‘তথাকথিত গণতন্ত্রের মোড়কে এখানে একটা স্বৈরাচারী ভূত রয়েছে’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনার জন্য নির্ধারিত মিলনায়তন ব্যবহারের অনুমতি বাতিলের পর তাৎক্ষণিক এক প্রতিবাদ সভায় অংশ নেওয়া ক্ষুব্ধ শিক্ষকরা বলেছেন, এমন আচরণ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিয়াত্তরের অধ্যাদেশের পরিপন্থী। এর মাধ্যমে মত প্রকাশের অধি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে তাৎক্ষণিকভাবে আয়োজিত প্রতিবাদ সভা। ছবি: মামুনুর রশীদ/স্টার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনার জন্য নির্ধারিত মিলনায়তন ব্যবহারের অনুমতি বাতিলের পর তাৎক্ষণিক এক প্রতিবাদ সভায় অংশ নেওয়া ক্ষুব্ধ শিক্ষকরা বলেছেন, এমন আচরণ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিয়াত্তরের অধ্যাদেশের পরিপন্থী। এর মাধ্যমে মত প্রকাশের অধিকারটুকুও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তথাকথিত গণতন্ত্রের যে মোড়ক এখানে আছে, সেই মোড়কের মধ্যে একটা স্বৈরাচারী ভূত রয়েছে; যার প্রকাশ এই ধরনের সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে দেখা যাচ্ছে।

আজ বুধবার দুপুর আড়াইটায় এই আলোচনা সভাটি হওয়ার কথা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচার থিয়েটার ভবনের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে। আয়োজক ছিল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। কিন্তু ২টার দিকে কলা অনুষদের ডিন আয়োজকদের মিলনায়তন ব্যবহারের অনুমতি বাতিলের কথা জানান।

এ ব্যাপারে কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আবদুল বাছির দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে নির্দেশনার কারণে ভেন্যু বাতিল করতে হয়েছে। তিনি বলেন, 'আমরা জানতে পেরেছি যে কর্মসূচিতে সরকারবিরোধী কার্যকলাপ ঘটবে। আমরা তাদের অনুমতি দিতে পারি না।'

অনুমতি বাতিলের প্রতিবাদে তাৎক্ষণিকভাবে সেখান থেকে মুখে-হাতে কালো কাপড় বেঁধে মৌন মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে প্রতিবাদ সভা করেন আয়োজকরা।

প্রতিবাদ সভায় তারা বলেন, তাদের এই আলোচনা সভার সঙ্গে নির্বাচন কিংবা এখনকার সংঘাতময় রাজনীতির কোনো সম্পর্কই নেই। তার পরেও যেভাবে আলোচনার জন্য নির্ধারিত মিলনায়তন ব্যবহারের অনুমতি বাতিল করা হলো, তাতে এই ঘটনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে কলঙ্ক হয়ে থাকবে।

আজ শিক্ষক নেটওয়ার্কের এই আলোচনা সভার শিরোনাম ছিল, 'জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২১: আমরা কেন উদ্বিগ্ন'।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে দেশে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন এই শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। আগামী বছরগুলোতে ধাপে ধাপে সব শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান শুরু হওয়ার কথা। আর এই শিক্ষাক্রমের উল্লেখযোগ্য একটি দিক হলো, এতে আগামী বছর থেকে নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষার মতো আলাদা বিভাগ বিভাজন থাকবে না। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনা-সমালোচনা আছে।

বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ সভার সঞ্চালক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম বলেন, 'যখন সিদ্ধান্তটা গ্রহণ করা হয়েছে, শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হয়েছে সেখানে নাগরিকদের অংশগ্রহণ কোথায়? গতবারের যে শিক্ষাক্রম তার কোনো মূল্যায়ণ এই জাতির কাছে আছে? যে শিক্ষাক্রমটি নতুন করে চালু করা হচ্ছে, তার ব্যাপারে আমাদের কোনো শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, বিশেষজ্ঞ তাদের মতামত নেওয়া হয়েছিল? এর যে ফলাফল আসবে তার জন্য কে দায়ী হবে?

'এগুলো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগের ব্যাপার। সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে আমরা দেখলাম রাষ্ট্র একটা হিংস্র চরিত্র নিয়ে সবার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এমনকি সাধারণ অভিভাবক যারা কিনা তাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা বলতে চেয়েছিল, স্কুলে তাদের বাচ্চাদের কী পড়ানো হবে সেটা নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিল, তাদের ওপরে ভয়ঙ্কর আক্রমণ হলো।'

অধ্যাপক মারুফুল ইসলাম আরও বলেন, 'রাষ্ট্রের এই যে চরিত্র, এটার সঙ্গে আমরা যে সমাজে এখন বসবাস করছি তার সঙ্গে মিল আছে। পুরো রাষ্ট্র একটা জবাবদিহিহীন অবস্থার মধ্যে রয়েছে। এখানে রাষ্ট্রের যারা সিদ্ধান্তপ্রণেতা তাদের সিদ্ধান্তের জন্য তারা আমাদের নাগরিকদের কাছে দায়বন্ধ না। কোনোভাবেই দায়বদ্ধ না। তথাকথিত গণতন্ত্রের যে মোড়ক এখানে আছে, সেই মোড়কের মধ্যে একটা স্বৈরাচারি ভূত রয়েছে। যার প্রকাশ আমরা এই ধরনের সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে দেখতে পারছি।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান বলেন, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বজনের বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের সকল শিক্ষকের জীবনযাপন মানুষের করের টাকায় হয়। যার ফলে প্রজন্ম তৈরির যে রূপরেখা সামনে আনা হয়েছে কিংবা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে সেটার সবল দিক কী, দুর্বল দিক কী সেটা খতিয়ে দেখা আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে? শিক্ষক হিসেবে, গবেষক হিসেবে এটাই আমাদের কাজ। অথচ সেই কাজ থেকেও আমাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। আমাদের মত প্রকাশের অধিকারটুকুও হরণ করা হচ্ছে।'

অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান আরও বলেন, 'আমি মনে করি, আমাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে, জনগণের করের টাকায় জীবনযাপনকারী মানুষ হিসেবে ভবিষ্যত প্রজন্মের রূপরেখা নিয়ে কথা বলা যেমন আমার নাগরিক অধিকার, তেমনি নৈতিক অধিকার। সেই নাগরিক অধিকার ও নৈতিক অধিকারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আমরা এই আয়োজনটা করেছিলাম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, এই আয়োজনটা এখন প্রতিবাদ সভায় পরিণত হয়েছে।

'রাষ্ট্র কোন পরিস্থিতিতে গেলে শিক্ষকদের একটি আলোচনা—যার সঙ্গে নির্বাচন কিংবা এখনকার যে সংঘাতপূর্ণ রাজনীতির কোনো সম্পর্কই নেই, সেটি বন্ধ করতে পারে! এটি যে দলই করুক না কেন, সেটি তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়ত্বের প্রকাশ।'

এর পাশাপাশি এমন একটি সিদ্ধান্তের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সমালোচনা করে তানজীমউদ্দিন খান বলেন,  'নাগরিক হিসেবে শুধুমাত্র আমাদের মতামতটাই তুলে ধরতে চাই মানুষের কাছে। অথচ আমাদের সেই অধিকারটুকুও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। অথচ সামনে আমরা ভোটের কথা বলছি।

'বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিশ্চয় চাপে পড়ে এটা করেছেন, এবং এটা করতে গিয়ে ওনারা যে ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিতে পারতেন, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য তিয়াত্তরের যে অধ্যাদেশ আছে, সেটাকে সামনে রেখে আমাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করতে পারতেন। সেটাও তারা আসলে করতে পারেননি। এটা করতে না পারার মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে, বাংলাদেশের ইতিহাসে একটা কলঙ্কময় অধ্যায়ের সূচনা ঘটল।'

নতুন শিক্ষাক্রমের সমালোচনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন বলেন, 'আমরা অভিভাবক, শিক্ষক এই শিক্ষাক্রমের ভোক্তা। কারণ, বিদ্যালয়ের এই শিক্ষাক্রম পড়ে তারা (শিক্ষার্থী) আমার ছাত্র হবে। আমাদের উদ্বেগ আছে।'

অধ্যাপক মামুন আরও বলেন, 'অসুবিধা ছিল অনেক, আপনারা তো সেদিকে নজর দেননি। এই দেশের শিক্ষায় অনেক সমস্যা। তার মধ্যে শিক্ষাক্রম হলো সর্বশেষ সমস্যা। এটির জন্য কেউ দাবি করেননি। সমস্যা হলো, আপনারা ভালো শিক্ষক নিয়োগ দেননি, শিক্ষায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেননি। সমস্যা হলো, স্কুল-কলেজে দুষ্ট রাজনীতি ঢুকিয়েছেন ব্যবস্থাপনার নামে। প্রতিটি বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার খপ্পরে পড়ে গেছে। ভালো মানের শিক্ষক নিয়োগ দেবেন না, আপনি ভাবছেন, খোলস বদলালে সব ঠিক হয়ে যাবে?'

এই অধ্যাপকের ভাষ্য, 'রাষ্ট্র একটা শিক্ষাক্রম চালু করতে চায়। সেটা নিয়ে আমরা আলোচনা করব। এমন একটা নিরীহ প্রোগ্রামকে যে সরকার, যে প্রশাসন নিতে পারে না তারা দেশের ভালো চায়, দেশের মানুষের মঙ্গল চায় এটা আমি কী করে ভাবব?'

প্রতিবাদ সভায় আরও বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাসির আহমেদ ও সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলনের নেতা রাখাল রাহা।

রাখাল রাহা বলেন, 'কারিকুলাম নিয়ে কথা বলার জন্য, নিজের সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলার জন্য অভিভাবকদের বিরুদ্ধে সরকার মিথ্যা মামলা দিয়েছে, তাদের আটক করেছে, ২৪ ঘণ্টা গুম করে রেখে তাদের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে এরপর তাদের জামিন আবেদন মঞ্জুর না করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।'

আজ মিলনায়ন ব্যবহারের অনুমতি বাতিলের প্রসঙ্গে রাখাল রাহা আরও বলেন, 'শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই না, রাষ্ট্রের প্রতিটি জায়গায়, প্রতিটি কর্নারে এমন ন্যাক্বারজনক ঘটনা ঘটছেই।' তাই বিগত ঐতিহ্য, তিয়াত্তরের অধ্যাদেশ এসবকিছু ফালতু মনে হয়।

অধ্যাপক নাসির আহমেদ প্রশ্ন রাখেন, 'এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমি ছাত্র ছিলাম। শিক্ষকতাও করেছি। এখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি। বুয়েটে পড়িয়েছি। এসব প্রতিষ্ঠানে বেশিরভাগই আসে বাংলা মিডিয়াম থেকে। ইংলিশ মিডিয়াম থেকে খুব কম শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারে। সমস্যাটা তাহলে কোথায়—বাংলা মিডিয়ামে না ইংলিশ মিডিয়ামে?'

Comments

The Daily Star  | English

What if the US election ends in a Trump-Harris tie?

While not highly likely, such an outcome remains possible, tormenting Americans already perched painfully on the edge of their seats ahead of the November 5 election

2h ago