২ বছর ক্লাস করে এইচএসসির দিন জানলেন তারা কলেজের শিক্ষার্থী না
দুই বছর আগে কলেজে ভর্তি হয়েছেন, পেয়েছেন রোল নম্বর, ক্লাস করেছেন, নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন, সেশন ফি দিয়েছেন, এইচএসসির ফরম পূরণের ফি দিয়েছেন। অথচ আজ বৃহস্পতিবার অংশ নিতে পারেননি এইচএসসি পরীক্ষায়।
পরীক্ষায় বসার জন্য প্রবেশপত্র না পেয়ে শেষে কলেজে যোগাযোগ করে জানতে পারলেন যে তারা অফিসিয়ালি ওই কলেজের শিক্ষার্থীই নন।
বগুড়ার সরকারি শাহ সুলতান কলেজের মাধ্যমে এভাবে প্রতারিত হয়েছেন অন্তত ২০ শিক্ষার্থী।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা জানান, অনলাইনে কলেজে ভর্তির জন্য দুই বছর আগে তাদের পছন্দ ছিল সরকারি শাহ সুলতান কলেজ। কিন্তু ভর্তির সুযোগ না পাওয়ায় তারা কলেজে যোগাযোগ করলে অফিস সহকারী হারুন ও হান্নান তাদের ম্যানুয়ালি ভর্তি করেন।
এরপর থেকে এই শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ক্লাস করেছেন। কলেজের বার্ষিক পরীক্ষাও দিয়েছেন। এমনি তাদের এইচএসসির ফরমও পূরণ হয়ে গেছে বলে জানানো হয়েছে।
কিন্তু তারপরও এইচএসসি পরীক্ষা দিতে না পেরে নিজেদের প্রতারিত ভাবছেন তারা। তাদের একজন বগুড়া সদর উপজেলার সাবগ্রামের রাশেদুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয় দ্য ডেইলি স্টারের।
তিনি জানান, এসএসসি পরীক্ষায় পাশের পর সরকারি শাহ সুলতান কলেজে মানবিক শাখায় ভর্তির জন্য অনলাইনে আবেদন করেন তিনি। কিন্তু তার নাম আসে করোনেশন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। কিন্তু তিনি ভর্তির বিষয়ে জানতে শাহ সুলতান কলেজের অফিসে যোগাযোগ করেন।
রাশেদুল বলেন, 'তখন কলেজের অফিস সহকারী হারুনুর রশিদ আমাকে অফলাইনে ভর্তির প্রতিশ্রুতি দেন এবং ভর্তির রশিদ দিয়ে ৬ হাজার টাকা নেন। আমাকে রোল নম্বরও দেওয়া হয়। এরপর থেকে ২ বছর ক্লাস করি, প্রাক নির্বাচনী ও নির্বাচনী পরীক্ষা দেই।'
তিনি আরও জানান, এরপর বিভিন্ন সময় কলেজের পরীক্ষার ফিসহ আরও অনেক টাকা নিয়েছেন হারুন। এমনকি এইচএসসির ফরম পূরণের ফিও নিয়েছেন।
'এইচএসসির ফরম পূরণ করিনি। কিন্তু, আমাকে বলা হয়েছে যে ফরম পূরণ হয়ে গেছে। কিন্তু গতকাল বুধবার এইচএসসির প্রবেশপত্র দিতে চেয়ে আর দিতে পারেননি হারুন,' বলেন রাশেদুল।
শাহ সুলতান কলেজ কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, চলতি শিক্ষাবর্ষে তাদের শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৫৪৩ হলেও, রাশেদুলের ক্লাস রোল দেওয়া হয়েছিল ১৫৭৫।
রাশেদুল জানান, তার মতো এই কলেজের ২০-২৫ জন শিক্ষার্থী বৃহস্পতিবার এইচএসসি পরীক্ষা দিতে পারেননি।
আরও দুই শিক্ষার্থী শারমিন আক্তার এবং হাবিব আক্তার দ্য ডেইলি স্টারের কাছে একই অভিযোগ করেন।
হাবিবার মা হাসিনা বানু ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকারি কলেজের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এমন প্রতারণা করতে পারে একথা স্বপ্নেও ভাবিনি। তাদের প্রতারণার শিকার হয়ে আমার মেয়ের জীবন নষ্ট হয়ে গেল।'
কলেজ কর্তৃপক্ষের মতে, অন্তত ৬ জন শিক্ষার্থী তাদের কাছে অভিযোগ করেছেন যে তারা বেশ কয়েকদিন ঘুরেও এইচএসসির প্রবেশপত্র পাননি এবং আজ পরীক্ষায় বসতে পারেননি।
ওই ৬ শিক্ষার্থীর দাবি, কলেজের প্রধান কেরানীসহ আরও কয়েকজন এই প্রতারণা সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। হারুন, হান্নান ছাড়াও এই সিন্ডিকেটে অফিসের তাজমিলুরসহ একাধিক ব্যক্তি জড়িত।
কলেজের অফিস সহকারী (মাস্টাররোলে নিয়োগপ্রাপ্ত) হারুনুর রশিদ গত ১০ -১২ বছর ধরে এই কলেজে কর্মরত আছেন এবং আরেক অফিস সহকারী আব্দুল হান্নান ৫-৭ বছর আগে বগুড়া আজিজুল হক কলেজ থেকে এখানে বদলি হয়েছেন।
অফিস সহকারীদের একটি সূত্র হারুন ও হান্নানের এই প্রতারণার বিষয়টি দ্য ডেইলি স্টারকে নিশ্চিত করেছে। ঘটনা জানাজানির পর থেকে হারুন পলাতক থাকলেও, হান্নান একজন শিক্ষার্থীকে ভর্তির জন্য ৮ হাজার টাকা নিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন। ওই টাকা তিনি হারুনকে দিয়েছেন বলেও দাবি করেন।
বিষয়টি জানতে পেরে শাহ সুলতান কলেজে যান বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সজীব সাহা। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'এ বছর কম করেও হলেও ২৫ জন শিক্ষার্থী এই প্রতারণার শিক্ষার হয়েছেন। আমরা কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। আগামী রোববারের মধ্যেই তারা জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।'
অফিস সহকারী হারুনুর রশিদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তিনি কোনো টাকা নেননি। কাউকে ভুয়া ভর্তি করাননি।
এ বিষয়ে জানতে কলেজের সহকারী অধ্যক্ষ রেজাউন নবীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রতারণার বিষয়টি তারা আগে টের পাইনি। আজই জানতে পেরেছে। আজ ৩ জন শিক্ষার্থী প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলে আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। পরে আরও ৬-৭ জনের কথা জানতে পেরেছি।'
তবে মোট কত শিক্ষার্থী এমন প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলতে পারেননি সহকারী অধ্যক্ষ।
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমরা রোববারে একটি তদন্ত কমিটি করব। তদন্তের মাধ্যমে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের বিষয়ে তিনি বলেন, 'এখন আর কী করার সুযোগ আছে? তাদের জীবন থেকে একটি বছর নষ্ট হলো। সামনের বছর যদি তাদের জন্য কিছু করা যায় করব।'
জানতে চাইলে কলেজের উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. রেজাউন নবী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই শিক্ষার্থীদের বিষয়ে বোর্ডে যোগাযোগ করা হবে। এবার হয়তো আর কোনো কিছু করা সম্ভব নয়। কিন্তু আগামীতে যেন পরীক্ষা দিতে পারে, সে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করা হবে।'
Comments