শ্রেণিকক্ষ ও কর্মক্ষেত্রে ভালো প্রেজেন্টেশনের কৌশল
শ্রেণিকক্ষে বা কর্মক্ষেত্র যেখানেই হোক না কেনো প্রেজেন্টেশন বা উপস্থাপনার কথা উঠলে ঘাবড়ে যান অনেকে। এ ক্ষেত্রে কিছু পাওয়ারপয়েন্ট টিপস, বক্তৃতার গুণাবলি এবং প্রচুর অনুশীলনের মাধ্যমে অল্প সময়ে সফলভাবে উপস্থাপনার দক্ষতা আয়ত্ত করা সম্ভব।
শ্রেণিকক্ষ বা কর্মক্ষেত্রে উপস্থাপনার সময়ে কয়েকটি মূল বিষয় মাথায় রাখা প্রয়োজন, সেগুলো হলো-
উপস্থাপনা
কর্মক্ষেত্র বা শ্রেণিকক্ষে উভয় জায়গায় উপস্থাপনার ক্ষেত্রেই বক্তৃতা দেওয়ার জন্য দক্ষতার প্রয়োজন হয়। তবে এই ২ ক্ষেত্রে বক্তৃতার মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। কর্মক্ষেত্রে উপস্থাপনার মূল লক্ষ্য হয় কোনো বিষয় সম্পর্কে তথ্য জানানো কিংবা তার স্বপক্ষে জনমত সৃষ্টি করা। এ ধরনের বক্তৃতা ব্যখা বিশ্লেষণ-নির্ভর, তথ্যসমৃদ্ধ এবং যুক্তি ও প্রমাণনির্ভর হয়ে থাকে। গল্প কাহিনির ওপর নির্ভরতা কম হয়। খুব ছোট পরিসরে অল্প কিছু শ্রোতা থেকে শুরু করে বিশাল সম্মেলন কক্ষভর্তি শ্রোতার সামনে এ ধরনের উপস্থাপনা করতে হতে পারে।
অন্যদিকে, একাডেমিক উপস্থাপনাগুলো হালকা এবং কথোপকথনের মতো কোনো বিষয় থেকে শুরু করে জটিল এবং গবেষণামূলক নানা বিষয় নিয়েই হতে পারে। এ ক্ষেত্রে শ্রোতারা সাধারণত হয়ে থাকেন সহপাঠী এবং শিক্ষক, যার কারণে এ ধরনের উপস্থাপনা কিছুটা চাপমুক্ত এবং স্বচ্ছন্দ থাকা উচিত। এরপরও ভালো গ্রেড পাবার জন্য কিছুটা মানসিক চাপ এতে থাকলেও বক্তৃতার গুণাবলির চর্চার জন্য এ ধরনের উপস্থাপনাগুলো অত্যন্ত কার্যকরী।
উপস্থাপনার প্রস্তুতি
যেকোনো উপস্থাপনার জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উপস্থাপনার বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খ অধ্যয়ন, সময় ব্যবস্থাপনা, বক্তব্যের মূল দিকগুলো চিহ্নিত করা, দর্শকদের বিষয়ে জানা এবং সমস্ত অডিও-ভিজ্যুয়াল সরঞ্জামগুলো ভালোভাবে কাজ করছে কি না তা নিশ্চিত করার মতো কাজগুলো প্রস্তুতিপর্বে সেরে ফেলতে হবে। অডিও-ভিজ্যুয়াল সরঞ্জামগুলোর মধ্যে পাওয়ারপয়েন্ট স্লাইড, ভিডিও, ছবি, সাউন্ড সিস্টেম, প্রজেক্টর ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। উপস্থাপনা পর্বটি সফলভাবে সঞ্চালনার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ভালোভাবে কাজ করছে কি না তা শুরুতেই নিশ্চিত করে নেওয়া দরকার।
উপস্থাপনার আগে নিজের বক্তব্য অনুশীলন করে নেওয়া প্রয়োজন। বক্তৃতায় সহায়ক হিসেবে প্রয়োজন অনুযায়ী বক্তব্যের বিষয়বস্তু কিংবা মূল পয়েন্টগুলো কাগজে কিংবা ছোট ছোট কার্ডে লিখে নিজের কাছে রাখা যেতে পারে। পয়েন্ট বা কার্ডগুলোকে ধারাবাহিকভাবে সাজিয়ে নেওয়া ভালো। এ ছাড়া মূল বক্তব্য থেকে শুরু করে স্লাইডসহ উপস্থাপনার সব সরঞ্জামের প্রুফরিডিং করে নেওয়া হলে তা পরবর্তীতে মূল বক্তৃতার ভুল কমাতে সাহায্য করবে।
স্লাইডকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো
একটি সফল উপস্থাপনার জন্য প্রয়োজন উপস্থাপনার বিষয়বস্তু সঠিকভাবে সাজানো। এজন্য সহজে অনুসরণযোগ্য কাঠামো তৈরি করা গুরুত্বপূর্ণ। পুরো উপস্থাপনাটিকে ভূমিকা, মূল বক্তব্য এবং উপসংহার এই ৩ ভাগে ভাগ করে নিতে হবে। একটি আকর্ষণীয় ভূমিকা দিয়ে শুরু করে, তথ্য, উদ্ধৃতি এবং প্রমাণ দিয়ে বক্তব্যকে শক্তিশালী করে তুলতে হবে এবং মূলদিকগুলোকে টেনেই বক্তব্যের ইতি টানতে হবে।
স্লাইডের সংখ্যা এবং পরিসর খুব দীর্ঘ না করাই ভালো কেন না অতিরিক্ত তথ্যের কারণে শ্রোতারা মনোযোগ হারিয়ে ফেলতে পারেন। বিশেষজ্ঞরা একটি গড়পড়তা দৈর্ঘ্যের উপস্থাপনার জন্য ১০ থেকে ১২টি স্লাইড তৈরির পরামর্শ দেন। এতে করে পুরো উপস্থাপনা ৩০ মিনিট দীর্ঘ হলেও শ্রোতারা বক্তব্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্ক্রিনে থাকা বার্তাগুলো ভালোভাবে পড়ে বোঝার সুযোগ পেতে পারেন।
স্লাইডের নকশার ক্ষেত্রেও বেশ কিছু জিনিস খেয়াল রাখা উচিত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্লাইডে খুব বেশি উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার ভালো দেখায় না। রঙ নির্বাচনের ক্ষেত্রে বার্তার সঙ্গে সামঞ্জস্য আছে এমন রঙই বেছে নেওয়া উচিত। পুরো স্লাইডজুড়ে সাদা কালোর বাইরে শুধু একটি বা দুটি রঙ ব্যবহার করা সবচেয়ে ভালো। একাডেমিক উপস্থাপনার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত উজ্জ্বল এবং নিয়ন রংয়ের ব্যবহার এড়িয়ে চলা উচিত।
স্লাইডের নকশার মাঝে সামঞ্জস্যতা রাখা হলে তা বেশ পেশাদার দেখায়। এজন্য পুরো স্লাইডে ফন্টের আকার ও ধরনের মাঝে সমতা বজায় রাখা দরকার। বার্তার বিষয়বস্তু এক হলে ফন্টের ধরন ও আকার এক রাখা উচিত। এ ছাড়া ছবি ব্যবহারের মাধ্যমে স্লাইডকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা যায়।
স্লাইডের মধ্যে বিভিন্ন অডিও ভিজুয়াল টুলের ব্যবহার শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণে সহায়ক হতে পারে। কর্মক্ষেত্রে উপস্থাপনার ক্ষেত্রে স্লাইডে ছোট ভিডিওর মাধ্যমে গল্প বলা কিংবা কোন পণ্যের বিবরণ জানানো যেতে পারে। একাডেমিক উপস্থাপনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন গ্রাফ, চার্ট, তালিকা, ছোট শিক্ষামূলক ভিডিও ইত্যাদির ব্যবহার করা যায়। এ ছাড়া বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কোনো উদ্ধৃতি, সংলাপ, চলচ্চিত্রের দৃশ্য কিংবা কৌতুহলোদ্দীপক প্রশ্নজুড়ে দিয়ে স্লাইডকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা সম্ভব।
কোন ধরনের পোশাক পরা উচিত
উপস্থাপনার পোশাক সবসময় পেশাদার হওয়া উচিত। খেয়াল রাখতে হবে পোশাক যেন খুব ঢিলেঢালা না হয়। ছেলেদের জন্য ফরমাল শার্ট ও টাই, স্যুট, ব্লেজার, ফরমাল প্যান্ট, মেয়েদের জন্য পেন্সিল স্কার্টের সঙ্গে শালীন টপস ইত্যাদি পোশাক উপস্থাপনায় পরা যেতে পারে। এ ছাড়া শাড়িও পরা যেতে পারে তবে এক্ষেত্রে খুব বেশি জাঁকজমকপূর্ণ, কারুকাজখচিত শাড়ি এড়িয়ে চলা উচিত। সুতি কিংবা অপেক্ষাকৃত ভারী কাপড়ের এবং সাধারণ নকশার শাড়ি পরা যেতে পারে। ঘড়ি, গয়না কিংবা অন্যান্য আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও খুব বেশি জাঁকজমক এড়িয়ে চলা উচিত। তা না হলে ঝকমকে ঘড়ি কিংবা গলার হার দর্শক-শ্রোতাদের মনোযোগে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে।
উপস্থাপনার জন্য পোশাক নির্বাচনের ক্ষেত্রে এমন পোশাক পরা উচিত যা পরলে নিজের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। খুব বেশি আঁটসাট কিংবা ঢিলেঢালা উভয় ধরনের পোশাকই এড়িয়ে চলতে হবে। জুতার ক্ষেত্রেও পায়ের আকারের সঙ্গে মানানসই জুতা বেছে নিতে হবে। হাঁটাচলায় সমস্যা হয় এমন জুতা এড়িয়ে চলতে হবে। টি-শার্ট, ঢিলে শার্ট, জিন্সপ্যান্ট পরা উচিত নয় কেন না এ ধরনের পোশাকে নিজেকে অগোছালো কিংবা অপেশাদার দেখাতে পারে। মূলত, নিজেকে গোছানো, পেশাদার এবং আত্মবিশ্বাসী দেখায় এমন পোশাককেই প্রাধান্য দিতে হবে।
দলগত উপস্থাপনা
দলগত উপস্থাপনার ক্ষেত্রে নমনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি কিংবা অতিরঞ্জন এড়াতে উপস্থাপনার বিষয়বস্তু দলের সবার মাঝে ভাগ করে দেওয়া উচিত। দলের সবার উপস্থিতিতেই পুরো উপস্থাপনার প্রস্তুতি সেরে নিতে হবে। প্রত্যেক বক্তা কী বলবে তা সবার আগে থেকেই জানতে হবে। কোন বক্তা কত সময় ধরে কথা বলবে সেটিও আগেভাগেই ঠিক করে নেওয়া দরকার। যদি দলের মাঝে কোন দলনেতা থেকে থাকেন তবে বাকিদের উচিত তার প্রতি আস্থাশীল হওয়া। একটি দল হিসেবে ঐক্যবদ্ধভাবে সঠিক অনুশীলনের মাধ্যমেই একটি সফল উপস্থাপনা পরিচালনা করতে পারা সম্ভব হবে।
উপস্থাপনা চলাকালীন করণীয়
উপস্থাপনার সময়ে শ্রোতাদেকে ভুলে গেলে চলবে না, তাদের সঙ্গে কথা বলা এবং প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করা উচিত। শ্রোতাদের মাঝে বক্তব্যের বিষয়বস্তু সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টির চেষ্টা করতে হবে এবং তাদের বুঝতে অসুবিধা হয় এমন জটিল শব্দবাক্য বা পরিভাষা এড়িয়ে চলতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে জোর দিতে হবে, স্বাভাবিক অঙ্গভঙ্গি বজায় রাখতে হবে এবং কণ্ঠস্বরের ওঠানামাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। পুরো বক্তব্য কখনোই লাইন ধরে দেখে দেখে পড়া উচিত হয়। যতটা সম্ভব দর্শক-শ্রোতাদের সঙ্গে দৃষ্টি-সংযোগ বজায় রাখতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় হোক বা কর্মক্ষেত্র, যেকোনো উপস্থাপনার প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। শ্রোতারা সাধারণত প্রথম ৭ সেকেন্ডে মনে মনে উপস্থাপকের সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা তৈরি করে নেয়, তাই উপস্থাপনার শুরুটা হতে হবে শক্তিশালী। উপস্থাপনার বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি ছোট গল্প দিয়েই শুরু করা যেতে পারে, কোনো একটি প্রসঙ্গ তুলে ধরার জন্য সে সম্পর্কিত প্রশ্ন শ্রোতাদের মাঝে ছুড়ে দেওয়া যায়। বক্তব্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো রূপক বা পপকালচারের কোন প্রসঙ্গ এনেও শুরুতেই শ্রোতাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠা সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে শ্রোতা কারা এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্কের মাত্রা সম্পর্কে সতর্ক থাকাও একান্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অনুবাদ করেছেন নাফিসা ইসলাম মেঘা
Comments