৫ মনীষীর ভিন্ন ধারার শখ

উপরের সারিতে আইনস্টাইন, নিউটন, আডা। নিচের সারিতে: কেনস, টুরিং। ছবি: উইকিপিডিয়া
উপরের সারিতে আইনস্টাইন, নিউটন, আডা। নিচের সারিতে: কেনস, টুরিং। ছবি: উইকিপিডিয়া

বিখ্যাত ও প্রতিভাবান মনীষীদের ধ্যান-জ্ঞান শুধু তাদের নিজ খাতে সীমাবদ্ধ থাকে—অনেকেই এরকম ধারণা পোষণ করে থাকেন। তবে বিখ্যাত মনীষীরাও তাদের অবসর সময় বিচিত্র সব শখ-আহ্লাদে পার করেন, যে তথ্য অনেকেরই অজানা।

এমনই ৫ বিখ্যাত মনীষীর চমকপ্রদ কিছু শখের বর্ণনা দিয়ে সাজানো হয়েছে আজকের আয়োজন।

জন মেনার্ড কেইনস'র চিত্রকর্ম সংগ্রহপ্রীতি

ব্যারন কেইনস ছিলেন বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী ইংরেজ অর্থনীতিবিদ। তার মতবাদ অর্থনৈতিক চিন্তাধারায় কেইনেসিয়ান বিপ্লবের জন্ম দেয় এবং যুক্তরাজ্যকে 'গ্রেট ডিপ্রেশন' বা মহামন্দা থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখায়।  এখনও তার লিখে যাওয়া ধারণাগুলোর পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ অর্থনীতির মূলধারায় দেখা যায়।

মেনার্ড কেইন্স এর সংগ্রহের একটি ছবি, জর্জেস পিয়েরে সুরাতের আ সানডে অন দ্য আইল্যান্ড অব দ্যা গ্র্যান্ড জাত্তে: কাপল ওয়াকিং। ছবি: উইকিপিডিয়া
মেনার্ড কেইন্স এর সংগ্রহের একটি ছবি, জর্জেস পিয়েরে সুরাতের আ সানডে অন দ্য আইল্যান্ড অব দ্যা গ্র্যান্ড জাত্তে: কাপল ওয়াকিং। ছবি: উইকিপিডিয়া

কেইনস প্রচুর ধনসম্পদের মালিক ছিলেন। তিনি পুঁজিবাজারে ২ বার বিশেষ সৌভাগ্য অর্জন করতে পেরেছিলেন। তবে তার মতে, সম্পদ জমিয়ে রাখার জন্য অর্জন করা মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ। তাই তিনি তার সম্পদের সদ্ব্যবহার করতে শিল্প=সামগ্রীর এক বিশাল সংগ্রহ গড়ে তুলেছিলেন। এই সংগ্রহে পিকাসো, সেউরাত এবং সেজানের মতো ১৩৫টি  শিল্পকর্ম ক্যামব্রিজে দান করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

সংগ্রহের পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন থিয়েটার, অপেরা হাউস এবং নৃত্য সংস্থাকে সাহায্য করেছেন। তিনি ইংরেজ শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের ব্লুমসবারি গ্রুপের সদস্য ছিলেন। এই অনানুষ্ঠানিক সংগঠনের সদস্য হিসেবে শিল্পীদের সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে, যা প্রকারান্তরে তার সংগ্রহের কলেবর বাড়িয়ে তুলতে সহায়তা করে।

পরশপাথরের সন্ধানে আইজ্যাক নিউটন

ইংরেজ পদার্থবিদ ও গণিতবিদ আইজ্যাক নিউটন গতিসূত্র এবং মাধ্যাকর্ষণ নীতি প্রণয়নের জন্য বিখ্যাত তা মোটামুটি সবারই জানা কথা। প্রতিফলিত টেলিস্কোপ, প্রিজমে আলোর প্রতিসরণ তত্ত্ব ও ক্যালকুলাস আবিষ্কারের পাশাপাশি ব্যবহারিক পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতে রয়েছে তার অসংখ্য অবদান।

বিজ্ঞানের এই ২ শাখার পাশাপাশি রসায়ন বিষয়েও নিউটন বেশ আগ্রহী ছিলেন। বলা হয়ে থাকে, তার লেখা ১ কোটি শব্দের ১০ লাখই রসায়ন সংক্রান্ত। তবে রসায়ন নিয়ে তার লেখা ধর্মবিরোধী বা অবৈধ বলে বিবেচিত হওয়ায় অপ্রকাশিত রয়ে যায়। অসমর্থিত সূত্রের এক গল্পে জানা যায়, নিউটনের পোষা কুকুর ডায়মন্ড তার গবেষণাগারে আগুনের সূত্রপাত করে, যার ফলে ২০ বছরের আলকেমি (রসায়নের পুরনো সংস্করণ) গবেষণার সব কাগজ পুড়ে যায়।

নিউটনের অনেক লেখা থেকে বোঝা যায়, তিনি বিখ্যাত ফিলোসফার'স স্টোন বা পরশপাথর খুঁজছিলেন, যার ছোঁয়ায় অন্যান্য ধাতু সোনায় রূপান্তরিত হয়। এই পাথরের অন্যান্য গুণের মাঝে রয়েছে চিরযৌবন ও অমরত্ব লাভ।

অ্যাডা লাভলেস'র জুয়া আসক্তি 

কাউন্টেস অ্যাডা লাভলেস ১৯ শতকের গোড়ার দিককার একজন ব্রিটিশ লেখক ও গণিতবিদ। তিনি প্রখ্যাত লেখক লর্ড বায়রনের সন্তান ছিলেন। কন্যার পরিণতি যেনো তার বাবার মত না হয় সেজন্য তার মা তাকে বিজ্ঞান এবং গণিত পড়ার জন্য চাপ দিতেন।

চার্লস ব্যাবেজের সঙ্গে কাজের মাধ্যমে, তিনি তার প্রস্তাবিত প্রথম যান্ত্রিক কম্পিউটারের বিশ্লেষণী ইঞ্জিনের প্রথম অ্যালগরিদম লিখেছিলেন। এ কাজের জন্য তিনি প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসেবে বিবেচিত।

তার মায়ের সর্বোচ্চ চেষ্টা সত্ত্বেও, অ্যাডা এক দিক দিয়ে ঠিকই তার বাবাকে অনুসরণ করেছি। বাবার মতো তিনিও ছিলেন জুয়ায় আসক্ত । ১৮৪০ এর দশকের শেষভাগে, তিনি ৩ হাজার মার্কিন ডলার জুয়ার আসরে হেরেছেন, যার বর্তমান অঙ্ক জানলে অবাক না হয়ে পারা যায় না।

১৮৫১ সালে তিনি বাজিতে সফল হওয়ার জন্য তার গাণিতিক প্রতিভা ব্যবহার করে একটি অ্যালগরিদম তৈরি করার চেষ্টা করেন। তবে তার এই উদ্যোগ সফল হয়নি।

বেহালাবাদক আলবার্ট আইনস্টাইন

জার্মান-মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন আপেক্ষিকতার তত্ত্ব এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্সে অবদানের জন্য বিখ্যাত। ১৯০৫ সালে তিনি ব্রাউনিয়ান গতি, আলোক বৈদ্যুতিক প্রভাব, বিশেষ আপেক্ষিকতা এবং ভর-শক্তি সমতুল্যতা ব্যাখ্যা করে চারটি অসাধারণ গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন।

আইনস্টাইন ছোটবেলা থেকেই বেহালা বাজানোর চর্চা করতেন। ছবি: উইকিপিডিয়া
আইনস্টাইন ছোটবেলা থেকেই বেহালা বাজানোর চর্চা করতেন। ছবি: উইকিপিডিয়া

আইনস্টাইন ছোটবেলা থেকেই বেহালা বাজানোর চর্চা করতেন। তার মা একজন প্রতিভাবান পিয়ানো বাদক ছিলেন। তিনি তাকে জার্মান সংস্কৃতির সঙ্গে আরও যুক্ত করার আশায় ৫ বছর বয়সে তাকে বেহালার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। প্রথম দিকে আইনস্টাইন বেহালা বাজানোকে কর্তব্য মনে করলেও ১৩ বছর বয়সে মোজার্টের খোঁজ পাওয়ার তিনি এই বাদ্যযন্ত্রকে ভালোবাসতে শুরু করেন। কৈশোরেই তার প্রতিভা উন্মোচিত হতে থাকে।

তবে আইনস্টাইন কখনোই পেশাদার সংগীতশিল্পী হতে চাননি। তিনি বিজ্ঞানে পারদর্শী হতে না পারলে পেশা হিসেবে সঙ্গীতকে বেছে নেবেন এবং কার্ট অ্যাপেলবাউমের মতো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পেশাদার শিল্পীদের সঙ্গে বেহালা বাজাবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি নিজ থেকেই বেহালা বাজাতে শিখেছিলেন, তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষক ছিল না।  তবে তার সঙ্গে যারা বাজিয়েছেন, প্রতেকেই সায় দিয়েছেন, বেশ ভালো বাজাতেন আইনস্টাইন।

যদিও তিনি জনসমক্ষে খুব কমই বাজাতেন, তবু তিনি কখনই বেহালা ছাড়া কোথাও যাননি। শেষ জীবনে তিনি জোলনার কোয়ার্টেট ও জুলিয়ার্ড কোয়ার্ট্রেটের সদস্যদের সঙ্গেও বেহালা বাজিয়েছেন।

ম্যারাথন দৌড়বিদ অ্যালান টুরিং

অ্যালান টুরিং ছিলেন একাধারে ইংরেজ গণিতবিদ, কম্পিউটার বিজ্ঞানী, তাত্ত্বিক জীববিজ্ঞানী, দার্শনিক এবং ক্রিপ্টো বিশ্লেষক। তিনি বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সময়ের নাজি বাহিনীর গোপন সংকেতের অর্থ খুঁজে বের করার জন্য এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দর্শনে 'টুরিং টেস্ট' এর জন্য বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন।

অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী টুরিং অবসর সময়ে দৌড়াতে ভালোবাসতেন। ছবি: উইকিপিডিয়া
অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী টুরিং অবসর সময়ে দৌড়াতে ভালোবাসতেন। ছবি: উইকিপিডিয়া

অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী টুরিং অবসর সময়ে দৌড়াতে ভালোবাসতেন। টুরিং যখন খেলাধুলায় নিজেকে জড়িয়েছেন যখন তার বয়স ৩০ এর কোঠায়। তবে দেরিতে শুরু করা নিয়ে তার মনে কোনো আক্ষেপ ছিল না।

বৈঠকে যোগ দিতে তিনি প্রায়ই ব্লেচলি পার্ক থেকে ৪০ মাইল রাস্তা দৌড়ে লন্ডন যেতেন। তার পায়ের গতি ছিল বিশ্বসেরা ক্রীড়াবিদদের মতো দ্রুত। ১৯৪৮ সালে যুক্তরাজ্যের অলিম্পিক দলে ম্যারাথন দৌড়বিদ হিসেবে তিনি ২ ঘণ্টা ৪৬ মিনিটের পথ দৌড়ান। মাত্র ১১ মিনিট আগে লক্ষ্যে পৌঁছালেই তিনি টম রিচার্ডসের বদলে রৌপ্য পদক পেতেন। টুরিং তার বন্ধুদের বলতেন, দৌড় হলো মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার মাধ্যম। তিনি বলেন, 'আমি চাকরিতে এতই চাপের মুখে থাকি, যে এ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হল জোরে দৌড়ানো; এটাই চাপ-মুক্তির একমাত্র উপায়।'

 

তথ্যসূত্র: বিগ থিঙ্ক, মিডিয়াম, ফোর্বস

 

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

10h ago