‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল ছাড়া গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্ভব নয়’

আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তারা। ছবি: সংগৃহীত

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা ও মত প্রকাশের অধিকার সমুন্নত রাখা, সর্বোপরি মানুষের মৌলিক অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল ছাড়া কোনো উপায় নেই।

আজ বুধবার বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উদযাপনের ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা অনুষ্ঠানে এই কথা বলেন বক্তারা।

তবে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তব্যে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, 'দ্ব্যর্থহীনভাবে জানাচ্ছি, কোনো অবস্থাতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করবে না সরকার। তবে প্রয়োজনে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে মধ্যে কিছু সংশোধন করা হবে।'

ইউনেসকো, আর্টিকেল নাইনটিন ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) যৌথ উদ্যোগে 'শেপিং অ্যা ফিউচার অব রাইটস' শীর্ষক এই অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়।

আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের উত্তরে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'আমরাও মাননীয় মন্ত্রীর মতো দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করা ছাড়া এর কোনো সমাধান হবে না। কারণ এই আইনের যথেচ্ছ ব্যবহার ও অপব্যবহার সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পাশাপাশি মানুষের মৌলিক অধিকার হরণের হাতিয়ার হিসেবে প্রয়োগ হচ্ছে। সংশোধন করে এমনকি ঢেলে সাজালেও এই আইনে জনস্বার্থের প্রতিফলন ঘটবে না ও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, বরং বাতিল করে নতুন সাইবার সিকিউরিটি আইন প্রণয়ন করা উচিত।'

বৈশ্বিক গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশের পিছিয়ে যাওয়ায় চরম হতাশা প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, 'এ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন তাই নয়, বরং এমন সব দেশের কাতারে যারা হয় যুদ্ধ-বিদ্ধস্ত, গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত বা চরম স্বৈরতান্ত্রিক শাসনাধীন, যার কোনোটাই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।'

এই বিব্রতকর অবস্থানের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে দায়ী করে তিনি বলেন, 'এই আইন বাতিল করা ছাড়া বিকল্প নেই।'

রাজধানীর ধানমণ্ডিস্থ টিআইবি কার্যালয়ে আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন ইউনেস্কো ঢাকা কার্যালয়ের অফিসার-ইন-চার্জ সুসান ভিজ। স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক গুয়েন লুইস।

গুয়েন লুইস বলেন, 'গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করার মাধ্যমে আমরা নিজেদের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করছি। সাংবাদিকতা এমন একটি পেশা, যেখানে শুধু জনস্বার্থকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। এর সুরক্ষা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে সত্য উদঘাটনের মাধ্যমে সঠিক তথ্য পৌঁছে দেওয়া বাংলাদেশের সব গণমাধ্যমকর্মীদের আমি অভিনন্দন জানাই।'

প্যানেল আলোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন বলেন, 'দেশে অনেকগুলো গণমাধ্যম থাকলেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়ে যায় না। গণমাধ্যমের ক্ষমতা আছে লিঙ্গ বৈষ্যম্য ভাঙ্গার, ক্ষমতা আছে পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর তুলে আনার, তাদের সমস্যাগুলো তুলে ধরার। তাই, বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিতের জন্য গণমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে অবশ্যই কাজ করতে হবে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব দেশে বৈষম্য বেশি সেসব দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কম।'

ইংরেজি সংবাদপত্র ঢাকা ট্রিবিউনের নির্বাহী সম্পাদক রিয়াজ আহমেদ বলেন, 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যখন প্রণয়ন করা হলো, তখন বাংলাদেশে মাদকদ্রব্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল এবং সেই যুদ্ধ শেষ হয় মেজর সিনহার মৃত্যুর মাধ্যমে। তখন এমন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের আরও সংবাদ ছিল। তবে তা এই আইনের কারণে সামনে আসেনি। আমরা বলতে চাই, গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার কিছু নেই, বরং গণমাধ্যমের কাজের সঠিক পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য সবার কাজ করতে হবে।'

প্যানেল আলোচনায় প্রথম আলোর সাংবাদিককে রাতের আধারে তুলে নেওয়া, সাংবাদিক কাজলকে অপহরণ করে ৫৩ দিন নিখোঁজ দেখানো এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী খাদিজাতুল কোবরার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তারের বিষয় তুলে ধরে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, 'অযৌক্তিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে আইনমন্ত্রীর নির্দেশনা থাকার পরও অনেক ক্ষেত্রে তা মানা হয় না। এমন অবস্থায় আমরা আমাদের অধিকার কীভাবে নিশ্চিত করব এই প্রশ্ন রেখে যেতে চাই।'

প্যানেল আলোচনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যাপক অপব্যবহার এবং আইনটি বাতিলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, 'আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই যে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কোনো অবস্থাতেই বাতিল করা হবে না। তবে প্রয়োজনে কিছু সংশোধন করা যেতে পারে।'

তিনি আরও বলেন, 'সময়ের প্রয়োজনে ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের পর প্রথম দিকে কিছু অপব্যবহার (মিসইউস অ্যান্ড অ্যাবিউস) যে হয়েছে, তা আমি ও আমার সরকার অস্বীকার করি না। তবে এটাও সত্য যে এই অপব্যবহার এখন অনেকটাই কমে এসেছে। একটা সময়ে আমাদের মনে হয়েছে আমরা এই আইনের সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছি না। তাই আমরা একটি কমিটি গঠন করেছি। ইউএনএইচসিআর আমাদেরকে একটি টেকনিক্যাল পেপার দিয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সম্পর্কে এবং সেটা আমরা পর্যালোচনা করছি। তারা এই আইনের কিছু ধারা বাতিল করতে বললেও আমাদের সে ব্যাপারে দ্বিমত রয়েছে। তবে সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রয়োজনবোধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের চেষ্টা করা হবে।'

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইডেনের রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্দ্রা বার্জ ভন লিন্ডেসহ মিডিয়া ফ্রিডম কোয়ালিশনের (এমএফসি) অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশস্থ দূতাবাসের কর্মকর্তাসহ দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিনিধি ও অন্যান্য অতিথিরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

Comments