‘আমাদের কাজটা এখন সহজ হবে, বাঙালিরা দেখবে মেয়েরাও পারে’
সাফ চ্যাম্পিয়ন ট্রফি নিয়ে সাবিনা খাতুনরা তখন বিমানবন্দরে এসে পৌঁছেছেন। তাদের নিয়ে আসতে ছাদখোলা বাস আর বর্ণাঢ্য আয়োজনে সবার চোখ। শহরের আরেক মাথায় বাফুফে ভবনের বাইরেও প্রচুর মানুষের জটলা, অপেক্ষা। কিন্তু বাফুফে ভবনে ছিল একদম সাদামাটা, আড়ম্বরহীন। সেই সাদামাটা ভবনটা রঙিন করে তুলছিলেন অনূর্ধ্ব-১৫ দলের মেয়েরা। 'বড় আপুরা' ট্রফি নিয়ে কখন আসবেন সেই অপেক্ষার প্রহর যেন আর ফুরোচ্ছিলই না তাদের। এই অর্জন যে তাদের চলার পথও কতটা সহজ করছে সেই আনন্দ ছিল চোখেমুখে।
বুধবার দুপুরে বাফুফে ভবনে প্রবেশ করে উপর থেকে কোলাহলের শব্দ শুনে তাকাতেই দেখা গেল এক ঝাঁক আগামীর সাবিনা, কৃষ্ণা, সানজিদাদের। সিনিয়র দলের সাফল্যে উদ্বেল কিশোরী ফুটবলাররা আনন্দের রেনু ছড়িয়ে পরে নেমে এলেন নিচে।
তাদের একজন পূজা রানি দাসের কণ্ঠে শুরুতেই পাওয়া গেল প্রতীক্ষার তীব্রতা, 'উনাদের আসার অপেক্ষায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি। বাফুফে ভবনে আমরা অনেক মজা করেছি। এখন উনাদের সঙ্গে মজা করব। মনে হচ্ছে, সময় যেন কাটছেই না।'
'অনুভূতিটা অনেক বেশি আনন্দের। উনারা চ্যাম্পিয়ন হতে সক্ষম হয়েছে। এটা বাংলাদেশের জন্য অনেক আনন্দের বিষয়, আমাদের জন্য আনন্দের বিষয়।'
আরও অনেকের মতো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেয়ে পূজাও ফুটবলে আসতে পেয়েছেন বাধা। তার আশা বড় এই অর্জন বদলে দেবে পুরো দেশের মানুষের চিন্তার কাঠামো, 'আমাদের সামনের কাজটা অনেক বেশি সহজ হবে। কারণ, বাঙালিরা দেখবে যে মেয়েরাও পারে। তারা অনেক বড় বড় জয় আনতে পারে। ওদিকের (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) অনেকে আছে যারা মেয়েদের খেলা পছন্দ করে না। হয়তো আপুদের এই বিজয় দেখে অনেকের চিন্তাভাবনা হবে যে ওরা যেহেতু পেরেছে, আমাদের মেয়েরাও পারবে।'
নারী ফুটবলে বাংলাদেশের সবচেয়ে নজরকাড়া দিক বৈচিত্র্য। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয় ঘটেছে এই দলে। পাইপলাইনেও দেখা যাচ্ছে এই চিত্র। পার্বত্য তিন জেলার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মেয়েরা উঠে আসছেন, প্রেরণা পাচ্ছেন এগুনোর। রাঙামাটির ফরোয়ার্ড উমেহা মারমা যেমন জানালেন এই ট্রফির মাহাত্ম, 'অনেক ভালো লাগা কাজ করছে। কীভাবে বলে বোঝাব আসলে বুঝছি না।'
'আপুরা চ্যাম্পিয়ন হওয়া মানে আমাদের একটা সাহস যোগানো। তারা চ্যাম্পিয়ন হলে ভবিষ্যতে আমরা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার প্রেরণা পাই।'
উমেহা নিজের এগুনের পথে অনুসরণ করার মতো আইডলও পেয়ে গেছেন এই সাফল্যে, 'আমার স্যারের থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছি। উনি আমাকে বলেছিলেন, "আসো, ফুটবল খেলো। তুমি ভালো করবে।" আমাকে অনেক সাহস যুগিয়েছিলেন। তাছাড়া, মনিকা আপু, ঋতুপর্ণা আপু উনাদের দেখে সাহস পেয়েছি যে উনারা পাহাড় থেকে খেলে এই বড় পর্যায়ে এসেছে, আমিও পারব।'
রাঙামাটির মেয়ে রূপনা চাকমা সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের গোলবারের ছিলে অতন্দ্র প্রহরী। নেপালের বিপক্ষে ফাইনালে তার মুন্সিয়ার ভিডিও এখন ভাইরাল। সেই রাঙামাটির আরেক মেয়ে থুই নু মারমা অনুকরণীয় নায়ক পেয়ে আগামীর স্বপ্ন বুনছেন, 'আনুচিং মারমাকে যখন দেখেছি, তখন মনে হয়েছে যে আমি ফুটবলার হব। আমি ক্লাস ফোর থেকে অনুশীলন করি, খেলি। তখন থেকেই আমার মনে হয়েছে, আমি আপুদের মতো বড় হব, খেলোয়াড় হব। আমার মা-বাবাকে সুখী রাখব। আমার ঋতু আপুকে অনেক পছন্দ।আমার প্রিয় খেলোয়াড় সাবিনা আপু।'
'আমার পরিবারের লোকজন বলছে, একদিন তুমিও এমন হবা। ভালো করে খেলো। সাপোর্ট বেশি দিচ্ছে। তারা বলেছে, "তুমি যদি ভালো করে খেলো, তাহলে পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারবা।"'
কয়েকজনের কথাতে বারবার উঠে এলো তাদের পরিবারের অর্থনৈতিক টানাপোড়নের গল্প। সেই তাগিদ থেকেও ভাল কিছু করতে মরিয়া তারা। ফুটবল খেলে যে অর্থনৈতিক সংকট মেটানো সম্ভব তাদের পরিবারও এখন অনুভব করছে কিছুটা। এরকমইটাই জানালেন ঐশী, 'আমার মনে হয় না সবার পরিবারের (আর্থিক অবস্থা) ভালো। আমাদের অনূর্ধ্ব-১৫ পর্যায়ে বেশিরভাগের পরিবারের অবস্থা দুর্বল। আমি যতটুকু সবার কাছ থেকে শুনেছি। তাই এই জয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ''
'পরিবারের লোকজনকে জানিয়েছি। তো আম্মু বলেছে, "আপুরা জিতেছে, তোমরাও ভালো করে খেলো যাতে এমন কিছু করতে পারো।"'
Comments