‘আমার অনুপ্রেরণা আমি নিজেই’
আদর্শ প্রস্তুতির ঘাটতি ও টুর্নামেন্টের শুরুটা ভালো না হওয়া সত্ত্বেও গত অক্টোবরে সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে টানা দ্বিতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ দল। কাঠমুন্ডুতে অনুষ্ঠিত রোমাঞ্চকর ফাইনালে তারা ২-১ গোলে হারায় স্বাগতিক নেপালকে। কানায় কানায় পূর্ণ স্টেডিয়ামে শিরোপা নির্ধারণী লড়াইয়ে জয়সূচক গোল করার পাশাপাশি ঋতুপর্ণা চাকমা আসরজুড়ে বল পায়ে কাড়েন নজর। গতি, দক্ষতা ও সামর্থ্য দিয়ে প্রতিপক্ষ দলগুলোকে কাঁপিয়ে দেওয়া বাংলাদেশের ২১ বছর বয়সী তারকা উইঙ্গার জেতেন প্রতিযোগিতার সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও।
সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারের ক্রীড়া প্রতিবেদক সাব্বির হোসেনের সঙ্গে আলাপচারিতায় ঋতুপর্ণা কথা বলেছেন সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ দলের সাফল্য, তার ব্যক্তিগত অর্জন ও পরবর্তী পরিকল্পনাসহ আরও অনেক প্রসঙ্গে। সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য:
দ্য ডেইলি স্টার: শেষ হতে যাওয়া ২০২৪ সালে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের পারফরম্যান্স নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
ঋতুপর্ণা চাকমা: বছরের শুরুটা সত্যি বলতে একদমই ভালো ছিল না। প্রথম পাঁচ মাস আমাদের কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ ছিল না। তারপরও আমরা টানা দ্বিতীয়বার সাফের শিরোপা জিতেছি। এতে সবাই সন্তুষ্টি নিয়ে বছরটা শেষ করতে পেরেছি।
স্টার: আপনার জন্য এই বছরের সবচেয়ে ভালো স্মৃতি কোনটি?
ঋতুপর্ণা: সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জেতার পর দেশের মানুষের কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছি, সেটা ছিল সবচেয়ে ভালো অভিজ্ঞতা। তাদের জন্য ট্রফি নিয়ে আসতে পারায় ও সবাই মিলে উদযাপন করতে পারায় খুব আনন্দ লেগেছে।
স্টার: ২০২৪ সালে আপনার কাছে কোন সময়টা সবচেয়ে কষ্টের ছিল?
ঋতুপর্ণা: আপনারা জানেন যে সারা বছর আমরা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) ক্যাম্পে অনুশীলন করি। ২০২২ সালে প্রথমবার সাফ জেতার পর আমরা গত দুই বছর কঠোর পরিশ্রম করেছি যেন সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারি। কিন্তু এই বছর আমরা অনেক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছি। বিশেষ করে, আর্থিক সমস্যা ছিল। আমাদের বেতন ঠিকমতো হয়নি। কখনও কখনও দুই-তিন মাস দেরিতে বেতন পেয়েছি। এটাই সবচেয়ে কষ্টের দিক ছিল।
স্টার: দলীয় সাফল্যের বাইরে গিয়ে এই বছর ব্যক্তিগতভাবে আপনার সেরা অর্জন কী ছিল?
ঋতুপর্ণা: সেই মুহূর্তটা সারাজীবন আমার মনে থাকবে, যখন সাফের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আসরের সবচেয়ে মূল্যবান খেলোয়াড় হিসেবে আমার নাম ঘোষণা করা হয়। আমি ভাবতেই পারিনি এমন কিছু ঘটবে। তখন আমার যে অনুভূতি হয়েছিল, সেটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না।
স্টার: পেছনে ফিরে তাকালে ফাইনালে ব্যবধান গড়ে দেওয়া সেই গোলটি নিয়ে কী মনে হয়?
ঋতুপর্ণা: ফাইনালে আমি লেফট উইং থেকে বেশ কিছু ক্রস করেছিলাম। তবে কোনোটা থেকেই গোল আদায় করা যায়নি। তারপর আমি নিজেই একটি শট নিয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করি। যদিও শটটা ডি-বক্সের বাইরে বাম দিকে একটি কঠিন অ্যাঙ্গেল থেকে ছিল, তবে আমি সত্যিই গোল করার চেষ্টা করেছিলাম। সৌভাগ্যক্রমে বল জালে জড়ায় এবং সেটা জয়সূচক গোলে পরিণত হয়।
স্টার: পেশাদার ক্যারিয়ারে আপনার অনুপ্রেরণার উৎস কী?
ঋতুপর্ণা: আমার অনুপ্রেরণা আমি নিজেই। আমি যা করি, নিজে নিজে করি। যেটা করলে আমার জন্য ভালো হবে, সেটাই করি। মাঠের ভেতরে আমি সব সময় নিজের ওপর বিশ্বাস রাখি এবং ভালোবেসে ফুটবল খেলি। শৈশবে শখের বসে ফুটবল খেলতাম, এখন সেটা আমার পেশা হয়ে গেছে। আর আমি বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে আরও দীর্ঘদিন যেন খেলতে পারি, সেই চেষ্টা করব।
স্টার: দেশের মানুষের সমর্থন পাচ্ছেন। এটা আপনার পারফরম্যান্সের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
ঋতুপর্ণা: রাঙামাটি জেলার কাউখালি উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম মগাছড়ি থেকে আমি উঠে এসেছি। জাতীয় দল পর্যন্ত আসতে আমাকে অনেক প্রতিকূলতা পার করতে হয়েছে। অনেক মানুষ অনেক রকমের কথা বলত। এখন দেশের মানুষের যে ভালোবাসা ও সমর্থন পাচ্ছি, সেটাও আমার জন্য অনেক বড় অনুপ্রেরণা। আমি চাই পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা রাখতে।
স্টার: ভবিষ্যতে আপনি কীভাবে বাংলাদেশের ফুটবলে অবদান রাখতে চান?
ঋতুপর্ণা: ফুটবল যেহেতু আমার প্যাশন, আমার সারা জীবন ফুটবলের সঙ্গেই কাটাতে চাই। জানি না করতে পারব কিনা, তবে আমার খুব ইচ্ছা আছে অবসরের পর আমার ছোট ভাইয়ের নামে একটা ফুটবল একাডেমি করার। ২০২২ সালে আমরা যখন সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম, তার দুই মাস আগে সে আমাদের বাসায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যায়।
স্টার: আপনার প্রিয় ফুটবলার কে?
ঋতুপর্ণা: ছোটবেলা থেকেই আমি দুজনের কথা শুনেছি, তারা হলেন ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো ও লিওনেল মেসি। রোনালদো তখন থেকে আমার প্রিয় খেলোয়াড়। আমি যখন থেকে ফুটবল খেলা শুরু করেছি, তখন থেকেই রোনালদোকে অনুসরণ করি। মেসিকেও আমার ভালো লাগে।
স্টার: আপনি বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে পড়ছেন। খেলাধুলার পাশাপাশি পড়াশোনা কীভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন?
ঋতুপর্ণা: খেলার পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াটা অনেক কঠিন। ক্লাসই ঠিকমতো করতে পারিনি। স্নাতক সম্পন্ন করব। সেটা যেভাবেই হোক না কেন।
স্টার: নারী ফুটবলের উন্নতির ক্ষেত্রে আপনি কী কী বাধা দেখেন? সেগুলো দূর করতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?
ঋতুপর্ণা: আমি মেয়েদের মধ্যে ফুটবল নিয়ে অনেক বেশি আগ্রহ দেখতে দেখতে পাই। কিন্তু এখনও দেশের অনেক মানুষের চিন্তাভাবনা অন্যরকম। আপনি যত ভালো কিছুই অর্জন করুন না কেন তাদের মাথা থেকে কুসংস্কার যায় না। নারী ফুটবলকে আরও ভালো পর্যায়ে নিতে হলে প্রতিটি জেলাতে আলাদা একাডেমি করা উচিত এবং সেখানে অনুশীলনসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকা উচিত। আমি মনে করি, দক্ষিণ এশিয়ার পাশাপাশি এশিয়াতেও আমরা সেরা দলের একটি হতে পারব।
স্টার: আগামী বছরে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের পরিকল্পনা ও লক্ষ্য কী?
ঋতুপর্ণা: এক মাসের বেশি সময় ধরে আমরা ছুটিতে আছি। তবে বাফুফে আমাদেরকে এখনও কোনো ক্যালেন্ডার দেয়নি। আমরা তাদেরকে অনুরোধ করেছি ক্যালেন্ডার দেওয়ার জন্য যাতে ভালোমতো প্রস্তুতি নিতে পারি ও খেলার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারি। তাছাড়া, চাওয়া-পাওয়া নিয়ে আমরা নতুন বাফুফে সভাপতি তাবিথ আউয়ালের সঙ্গে কথা বলেছি। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে আমাদের বেতন যেন নিয়মিত দেওয়া হয়, বাফুফে ক্যাম্পে খাবারের মান যেন আরও ভালো হয় এবং নিয়মিত যেন আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজন করা হয় ইত্যাদি। বাফুফে আমাদের আশ্বাস দিয়েছে, দেখা যাক কী হয়।
Comments