রক্রিয়ায় সৎ মানুষ যুক্ত থাকলে হয় তাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ দুর্নীতিবাজের চাপে চুপ থাকতে হয় অথবা তাকে অন্য কোথাও বদলি হয়ে যেতে হয়। তিনি সংখ্যালঘুতে পরিণত হন। উপরন্তু দুর্নীতির সঙ্গে যেহেতু রাষ্ট্রের প্রভাবশালী মহল তথা নীতিনির্ধারকদের বিরাট অংশই যুক্ত থাকেন, ফলে কারো শাস্তি হয় না। তাদের নানাবিধ দায়মুক্তির ব্যবস্থা রয়েছে। অর্থাৎ সবাই মিলেই যেহেতু কাজটা করেন, ফলে কালেভদ্রে পর্দা-বালিশ কিংবা লোহার মতো দু-একটি ঘটনা সাংবাদিকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এলেও আড়ালে পড়ে থাকে অধিকাংশ দুর্নীতি ও লুটপাটের গল্প।

দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল সর্বশেষ যে দুর্নীতির ধারণা সূচক প্রকাশ করেছে, সেখানে বিশ্বে সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের ক্রমে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩ নম্বরে। যদিও দেশের দুর্নীতি বোঝার জন্য টিআইয়ের এই সূচক না হলেও চলে। সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত নিজেদের জীবন দিয়ে এটি টের পায়।

সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে একজন সাধারণ মানুষ যেকোনো সেবার জন্য গেলেই সে টের পায় দেশে দুর্নীতির শেকড় কত গভীরে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে জনমনে এই ধারণাও দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে যে, উন্নয়ন হলে দুর্নীতি হবেই। কারণ দুর্নীতি হলেও মানুষ উন্নয়নের সুবিধা পাচ্ছে। যেমন বড় বড় রাস্তা হচ্ছে, সেতু হচ্ছে, ফ্লাইওভার হচ্ছে এবং এর মধ্য দিয়ে মানুষের যোগাযোগ সহজ হচ্ছে। অতএব দুর্নীতি মেনে নিতে হবে। বিষয়টা এমন যে, আমি তোমাকে ভাত-কাপড় দিচ্ছি, অতএব ধর্ষণ মেনে নিতে হবে।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

How frequent policy shifts deter firms from going public

If a company gets listed, it will enjoy tax benefits, and this is one of the major incentives for them to go public..However, the government’s frequent policy changes have disheartened listed firms many times, as they faced higher tax rates once they got listed..It gave a clear, nega

1h ago