কঠিন সময়ের বাজেট

গত বছরের জুনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যখন ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন, মূল্যস্ফীতি ততদিনে ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করেছে। একই সময়ে কমতে শুরু করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।

এ দুই কারণে আগের দুই বছরের করোনা মহামারির ধাক্কায় হিমশিম খাওয়া দেশের অর্থনীতির পুনরুদ্ধার বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

এ অবস্থায় অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা ঠেকাতে, জীবনযাত্রার সংকট মোকাবিলা করতে এবং টাকার বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বেশ কিছু কৌশল অবলম্বনের কথা জানিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী।

তিনি সে সময় সতর্ক করেছিলেন যে এসব সমস্যা সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে না পারলে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হতে পারে। তার সেই সতর্কবার্তা সত্য প্রমাণিত হয়েছে এবং সামষ্টিক অর্থনীতি অস্থিতিশীল হয়েছে।

এরপর ১ বছর পেরিয়ে গেলেও এসব চ্যালেঞ্জ যথাযথভাবে মোকাবিলা করতে না পারায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। সবচেয়ে খারাপ বিষয় হলো, বাহ্যিক কারণ ও অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার ফলে চ্যালেঞ্জগুলো আরও তীব্র হয়েছে।

এর মধ্যে রিজার্ভ প্রায় ৩০ শতাংশ কমেছে, মূল্যস্ফীতি ১ বছর আগের তুলনায় ৩ শতাংশ পয়েন্ট বেড়েছে এবং মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য প্রায় ২৫ শতাংশ কমেছে। আর এর ফলে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাপন আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।

সব মিলিয়ে সাম্প্রতিক দশকগুলোর মধ্যে দেশের অর্থনীতি 'সবচেয়ে খারাপ সময়' পার করছে।

আগামীকাল বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রীকে টানা দ্বিতীয় বছরের মতো অর্থনৈতিক চাপ মোকাবিলার উদ্যোগ নিয়েই হাজির হতে হবে। কারণ, বিদায়ী অর্থবছরে গৃহীত ব্যবস্থা প্রত্যাশিত প্রতিকার এনে দিতে পারেনি।

সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, মূল্যস্ফীতি রোধ, সংস্কার শুরু এবং রিজার্ভ বাঁচানোর দিকেই বিশেষ নজর দিতে হবে তাকে।

অর্থমন্ত্রীকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ কর্মসূচির শর্ত অনুসারেও বেশ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

বাংলাদেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার সবচেয়ে বড় ২টি উৎস হচ্ছে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয়। এই ২ খাতে আয় বাড়ানোর ওপর অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত বাজেটে।

গত প্রায় ১ দশক ধরে বড় আকারে কর সংস্কার হয়নি এবং এই বিষয়টির সয়ংক্রিয়তাও ত্বরান্বিত হয়নি। একইভাবে, টানা ১১তম বছরের মতো ২০২২-২৩ অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হয়নি।

এই রাজস্ব আয় বাড়ানো কতটা সম্ভব হবে, তা নির্ভর করবে সরকারের কর প্রশাসন ও কর নীতিগুলো কতটা করদাতাবান্ধব হবে তার উপর।

নতুন অর্থবছরে ৯ শতাংশ সুদের হার নীতি প্রত্যাহার করা উচিত। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে নীতি ধরে রেখেছে।

একই সঙ্গে সত্যিকারের বাজার নির্ধারিত ও অভিন্ন মুদ্রা বিনিময় হার নীতিও জরুরি।

বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে দারিদ্র্য ও ক্রমবর্ধমান বৈষম্য হ্রাস, প্রবৃদ্ধি বজায় রাখা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে আরও অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।

২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকার রাষ্ট্রের ব্যয় মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নেওয়ার ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু বাজেট ঘাটতি পূরণে চলমান ধারার ব্যবসায়িক মনোভাব মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং আগামী অর্থবছরে মার্কিন ডলার সংকট আরও বাড়াতে পারে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, 'বাজেট ঘাটতি যতটা সম্ভব কম রাখতে হবে এবং যতটা সম্ভব কম খরচে বৈদেশিক অর্থায়ন জোগাড় করার ও সেগুলোর ব্যবহার বাড়ানোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে।'

সরকার ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জ্বালানির দাম বাড়িয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'সুতরাং, একটি সূত্রভিত্তিক মূল্য ব্যবস্থা প্রবর্তনে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। সরকার যদি এমন একটি মূল্য নির্ধারণের ব্যবস্থা নেয়, তাহলে দাম কমতে পারে। সেক্ষেত্রে মানুষ কিছুটা স্বস্তি পাবে।'

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেছেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটে সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় যে দুর্বলতা ১ বছর ধরে রয়েছে, তা অবশ্যই দূর করতে হবে।

তিনি বলেন, 'আমরা গত বছর সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা লক্ষ্য করেছি। এ বছর দুর্বলতা তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন বাজেটে এর সমাধান করতে হবে।'

নীতিগত পর্যায়ে গুরুতর সমস্যা রয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, 'আমরা সঠিক সময়ে সঠিক নীতি গ্রহণ করতে পারিনি। মুদ্রানীতি মূলত নিষ্ক্রিয় রাখা হয়েছে।'

আজ দেশের অর্থনীতি যে পথে এবং অর্থমন্ত্রী যে চড়াই-উৎরাইয়ের মাঝে আছেন, তাতে কেবল প্রত্যাশা করা যেতে পারে যে ২০২২-২৩ অর্থবছরে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল সেগুলো মূল্যায়ন করে এবং সেখান থেকে শিক্ষা নিয়েই তিনি নতুন বাজেট প্রণয়নে তা ব্যবহার করবেন।

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

7h ago