‘ভর্তুকি সুবিধা আমাদের কাছে পৌঁছায় না’

২০২২-২৩ অর্থবছরে, সরকার খামারের জন্য ভর্তুকি হিসেবে ১৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল, যেখানে ২০২১-২২ অর্থবছরে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ১২ হাজার কোটি টাকা।
‘ভর্তুকি সুবিধা আমাদের কাছে পৌঁছায় না’

সরকার গত ২ অর্থবছরে ২৮ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করেছে খামারে ভর্তুকি হিসেবে। তবে প্রান্তিক চাষিদের দাবি, তারা এর থেকে খুব বেশি সুবিধা পান না।

২০২২-২৩ অর্থবছরে, সরকার খামারের জন্য ভর্তুকি হিসেবে ১৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল, যেখানে ২০২১-২২ অর্থবছরে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ১২ হাজার কোটি টাকা।

আসন্ন অর্থবছরের জন্য সরকার ভর্তুকি বাড়িয়েছে এবং কৃষি ভর্তুকির জন্য ১৮ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববাজারে সারের দাম বেড়েছে। তাই সরকারকে ভর্তুকি বাড়াতে হয়েছে।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, 'শস্যের উৎপাদন বাড়াতে আমরা সাশ্রয়ী মূল্যে সার, বীজ, অন্যান্য উপকরণ এবং সেচ সুবিধা দিচ্ছি। ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ানোর উদ্দেশ্য এটাই।'

সংসদে তিনি আরও বলেন, 'এ ছাড়া সেচ পাম্পগুলোকে বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য বিদ্যুৎ বিলের ওপর ২০ শতাংশ ছাড় দেওয়া হয়েছে।'

এমনকি 'কৃষি উপকরণ সহায়তা' কার্ডের মাধ্যমে কৃষকের কৃষি উপকরণ ও ঋণ সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে এবং কার্ডধারী কৃষকের সংখ্যা এখন প্রায় ২ কোটিতে উন্নীত হয়েছে, বলেও জানান তিনি।

তবে দ্য ডেইলি স্টার বেশ কয়েকজন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছে, সরকারি সব উদ্যোগ ও ভর্তুকির পরও ধানের উৎপাদন খরচ অনেক বেশি হওয়ায় তাদের খুব বেশি লাভ হয়নি।

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রাজোশ গ্রামের কৃষক আব্দুর রউফ ৪ বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষ করেছেন। প্রতি বিঘা চাষের জন্য তাকে ১৮ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে (যার মধ্যে কিছু জমি লিজ নিয়েছিলেন, সেটার ব্যয়সহ) এবং বিঘা প্রতি ২৪ মণ ফলন আশা করছেন।

বর্তমান বাজারমূল্য অনুযায়ী, রউফ প্রতি মণ ধান (বিরি-২৯) ৯৬০ টাকায় বিক্রির আশা করছেন। সেই হিসাবে, তার মাত্র ৫ হাজার টাকা লাভ হতে পারে। ফলে ৪ বিঘা জমিতে ধান চাষ করে তার মোট লাভ হবে ২০ হাজার টাকা।

এই টাকা দিয়ে রউফকে আগামী ৬ মাস ৬ সদস্যের সংসার চালাতে হবে।

রউফ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা আশা করেছিলাম, সরকার কৃষি উপকরণের দাম কমাবে। তবে উল্টোটা করা হয়েছে। প্রতি মাসে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বেড়েছে, যার ফলে আমাদের জীবন ও জীবিকার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে।'

নওগাঁর আরেক কৃষক রেজাউল হাসান বলেন, 'সরকার যে ভর্তুকি দিচ্ছে তার কথা শুনেছি। তবে কৃষকদের এতে লাভ হচ্ছেন না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সরকার কৃষকদের জন্য যন্ত্রপাতি আমদানি করেছে, কিন্তু আমাদের জমি পানির নিচে চলে যাওয়ায় আমরা সেগুলো ব্যবহার করতে পারিনি।'

তিনি অভিযোগ করেন, 'আউশ ধানের জন্য সরকারের ভর্তুকি যাদের প্রয়োজন সেসব কৃষকের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। এর বেশিরভাগ সুবিধা পাচ্ছেন রাজনৈতিক প্রভাবশালী এবং তাদের অধীনস্থরা।'

নাটোরের শিংড়া এলাকার চলন বিলের কৃষক আলী হোসেন জানান, প্রত্যন্ত বিল এলাকায় যে সব কৃষক ধান চাষে পানি সেচের জন্য ডিজেল ব্যবহার করেন, ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাদের অনেকে ধান চাষ করেননি।

তিনি বলেন, 'তারা এবার ভুট্টা চাষ করেছেন, তার কারণ এতে সেচ কম লাগে'

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এম এ সাত্তার মণ্ডল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, প্রতি মণ ধানের দাম হওয়া উচিত ১ হাজার ৫০০ টাকা। তা না হলে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা চাষাবাদে আগ্রহ হারাবে।

তিনি আরও বলেন, 'ধানের দাম বাড়ানোর বিকল্প না থাকলে সরকারকে অবশ্যই উৎপাদন খরচ কমাতে কম দামে বীজ, সার, জ্বালানি ও বিদ্যুতের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে।'

'কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরকারের উচিত সঠিক হিসাব করে শস্য আমদানি করা।'

তিনি আরও বলেন, সরকারের উচিত কৃষি পণ্যের বাজার নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা।'

কৃষকদের মতে, গত কয়েক বছরে ধানের দাম ঠিক থাকলেও পাটের দাম তেমন একটা বাড়েনি। ২০২১ সালে পাটের দাম প্রতি মণ ৩ হাজার টাকার নিচে চলে যায়।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাইদুর রহমান বলেন, 'সরকারের উচিত কৃষিপণ্যকে বিদেশের বাজারে নিয়ে যাওয়া। বর্তমানে বাংলাদেশের কৃষিপণ্যের প্রধান ভোক্তা বাংলাদেশি ও ভারতীয়রা।'

তিনি আরও বলেন, 'আমাদের কৃষিপণ্য রপ্তানি বাজারে প্রবেশাধিকার পেলে কৃষকরা সেগুলো উৎপাদনে আরও বেশি আগ্রহী হবেন। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধিতে খাদ্য নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে।'

গতকাল সংসদে দেওয়া বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেন, ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, চা উৎপাদনে চতুর্থ, মাছে দ্বিতীয়, সবজি ও পেঁয়াজ উৎপাদনে তৃতীয় এবং আলু ও আম উৎপাদনে সপ্তম স্থানে রয়েছে।

তবে চলতি অর্থবছরে তিনি কৃষি খাতে মোট বাজেটের মাত্র ৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য কৃষি, খাদ্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের জন্য মোট ৩৫ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন।

আগের অর্থবছরে (২০২২-২৩) কৃষি খাতে বাজেট বরাদ্দ ছিল ৩৩ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা যা ওই বছরের মোট বাজেটের ৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ।

Comments