ডিএসএ থেকে সিএসএ: সংস্কারের নামে প্রহসন

আবারো সাংবাদিকদের ভাগ্য নির্ধারণ হচ্ছে অংশীজনদের না জানিয়েই

আইনমন্ত্রীর একটি অভ্যাস আমার ভালো লাগে—তিনি তার মোবাইলে আসা প্রতিটি কল নিজেই রিসিভ করেন। এই চমৎকার সৌজন্যমূলক আচরণটি তিনি সবার সঙ্গেই করেন এবং এ জন্য তাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। আরও ভালো লাগতো, যদি একইভাবে তাকে ধন্যবাদ দিতে পারতাম ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) সংশোধন করে সাইবার নিরাপত্তা আইন (সিএসএ) প্রণয়নের জন্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেটা পারছি না।

প্রতিটি কল রিসিভ করার ক্ষেত্রে আইনমন্ত্রীর যে উদারতা, তার বিপরীতে অত্যন্ত গোপনীয়তায় সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের বিষয়টি কোনোভাবেই মেলানো যায় না। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থাসহ কিছু অংশীজন এবং নাগরিক সমাজের কয়েকজন প্রতিনিধির সঙ্গে তিনি সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি তাদের বক্তব্য শুনেছেন এবং বারবার আশ্বস্ত করেছেন যে গণতান্ত্রিক সব নীতি মেনেই আইনটি সংস্কার করা হচ্ছে। কিন্তু, তাদের কাউকে আইনটির খসড়া দেখানো হয়নি, এমনকি এর কাঠামোও নয়।

তবে, আইনমন্ত্রী সাংবাদিক ও সম্পাদকদের সংগঠন বা সাংবাদিকদের প্রতিনিধিত্ব করে এমন কোনো সংগঠনের সঙ্গে কথা বলেননি—যা একেবারেই ব্যাখ্যাতীত। যেহেতু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহারের সবচেয়ে বড় শিকার সাংবাদিকরা এবং এই আইনের বিরোধিতায় তারাই নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাই সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়নে তাদের সঙ্গে আলোচনা না করার বিষয়টি কোনোভাবেই বোধগম্য নয়।

আমরা মনে করি, গণমাধ্যমের দাবি এবং এর সঙ্গে নাগরিক সংগঠনের জোরালো প্রতিবাদের কারণেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংস্কারের প্রক্রিয়া শুরু হয়। আইনমন্ত্রী বারবার বলেছিলেন, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বা বাকস্বাধীনতা খর্ব করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের উদ্দেশ্য নয়। তারপরও সাংবাদিক, ভিন্নমতাবলম্বী ও মানবাধিকার কর্মীদের বারবার কারাদণ্ড, হেনস্তা ও ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। তিনি বারবার আশ্বস্ত করেছিলেন যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হলেই সাংবাদিকদের তাৎক্ষণিক গ্রেপ্তার না করার বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন। তারপরও সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সম্প্রতি সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া চূড়ান্ত করার সময়ও তিনি সংশ্লিষ্ট সবাইকে আশ্বস্ত করেছেন যে নতুন আইনটি আমাদের উদ্বেগের অবসান করবে।

কিন্তু মর্মান্তিক হলেও সত্য যে আশ্বস্ত হওয়ার সেই জায়গাটি আমাদের কাছে অধরা এবং সম্ভবত সেই একই দুঃস্বপ্নের পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে। যারা সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া দেখেছেন, তারা দৃঢ়ভাবে একমত যে সংস্কারের নামে যা করা হয়েছে, তা নামসর্বস্ব। সর্বোচ্চ বলা যেতে পারে, পুরোনো আইনের ধারাগুলোকে একটু এদিক-সেদিক করা হয়েছে। কিছু ধারাকে জামিনযোগ্য করা হয়েছে এবং কিছু ক্ষেত্রে কারাদণ্ড কমানো হয়েছে—যা আগে থেকেই ছিল অযৌক্তিক ও লঘু পাপে গুরুদণ্ড। কিন্তু জরিমানার পরিমাণ এতটাই বাড়ানো হয়েছে যে তা পরিশোধের সামর্থ্য বেশিরভাগ গণমাধ্যমের নেই এবং সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে তো তা বলাই বাহুল্য।

৫ বছর আগে যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন হয়, তখন বলা হয়েছিল এটি সাইবার অপরাধ প্রতিরোধের জন্য তৈরি হয়েছে। কিন্তু, বাস্তবে আইনটি সরকারের প্রতিপক্ষ, সমালোচক ও মুক্ত গণমাধ্যম দমনের অস্ত্রে পরিণত হয়। সরাসরি বললে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হয়ে গেল আইনের ছদ্মবেশে দমন-পীড়নের রাজনৈতিক হাতিয়ার।

সাইবার নিরাপত্তা আইনও কি একই হবে? আইনটির খসড়া কিন্তু তাই বলছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যেমন বাকস্বাধীনতা, মুক্ত চিন্তা ও স্বাধীন সাংবাদিকতা বিরোধী; সাইবার নিরাপত্তা আইনও এর ব্যতিক্রম নয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশও (টিআইবি) বলেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যেসব ধারা বাকস্বাধীনতা, ভিন্নমত, চিন্তার স্বাধীনতা এবং বিশেষত সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার অধিকারকে খর্ব করে, নতুন আইনের খসড়াতেও তা রয়েছে।

যে প্রক্রিয়ায় সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন হচ্ছে, তা সরকারের উদ্দেশ্যের আন্তরিকতা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেয়। গণমাধ্যমকর্মী, মানবাধিকার সংস্থা ও সুশীল সমাজ বছরের পর বছর প্রতিবাদ জানানোর পর সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনে রাজি হয়। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার কাছে বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর গত বছরের জুনে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় আইনটি সংশোধনের সুপারিশ করে সরকারকে একটি টেকনিক্যাল নোট পাঠায়। সেখানে প্রস্তাবিত সংশোধনের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়। মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ারও আইনটি বাতিলের আহ্বান জানান।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সুস্পষ্ট অপব্যবহারের কারণে দেশের ভেতরে-বাইরে সমালোচনা তীব্র হয়ে ওঠায় গত ৭ আগস্ট এটি সংশোধন করে সাইবার নিরাপত্তা আইন করার ঘোষণা দেয় সরকার। এর ২ দিন পর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে আইনটির খসড়া প্রকাশ করে ২২ আগস্টের মধ্যে অংশীজনদের মতামত চাওয়া হয়। গত ২৮ আগস্ট খসড়া আইনটির অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা।

প্রশ্ন হচ্ছে, এত বছর প্রতিবাদ ও অপেক্ষার পরে যে সংশোধন হচ্ছে, তা এত তড়িঘড়ি করে আমাদের ওপর চাপানো হচ্ছে কেন? মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত খসড়া আইন ও মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত খসড়া আইন প্রায় অভিন্ন—শুধু একটি অতিরিক্ত ধারা জামিনযোগ্য করা হয়েছে। সুতরাং, এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতেই পারি যে অংশীজনরা যে মতামত দিয়েছেন সেগুলো ধর্তব্যে নেওয়া হয়নি কিংবা উপেক্ষা করা হয়েছে—যা পুরো প্রক্রিয়াটিকেই প্রহসনে পরিণত করেছে।

গত ৩০ আগস্ট আইনমন্ত্রী বলেন, 'অংশীজনদের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ডাকা হবে এবং বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে।' ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন চূড়ান্ত করার সময়ও এটা করা হয়েছিল। আইনটির খসড়া তৈরির সময় গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ করা হয়নি। এই আইন সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর আমরা আমাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছিলাম, যার কোনোটিই অমূলক ছিল না। এবারের মতো, তখনো আমাদের এই বলে আশ্বস্ত করা হয়েছিল যে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিষয়ে আমাদের সব আপত্তি আমলে নেবে এবং যথাযথ সমাধান দেবে।

গণমাধ্যমের আরও কয়েকজনের সঙ্গে আমিও সংসদীয় স্থায়ী কমিটির আমন্ত্রিতদের তালিকায় স্থান পাওয়ার দুর্লভ সম্মান অর্জন করেছিলাম। আমরা ২-৩টি সভায় অংশ নেই এবং কমিটির কাছে আমাদের মতামত লিখিত আকারে জমা দেই। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কীভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করবে এবং কীভাবে এটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করবে, তা স্পষ্ট করে জানাই।

স্পষ্টভাবে বলছি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে আমাদের একটি পরামর্শও গ্রহণ করা হয়নি। উল্টো, আইনটি যেদিন বিল আকারে সংসদে উপস্থাপন করা হয়, সেদিন দেখতে পাই যে এটি আরও কঠোর করা হয়েছে এবং পুলিশকে আরও বেশি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

কেন আমাদের মতামত অগ্রাহ্য করা হলো, তার কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। তারপরও সরকার ও সংসদীয় কমিটি কাগজে-কলমে বলতে পারছে, আইনটি চূড়ান্ত করার সময় গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে তারা যথাযথভাবে আলোচনা করেছে।

সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিল উত্থাপনের সময় মন্ত্রী বলেছিলেন, সারা বিশ্ব বাংলাদেশে এই নতুন আইনের প্রণয়ন দেখতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছে এবং তারা আইনটির কার্যকারিতা দেখলে আইনি প্রজ্ঞার জন্য আমরা আন্তর্জাতিক মহলের প্রশংসায় ভাসব।

এখন আমরা জানি, এই আইন নিয়ে পুরো বিশ্ব কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের প্রতি কেমন মনোভাব পোষণ করছে। আমরা মনে করি, অর্থনৈতিক সাফল্যের কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শেখ হাসিনা সরকারের যে অর্জন, তা উল্লেখযোগ্যভাবে ম্লান হয়েছে এই দমনমূলক আইনের জন্য। শুধুমাত্র এই একটি আইনের জন্য বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি যতটা ক্ষুণ্ণ হয়েছে, তা আর কিছুতেই হয়নি।

সরকার একই ভুল আবারও করবে? করলে আরও কঠোর সমালোচনার মুখোমুখি হবে এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

মাহফুজ আনাম, সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments