যে ৩ কারণে চাপের মুখে গুগলের বিজ্ঞাপনী ব্যবসা

যে ৩ কারণে চাপের মুখে গুগলের বিজ্ঞাপনী ব্যবসা
ছবি: রয়টার্স

ডিজিটাল অ্যাডভার্টাইজিংয়ের জগতে কয়েক দশকের একচ্ছত্র আধিপত্যের পর গুগল এখন তাদের প্রধান আয়ের উৎস নিয়ে এক সংকটপূর্ণ সময় পার করছে। এই প্রথমবারের মতো গুগলের বিজ্ঞাপনী ব্যবসা কয়েক দিক থেকে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হয়েছে।

গুগলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে মাইক্রোসফট। প্রতিষ্ঠানটির আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) সমৃদ্ধ নতুন বিং সার্চ ইঞ্জিন এবং নতুন এজ ব্রাউজারের ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে, যা গুগল সার্চ এবং গুগল ক্রোমের জন্য মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠছে। রিটেইল মিডিয়ায় এখনো গুগল মহীরুহ হয়ে উঠতে পারেনি। মার্কিন বিনিয়োগ ব্যাংক মর্গান স্ট্যানলির তথ্য অনুসারে, ২০২৫ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী এই রিটেইল মিডিয়ার আকার হবে ১৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২৬ বিলিয়ন ডলারের স্ট্রিমিং টেলিভিশনের মার্কেটেও গুগল এখনো নিজেদের আসন সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি।

অধিকাংশ বিশ্লেষকের মতে, গুগলের ডাবল ডিজিট সেলস গ্রোথের দিন শেষ হয়ে গেছে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওমডিয়ার প্রধান বিশ্লেষক ম্যাথিউ বেইলির ধারণা, ২০২৩ এবং ২০২৪ সালে গুগলের ডিজিটাল অ্যাড রেভিনিউ গ্রোথ হবে ৫ শতাংশ।

যে ৩ দিক থেকে ডিজিটাল বিজ্ঞাপনে গুগলের শ্রেষ্ঠত্ব হুমকির মুখে পড়েছে-

গুগলের মহাপরাক্রমশালী সার্চ ব্যবসা

গুগলের আয়ের অধিকাংশই আসে এর সার্চ ব্যবসা থেকে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টার্টকাউন্টারের তথ্যমতে, গত বছর সার্চ ব্যবসার প্রায় ৯০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করতো গুগল। মাইক্রোসফটের বিং-এর মার্কেট শেয়ার ছিল মাত্র ২-৩ শতাংশ। কিন্তু বিং সার্চ ইঞ্জিনে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স সংযুক্ত করার পর মাইক্রোসফটের এই সার্চ ইঞ্জিনটি দিন দিন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।

মিডিয়া এজেন্সি অ্যাসেম্বলি গ্লোবাল এর পেইড সার্চ বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যামি অ্যান্ডারসন বলেন, 'হ্যাঁ, কিছুটা বিপন্ন (গুগলের জন্য) অবস্থা বিরাজ করছে। বহু বছর ধরে কোনো কিছু সার্চ করার জন্য মানুষ  প্রাথমিকভাবে গুগলের সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করে আসছে। তবে এ ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।'

অ্যামাজন ৩ বছর আগে থেকে বিজ্ঞাপন ব্যবসা থেকে অর্থ আয় শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে নতুন খেলোয়াড় হচ্ছে টিকটক। তবে টিকটক বা অ্যামাজন- কেউই গুগলের সার্চ ব্যবসার জন্য কোনো হুমকি হয়ে উঠতে পারেনি, যা পেরেছে মাইক্রোসফটের বিং।

অ্যামাজনের সার্চ ব্যবসা এখনো শুধু অনলাইন মার্কেটপ্লেসেই সীমাবদ্ধ। টিকটকের সার্চও নির্দিষ্ট কিছু তথ্যকেন্দ্রিক। কিন্তু বিং সার্চের পরিসর আরও অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। তথ্যের জন্য সাধারণ ব্যবহারকারীরা যত ধরনের সার্চ করতে পারেন, তার সবই বিংয়ে সম্ভব। তাই সার্চ ব্যাবসায় গুগলের আয়ে বড়সড় ভাগ বসানোর সব সম্ভাবনাই আছে বিংয়ের। বরং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই যোগ করার পর মাইক্রোসফটের এই সার্চ ইঞ্জিন মানুষের তথ্য সার্চ করার অভিজ্ঞতাই রাতারাতি বদলে দিয়েছে।

সার্চ ইঞ্জিনে ভবিষ্যতে আরও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তি যোগ হতে থাকবে, যা পুরো সার্চ ব্যবসা ও মানুষের অভিজ্ঞতাকে খোলনলচে পাল্টে দেবে।

এটাও সত্যি যে, গুগল সার্চের শ্রেষ্ঠত্ব কমানোর জন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের আরও অনেকদূর যেতে হবে। গুগলও কিন্তু বসে নেই। তারাও তাদের সার্চ ইঞ্জিনে এআই প্রযুক্তি যুক্ত করতে যাচ্ছে। মাইক্রোসফট তাদের সার্চ ইঞ্চিনে চ্যাটজিপিটি যুক্ত করার পর গুগল বার্ড নামের নতুন এআই চ্যাটবট চালু করেছে। অ্যান্ডারসনও মনে করেন, গুগলের নিরাশ হওয়ার সময় এখনো আসেনি।

বিজ্ঞাপনদাতারা সেখানেই অর্থ খরচ করবেন, যেখানে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বেশি ব্যবহারকারী আছে। গুগলের সার্চ ব্যবসায় ভাগ বসাতে হলে বিংয়ের ব্যবহারকারী আরও অনেক বাড়াতে হবে। বাজার বিশ্লেষণী প্রতিষ্ঠান রকারবক্সের তথ্যমতে, ডিরেক্ট-টু-কনজ্যুমার ব্র্যান্ডগুলো এখনো গুগলেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করছে।

গুগলের শ্রেষ্ঠত্ব এখনো অক্ষুণ্ন থাকলেও তারা সার্চ ব্যবসায় অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় তীব্র প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হয়েছে, এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

আয় কমেছে ইউটিউব থেকেও 

গুগলের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের ১০ কোটিরও বেশি ব্যবহারকারী বর্তমানে টিভি পর্দায় ইউটিউব দেখেন। তারপরও সম্প্রতিকালে ইউটিউবের আয়ে পড়তি দেখা গেছে। ইউটিউব গত বছর প্রথমবারের মতো টানা ২ বছর ত্রৈমাসিক আয়ের নিন্মধারা প্রত্যক্ষ করেছে।

টিকটকের অভাবনীয় উত্থানের অন্যতম একটি কারণ বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক। অ্যাপলের 'অ্যাপ ট্র্যাকিং ট্রান্সপারেন্সি' আরেকটি প্রধান কারণ। অ্যাপলের গ্রহকরা এখন চাইলে নির্দিষ্ট অ্যাপ বা ওয়েবসাইটের ট্র্যাকিং করার ক্ষমতা খর্ব করতে পারে। বিজ্ঞাপনী বাজার বিশ্লেষণী প্রতিষ্ঠান লোটামের তথ্য অনুসারে, অ্যাপলের এই প্রযুক্তির কারণে ইউটিউবের অন্তত ২.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় কমে গেছে।

স্ট্রিমিংয়ের ক্ষেত্রে এখনো ইউটিউব অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান এবং এই খাত থেকে বিজ্ঞাপনী আয়ের উল্লেখযোগ্য অংশ এখনো তাদের পকেটেই যায়। তবে নেটফ্লিক্স, ডিজনি প্লাস, পিককের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো অচিরেই ইউটিউবের আয়ে ভাগ বসাতে যাচ্ছে।

অনলাইন প্ল্যাটফর্মের বিজ্ঞাপনে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে একাধিক মামলার মুখোমুখি হয়েছে ইউটিউবের মূল প্রতিষ্ঠান গুগল। ফলে যেকোনো উপায়ে বিজ্ঞাপনের বাজার নিজেদের দখলে রাখতে হয়তো আরও সতর্ক থাকতে হবে গুগলকে, কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি ছাড় দিতেও বাধ্য হতে পারে। এর সুবিধা পাবে প্রতিদ্বন্দ্বী টিভি স্ট্রিমিং কোম্পানিগুলো। তারা হয়তো ভবিষ্যতে গ্রাহকের তথ্য বিশ্লেষণ করে নির্দিষ্ট গ্রাহক গোষ্ঠিকে টার্গেট করে কনটেন্ট নির্মাণ করতে পারবে কিংবা বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করতে পারবে।

আরেকটি বিজ্ঞাপনী বাজার বিশ্লেষণী প্রতিষ্ঠান জাউন্স মিডিয়ার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ক্রিস কেইন বলেন, 'অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইস এবং টিভিতে গুগল নিজেদের অবিশ্বাস্য প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে পারত। কিন্তু তারা সেটি করছে না। কারণ, করলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার মাথা খারাপ হয়ে যাবে।'

রিটেইল অ্যাডভার্টাইজিংয়েও পিছিয়ে গুগল

উঠতি ও সম্ভাবনাময় রিটেইল মিডিয়া মার্কেটপ্লেসে নিজেদের আসন প্রতিষ্ঠিত করতেও হিমশিম খাচ্ছে গুগল। রিটেইল বিজ্ঞাপনের বাজারে অ্যামাজনের ৩১ বিলিয়ন ডলার এবং ওয়ালমার্টের প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা আছে। এর মানে, এখানে গুগলের জেতার মতো তেমন কিছু অবশিষ্ট নেই।

ই-কমার্স সাইটে বিজ্ঞাপন কেনা-বেচার জন্য গুগলের অবশ্য আলাদা প্রযুক্তি আছে। তবে সেগুলো তেমন কার্যকর নয়।

অবশ্য, গুগলের জন্য রিটেইল মিডিয়া অতটা গুরুত্বপূর্ণও নয়, যতটা গুরুত্বপূর্ণ ক্রিটেও কিংবা সিট্রাসএড-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য। মর্গান স্ট্যানলির অনুমান বলছে, ১৩০ বিলিয়ন ডলারের রিটেইল মিডিয়া মার্কেটের মধ্যে ২০২৫ সাল নাগাদ ডিজিটাল বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানগুলো অন্তত ২৬ বিলিয়ন ডলারের নিয়ন্ত্রণ নেবে। মর্গান স্ট্যানলির মতে, ক্রিটেও এবং দ্য ট্রেড ডেস্ক- এই দুটি প্রতিষ্ঠানের সফলতার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।

মাইক্রোসফট এবং মেটার কাছ থেকেও আগের তুলনায় অনেক বেশি প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হচ্ছে গুগল। এই দুটি প্রতিষ্ঠান এখন রিটেইলারদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও বাড়াচ্ছে এবং তাদের জন্য নিজেদের প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্র তৈরি করছে।

 

সূত্র: বিজনেস ইনসাইডার
গ্রন্থনা: আহমেদ হিমেল

 

Comments

The Daily Star  | English

Nowfel gained from illegal tobacco trade

Former education minister Mohibul Hassan Chowdhury Nowfel received at least Tk 3 crore from a tobacco company, known for years for illegal cigarette production and marketing including some counterfeit foreign brands. 

2h ago