ভিউয়ের ফাঁদ থেকে গণমাধ্যমকে রক্ষা জরুরি

এ জন্য মিডিয়া এডুকেশন দরকার। বিষয়বস্তু বা উৎসের সত্যতা যাচাইয়ের সক্ষমতা দরকার। ভিউ আইটেমের ভেতর অনেকসময় অপতথ্য, ভুল তথ্য ও অসত্য থাকে।
ছবি: স্টার

গুগল থেকে জানা গেল ইউটিউবে এ যাবৎ বেশি ভিউ হওয়া ভিডিওটির নাম হলো 'বেবি শার্ক ডেন্স', যা ভিউ হয়েছে চৌদ্দশ কোটির কাছাকাছি। এ ভিডিও থেকে আয় হয়েছে  দুই হাজার পাঁচশ সত্তর কোটি টাকা।

বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ইউটিউব, ফেসবুক রিল, টিকটক (কিছুদিন হলো বন্ধ) টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ভিউ প্রবণতার ধারক ও বাহক হয়ে উঠছে।  এটি আজ বড় বাণিজ্যিক উৎপাদ। আমেরিকার বার্ড কলেজের ভিজিটিং প্রফেসর ফাহমিদুল হক ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেন, অর্থের জন্য মানুষ এখন ভিউ ও লাইকের দিকে ছুটছে। এখানে নীতি-নৈতিকতা বা মান খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়।

ভিউ মানে দেখানো। এ প্রক্রিয়ায় একবার ক্লিক হয়ে গেলে আর ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই। বিখ্যাত হওয়া বা জনপ্রিয় হওয়া সমাজের নতুন এক প্রবণতা। সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবে এ প্রবণতা দ্রুতগতিতে বাড়ছে। যারা সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য কনটেন্ট বানাচ্ছেন তারা বেশি বেশি লাইক বা কমেন্টের বিষয় মাথায় রেখেই বানাচ্ছেন। লাইক বা কমেন্ট এখন মনিটর করা যাচ্ছে, ক্ষণে ক্ষণে টাকার হিসাব কষা যাচ্ছে।

কনটেন্ট ক্রিয়েটরেরা এমন সব কনটেন্ট বেছে নিচ্ছেন যেগুলো দ্রুত মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করছে। কনটেন্টের মূলভাব অত্যন্ত সস্তা। সস্তা বা স্থুলতা জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। ভিউ হলো পপুলার কালচারের একটি বিশেষ অংশ যাতে সারবত্তা বলে কিছু নেই। মৌলিক বিষয়গুলো ভেঙ্গেচুরে এক জনপ্রিয় উৎপাদন হলো ভিউ বাণিজ্য। 

এর সরল ব্যাপার হলো ক্ষণে ক্ষণে জমকালো উপস্থিতি। ভিউয়ে প্রদর্শিত ভায়ালেন্স, রুচিহীনতা, অশ্রদ্ধা, হেয়করণ কেবল মিডিয়ার মধ্যে থাকে না তা নেমে আসে সামাজিক পরিসরে। ভিউ প্রবণতার বড় ধাক্কা এসে পড়েছে ব্যক্তির স্বাধীনতা, গোপনীয়তা ও মানবিক মর্যাদার ওপরে। অন্যের শরীর, অন্যের সৌন্দর্য, ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ কোনো কিছুই ভিউ বাইরে নয়। এর বিশেষ প্রবণতা হলো সবাইকে দূরে সরিয়ে, নিজের অবস্থানকে জাহির করা। প্রথম হওয়া ও শ্রেষ্ঠ হওয়ার অশুভ তৎপরতা। ভিউ মধ্যমণি হতে শেখাচ্ছে। 

নিজের অবস্থান অন্যের চোখের সামনে সবসময় জারি রাখা কোনো সুস্থ মানসিকতার পরিচয় হতে পারে না। কী অধিকার আছে অন্যের চোখের সামনে নানা ভঙ্গিমায় সচিত্র থাকা। অপ্রয়োজনীয় উপস্থিতি রুচিহীন ব্যাপার। আরও অরুচিকর ব্যাপার হলো নিজের পছন্দ অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া, স্থুলতায় ভরে তোলা। ভিউ প্রবণতা জনস্মৃতিকে হালকা করে দিচ্ছে। তাৎক্ষণিকতার ফ্রেমে বন্দি করছে। গড়ে উঠছে না যৌথ বা দীর্ঘ স্মৃতি। ভিউ ভবিষ্যত ও অতীত দুটোকেই সমূলে হত্যা করছে।

ভিউয়ের ফ্রেমে গরহাজিরা চলছে নানা ফর্মে। বির্তকিত, আলোচিত, হাসি-তামাশা, বৈশাদৃশ্য তুলে ধরা হচ্ছে ভিউ বাড়ানোর স্বার্থে। সম্প্রতি চলচ্চিতের অভিনেত্রী রুনা খান-মিডিয়ার বিরুদ্ধে এমন একটি অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেছেন-তিনি ভিউ চান না। মিডিয়া নিজেদের স্বার্থে তাকে ভিউ বানাচ্ছে। রুনা খান মন্তব্য করেন, তাঁর ভিউ বাড়িয়ে মূলত লাভ করছে চ্যানেলগুলো।

মা হারা শিশুর দুঃখ এখন বাণিজ্যিক পণ্য। নিতান্ত ব্যক্তিগত বিষয় পাবলিক করার অধিকার কারো নেই, যতক্ষণ না তিনি তা প্রকাশ করতে চান। মনে রাখতে হবে, আমরা যাকে যা দেয় না তা কেড়ে নিতে পারি না। মাকে নিয়ে শিশুর এ অনুভুতি গণ করার অধিকার মিডিয়াকে কে দিলো?

তিনি আরও বলেন, সাংবাদিকেরা তাকে ফোন করেন, কিছু একটা শুনতে চান। তিনি সাংবাদিকদের পাল্টা প্রশ্ন করতে  বলেন। সাংবাদিকেরা প্রতিউত্তরে বলেন, প্রশ্ন নাই, কিছু একটা বলেন। রুনা খানের বক্তব্য, কাজ ছাড়া কী কথা থাকতে পারে। কাজ নিয়ে কেও প্রশ্ন করছে না, হয়ত কাজ সম্পর্কে ধারণা নেই। সাংবাদিকদের বক্তব্য হলো কিছু একটা বলেন। অর্থাৎ মিডিয়াগুলো তাঁর গ্ল্যামার সেল করতে চায় এবং তা করছে।

অন্যের দুঃখ বা কষ্ট কোনো কিছুই ভিউ স্পর্শের বাইরে  নেই। যা ভিউ হওয়ার সম্ভাবনা আছে তাই তুলে আনা  হচ্ছে। গত ৪ জুন ২০২৪ মারা যান মডেল অভিনেত্রী রিশতা লাবনী সীমানা। সাংবাদিকেরা মায়ের লাশের সামনে শিশু সন্তানের মায়ের মৃত্যু বিষয়ে প্রক্রিয়া জানতে চেয়েছেন। বাংলাদেশের প্রধান ধারার অনেক টেলিভিশন চ্যালেন তা প্রচার করেছে যা থেকে লক্ষ লক্ষ ভিউ হয়েছে। তাদের আয় হয়েছে। সাংবাদিকতার কোন নৈতিকমান অনুসরণ শিশুসন্তানের কাছে মায়ের মৃত্যু বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলো?

মা হারা শিশুর দুঃখ এখন বাণিজ্যিক পণ্য। নিতান্ত ব্যক্তিগত বিষয় পাবলিক করার অধিকার কারো নেই, যতক্ষণ না তিনি তা প্রকাশ করতে চান। মনে রাখতে হবে, আমরা যাকে যা দেয় না তা কেড়ে নিতে পারি না। মাকে নিয়ে শিশুর এ অনুভুতি গণ করার অধিকার মিডিয়াকে কে দিলো?

শ্লেষ, হেয়করণ, অন্যকে নিয়ে হাসি-তামাশা, দুঃখ-কষ্ট  কোনো কিছুই আজ অবিক্রিত নয়। অন্যকে হেয় বা ছোট করে দেখানোর বাজারও বেশ রমরমা হয়ে উঠছে। অপরিশীলিত ও নিষ্ঠুরতার ঘিনঘিনে চাষ চলছে আজ ভিউয়ের লাঙ্গলে। এর ফ্রেমে দর্শক প্রতি মুহুর্তে জন্ম নেয়, প্রতি মুহুর্তে মারা যায়। ক্ষুধার চেয়েও বেশি ক্ষুধা তৈরি করছে ভিউয়ের দঙ্গল। সীমাহীন ক্ষুধা। কারণ এ ক্ষুধা যতো বাড়বে ভিউওয়ালাদের আয়রোজগারও তত বাড়বে। 

এ জন্য মিডিয়া এডুকেশন দরকার। বিষয়বস্তু বা উৎসের সত্যতা যাচাইয়ের সক্ষমতা দরকার। ভিউ আইটেমের ভেতর অনেকসময় অপতথ্য, ভুল তথ্য ও অসত্য থাকে। তথ্য ও তথ্যের উৎসের যর্থাযথভাবে চেনা সহজ নয়। কে চিনাবে এবং কীভাবে চিনবো ভিউয়ের প্রবল ঢল। একটি বিশ্লেষণাত্মক জনগোষ্ঠী গড়ে তুলতে মিডিয়া এডুকেশনের বিকল্প নেই। মিডিয়া লিটারেসির সম্প্রসারণ দরকার। 

যাহোক, ভিউ নামক নিয়ত হাজিরকরণ প্রক্রিয়ার বড় সাগরেদ আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি। হাল জামানায় আটিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স। কেউ কোনো বিষয় ভিউ করতে চাইলে সঙ্গে সঙ্গে প্রাসঙ্গিক অনেক বিষয় সামনে নিয়ে আসে। অনস্ক্রিন লাইফে আঙ্গুলের স্পর্শে প্রযুক্তি ঢুকে পড়ছে মস্তিষ্কে। জেনে নিচ্ছে আগ্রহের বিষয়গুলো। স্ক্রোল হ্যাবিট দেখে এআই মন মেপে নিচ্ছে, বিষয় ঢালছে। 

সব ভিউ যে মন্দ বা মানহীন এমন বলা যাচ্ছে না। তবে গড়পড়তা ভিউ একটি ভয়াবহ প্রবণতা। খুব সহজ করে বললে মানুষ কী খাবে বা তাকে খাওয়ানো যাবে তাই হয়ে উঠছে ভিউয়ের মূল অভিলক্ষ্য।

এ তৎপরতার ভেতর মূলত দুটি বিষয় রয়েছে; এক, উপার্জন; দুই. আইডেন্টি বা নিজের নতুন পরিচয় নির্মাণ । এ চর্চা নতুন নতুন সেলিব্রেটির জন্ম দিচ্ছে। তৈরি করছে বাধ্যতামূলক দর্শক শ্রেণি। অর্থাৎ যাকে ভিউ করা হচ্ছে তার কাছে সমর্পিত হচ্ছে দর্শক। আপডেট,  বিষয়বস্তু, নতুনত্ব নিয়ে অপেক্ষায় থাকছে। অর্থাৎ একটি অপেক্ষমান, অস্থির শ্রেণিও তৈরি করছে ভিউ বাণিজ্য।

এর ভেতর রয়েছে বিশেষ মাদকতা। ভিউয়ের রসায়ন না বুঝলে এতে নিমজ্জিত হতে বাধ্য। প্রশ্নহীনভাবে ভিউয়ের রসায়নে নিমজ্জিত হওয়া যাবে না, প্রশ্ন জারি রাখতে হবে। কারণ, প্রতিটি দেখানোর ভেতর রয়েছে একটি বিশেষ ট্রাপ; উত্তরাধুনিক তাত্ত্বিক মিশেল ফুকো ভিজিবিলিটিকে ট্রাপ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। ভিউয়ের ফাঁদ থেকে সুরক্ষা সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। 

Comments