পেনশন ও কোটাবিরোধী আন্দোলন: শিক্ষক-শিক্ষার্থী কেউ কারও নয়

স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

সর্বজনীন পেনশনের 'প্রত্যয়' কর্মসূচি বাস্তবায়নের বিরোধিতা করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা।

আজ রোববার সপ্তম দিনের মতো ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন চলছে, দুপুর ১২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে এক ঘণ্টা অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে শিক্ষক সমিতি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের মূল ফটকে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সংবাদ সম্মেলন। ছবি: স্টার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আগে ৩৫ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল, এখন ৩৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এ আন্দোলনে সংহতি জানিয়েছেন। আন্দোলন সর্বাত্মকভাবে চলছে, আরও বেগবান হচ্ছে, আরও গতিশীল হচ্ছে।'

সাধারণত শিক্ষকদের আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের প্রত্যক্ষ সমর্থন, ছাত্র সংগঠনগুলোর বিবৃতি দেখা গেলেও এই আন্দোলন নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি।

সাত দিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি, প্রশাসনিক কার্যক্রম ও ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনো ছাত্র সংগঠন শিক্ষকদের দাবির পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো বক্তব্য দেয়নি। অন্যদিকে, কোটা বাতিলের দাবিতে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন নিয়েও কোনো বক্তব্য নেই শিক্ষকদের।

সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন' এর অন্যতম সমন্বয়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাহিদ ইসলাম বলেন, 'গত ১ জুলাই আমরা শিক্ষকদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা জানিয়েছি। শিক্ষকদের প্রতি আমরা আহ্বান করেছিলাম কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ও সায়েন্স লাইব্রেরি সংস্কারের জন্য। কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করে আমরা এই দাবি জানাই। কিন্তু আমাদের দাবির বিষয়ে তারা কিছু জানাননি। পরে আমরাও আমাদের দাবিতেই ফোকাসড থেকেছি।'

কোটা বাতিল আন্দোলনে শিক্ষকদের সমর্থন আহ্বান করে তিনি বলেন, '২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষক সমিতি নৈতিক সমর্থন জানিয়েছিল। আমরা চাই, এবারও শিক্ষকরা সমর্থন করুক। তারা তাদের আন্দোলন নিয়ে ব্যস্ত এজন্য হয়তো আসতে পারছেন না। আমাদের জায়গা থেকে আমরা তাদেরকে সমর্থন জানিয়েছি কিন্তু তাদের সমর্থন এখনো পাইনি।'

এ বিষয়ে ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মেঘমল্লার বসু বলেন, 'শিক্ষকদের দাবি ও আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। দাবিগুলো যৌক্তিক কিন্তু শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষকদের পক্ষে দাঁড়ানোর আগ্রহ আমি দেখিনি।'

এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, 'শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যে ধরনের ভূমিকা নিয়েছেন, নির্বাচনের আগে শিক্ষকরা একরকম নামে-বেনামে আওয়ামী লীগের প্রচারণা করছেন এর ফলে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে। ছাত্ররা বিভিন্ন সময় তাদের অধিকার নিয়ে, একই ধরনের দাবি নিয়ে যখন আন্দোলন করেছে তখন তাদেরকে ক্লাসে পাঠানোর জন্য শিক্ষকরা চাপ তৈরি করেছেন। ফলে তাদের আন্দোলন নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহ নেই।'

কোটা বাতিল আন্দোলনের প্রসঙ্গ ধরে তিনি বলেন, 'শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কোনো বক্তব্য নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যখন শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ান না তখন আসলে শিক্ষার্থীদেরও শিক্ষকদের পাশে দাঁড়ানোর কোনো দায় থাকে না।'

কোটা বাতিল আন্দোলনে ছাত্রলীগের সর্মথন আছে বলে জানিয়েছেন ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত।

তিনি বলেন, 'ছাত্ররা যে আন্দোলন করছে এটা সরকারের পক্ষে। সরকারের ভাতৃপ্রতীম সংগঠন হয়ে আমরা কেন এটার বিরোধিতা করতে যাব? ছাত্রলীগের শিক্ষার্থীরাও তো সরকারি চাকরি পরীক্ষা দেবে। আমরা কর্মীদের বলেছি এটিতে আমাদের বাধা নাই, মানে যার যার ইচ্ছা। আইনি প্রক্রিয়ায় সরকার অলরেডি লড়ছে। সেক্ষেত্রে কারো মন চাইলে আন্দোলন করতেও পারে, নাও পারে।'

তবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে কেউ যেন ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে না পারে এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক।

তিনি বলেন, 'আমার মনে হয় এই আন্দোলনে কিছু অপশক্তি ভর করছে তারা বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে আন্দোলনটাকে সরকার বনাম সাধারণ শিক্ষার্থী করতে চাচ্ছে, এটিকে সাধারণ শিক্ষার্থী বনাম ছাত্রলীগ আন্দোলন করার একটা পায়তারা চলছে। এটা একটা ষড়যন্ত্র।'

শিক্ষকদের আন্দোলন সম্পর্কে মন্তব্য জানতে চাইলে এই ছাত্রলীগ নেতা বলেন, 'শিক্ষকদের যে দাবিগুলো আমার মনে হয় পেনশন সর্বজনীন স্কিমে তাদেরকে আরেকটু বেশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া উচিত। তবে শিক্ষকরাও আন্দোলনের ক্ষেত্রে কিছুটা সংযত হতে পারতেন। অন্তত ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন না করে আরও কিছুটা সংযত হয়েও আন্দোলন করতে পারতেন। এ ব্যাপারে আমার আর বেশি কিছু বলার নেই।'

এদিকে 'প্রত্যয়' পেনশন স্কিম বাতিলের দাবি জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কও।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তানজিম উদ্দিন খানের মতে, শিক্ষকদের আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের নিষ্ক্রিয় থাকার কারণ হলো 'ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যকার দূরত্ব'।

তিনি বলেন, '২০০৭-০৮ সালে যখন শিক্ষকরা গ্রেপ্তার হন তখন শিক্ষার্থীরা যেভাবে শিক্ষকদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, এরপরে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কটা অন্য পর্যায়ে থাকার কথা ছিল। বিশেষ করে শিক্ষকরা যখন আটক হয় তখন আন্দোলনের পুরোভাগেই শিক্ষার্থীরা ছিল। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক আরও পজেটিভ হওয়ার কথা ছিল।'

শিক্ষক সমিতি সাধারণ শিক্ষকদের স্বার্থ রক্ষায় তেমন কাজ করেন না। শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে শিক্ষকদের যেমন ভূমিকা রাখার কথা ছিল সেটা হয়নি। এ কারণে শিক্ষকদের আন্দোলন শিক্ষার্থীদের মধ্যে আবেদন তৈরি করতে পারছে না বলে মনে করেন অধ্যাপক তানজিম।

তিনি বলেন, 'শিক্ষক সমিতি সাধারণ শিক্ষকদেরই স্বার্থ রক্ষায় খুব কম কাজ করে। যারা শিক্ষক সমিতির নেতা নির্বাচিত হন তাদের অনেকেই দেখা যায় হলের বা প্রশাসনের দায়িত্বে আছেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামো মোটেই শিক্ষার্থীবান্ধব না। বিশেষ করে আবাসিক হলগুলো যেভাবে পরিচালনা হয়, হলের রিডিং রুম, থাকার ব্যবস্থা একেবারেই শিক্ষার্থীদের উপযোগী না। শিক্ষার্থীদের স্বার্থটাকে শিক্ষকদের আরও বেশি বিবেচনায় নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এটা হয়নি। যার জন্য শিক্ষার্থীদেরও শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দদের প্রতি খুব একটা আস্থা নেই। শিক্ষকদের এই আন্দোলন যেরকম আবেদন তৈরি করার কথা ছিল তেমন আবেদন তৈরি করতে পারছে না।'

কোটা বাতিলের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রায় এক ঘণ্টা শাহবাগ মোড় অবরোধ করে রাখেন। ছবি: স্টার

'কোটা সংস্কার নিয়ে নতুন করে আন্দোলন তৈরি হয়েছে। ছাত্রদের স্বার্থটা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এই আন্দোলনের ব্যাপারে শিক্ষক সংগঠনগুলো এখনো তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেনি,' বলেন তিনি।

শিক্ষকদের আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততা চান না বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা।

তিনি বলেন, 'আমাদের আন্দোলনে কোনো শিক্ষার্থী সম্পৃক্ত হোক এটি আমরা চাইনি, কাউকে জানানোর কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে বলেও মনে করি না। এটা পুরোপুরি শিক্ষকদের আন্দোলন, শিক্ষকরাই এই আন্দোলন করবে। এটার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। শুধু শিক্ষকদের নিয়েই আমরা এই আন্দোলন করছি।'

ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে কোনো অগ্রগতি আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ' আমাদেরকে এখনো এ বিষয়ে আর কিছু জানানো হয়নি।'

কোটা বাতিলের আন্দোলন সম্পর্কে জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বলেন, 'শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে আমাদের কোনো মন্তব্য নাই। যে যার মতো করে আন্দোলন করুক। আমাদের দাবি নিয়ে আমরা ব্যস্ত আছি।'

 

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

6h ago