ত্রুটিপূর্ণ আইন, পদ্ধতি ও কাঠামোতেই কেন নতুন নির্বাচন কমিশন?
কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগের আড়াই মাস পরে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন রাষ্ট্রপতি। গত বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) সিইসি এবং চার নির্বাচন কমিশনারের নাম ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
২০২২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সিইসি হিসেবে নিয়োগ পান সাবেক সিনিয়র সচিব কাজী হাবিবুল আউয়াল। তাদের অধীনে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগের দাবি উঠলে গত ৫ সেপ্টেম্বর পুরো কমিশন একযোগে পদত্যাগ করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এরকম ঘটনা এটিই প্রথম। তার মানে আউয়াল কমিশনের মেয়াদ ছিল দুই বছর সাত মাস।
তাদের পদত্যাগের আড়াই মাস পরে সাবেক সচিব এএমএম নাসির উদ্দিনকে সিইসি করে পাঁচ সদস্যের কমিশন গঠন করা হয়। বাকি চার কমিশনার হলেন- সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ আবদুর রহমানেল মাসুদ, সাবেক যুগ্ম সচিব বেগম তহমিদা আহমদ এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ।
এটি একটি পুরোনো ফরম্যাট এবং ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পরে দেশ যখন একটি নতুন দিগন্তে যাত্রা করছে বলে দাবি করা হচ্ছে এবং দেশের মানুষের মধ্যেও একটা বড় ধরনের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, তখনও সেই পুরোনো পদ্ধতি এবং পুরোনো কাঠামোতেই কেন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলো, সেটিই প্রশ্ন।
প্রসঙ্গত, কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনের আগে নির্বাচন কমিশন গঠনের কোনো আইন ছিল না। সংবিধানে এরকম একটি আইন করার নির্দেশনা থাকলেও স্বাধীনতার ৫০ বছরেও এরকম আইন প্রণয়ন করা হয়নি। বরং রাষ্ট্রপতি তার বিবেচনায় যোগ্যদের নিয়ে কমিশন গঠন করতেন। আবার সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে যেহেতু সব কাজ করতে হয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গ পরামর্শক্রমে—অতএব কাদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে, সেটি যে একেবারেই নির্বাহী বিভাগ বা সরকার তথা প্রধানমন্ত্রীর একক সিদ্ধান্তের বিষয়, তা নিয়ে দ্বিমতের সুযোগ কম। তাছাড়া নির্বাচন কমিশন যেহেতু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি এবং তাদের অধীনেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, অতএব এই কমিশনে কাদেরকে নিয়োগ দেওয়া হবে সেটি মূলত একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয় হিসেবেই ছিল। বলা ভালো, প্রধানমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের পছন্দের বাইরে কোনো ব্যক্তির পক্ষে সিইসি বা নির্বাচন কমিশনার হওয়ার সুযোগ ছিল না।
এরকম বাস্তবতায় নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য একটি আইন প্রণয়নের দাবি ছিল দীর্ঘদিনের এবং সেই ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালে 'প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন' প্রণয়ন করা হয়। কোন প্রক্রিয়ায় কমিশন গঠন করা হবে তা এই আইনে বলা আছে। যদিও শুরু থেকেই বলা হচ্ছিল যে এটি একটি ত্রুটিপূর্ণ আইন। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে সেই ত্রুটিপূর্ণ আইন, ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতি ও ত্রুটিপূর্ণ কাঠামোতেই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলো—যাদের ওপর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থাকবে।
কেন এই আইন, পদ্ধতি ও কাঠামোটি ত্রুটিপূর্ণ, সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বলা দরকার, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. বদিউল আলম মজুমদার, অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ, জেসমিন টুলির মতো মানুষদের নিয়ে গঠিত নির্বাচনি ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন এখনও কাজ করছে। তারা বিভিন্ন অংশীজনের মতামত নিচ্ছে। কমিশনের সদস্যদের নিজস্ব ভাবনার সঙ্গে অংশীজনদের ভাবনার যোগ-বিয়োগ করছে এবং এই কমিশন দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য কিছু সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন সরকারকে দেবে। সুতরাং এই কমিশনের কাজ চলমান থাকা অবস্থাতেই কেন একটি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলো, সেটি আরেকটি প্রশ্ন। কেননা সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের আইনটি নিয়ে খোদ কমিশন সদস্যদেরই আপত্তি আছে বলে জানা যাচ্ছে। অর্থাৎ তারাও এই আইনটি পরিবর্তনের পক্ষে। সুতরাং এই কমিশনের প্রতিবেদন দেওয়া পর্যন্ত নতুন কমিশন গঠনের জন্য অপেক্ষা করলে খুব বড় কোনো ক্ষতি হতো বলে মনে হয় না।
কেন বিদ্যমান আইন, কাঠামো ও পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ?
আইনে বলা আছে, ছয় সদস্যের একটি অনুসন্ধান কমিটি সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন ১০ জন ব্যক্তির (প্রতিটি পদের বিপরীতে ২ জন) নাম রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেবেন এবং রাষ্ট্রপতি তার বিবেচনায় সেখান থেকে পাঁচজনকে নিয়ে কমিশন গঠন করবেন। সার্চ বা অনুসন্ধান কমিটি কোন প্রক্রিয়ায় এই নামগুলো সংগ্রহ করবে, সে বিষয়েও আইনে বলা আছে। যেমন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে নাম চাওয়া ইত্যাদি।
মুশকিল হলো, কোন ১০টি নাম চূড়ান্তভাবে রাষ্ট্রপতির কাছে দেওয়া হলো সেটি প্রকাশ করা হয় না। দ্বিতীয়ত, কোন কোন মানদণ্ডে অনুসন্ধান কমিটি ওই দশজনকে চূড়ান্ত করলো, সেটিও জানা যায় না। মোট কতগুলো নাম কমিটির কাছে এসেছিল এবং রাজনৈতিকদলগুলোর কাছ থেকে কতটি, নাগরিক সংগঠনগুলোর কাছ থেকে কতটি এবং একই নাম কতবার এসেছে, এই তথ্যগুলোও কমিটি বা রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে স্বপ্রণোদিতভাবে প্রকাশ করা হয় না বা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয় না।
যে পাঁচ জনকে চূড়ান্তভাবে নিয়োগ দেওয়া হলো, তাদেরকে কোন কোন যোগ্যতায় নিয়োগ দেয়া হলো, তাদের কর্মজীবনের বিস্তারিত তথা ট্র্যাক রেকর্ড কী—সেটিও নাগরিকের জানা উচিত। কিন্তু এই তথ্যগুলো জানানো হয় না। একটা দীর্ঘ শুনানির মধ্য দিয়ে এই কমিশন গঠন করা উচিত বলে অনেকেই মনে করেন। কিন্তু বিদ্যমান আইনে সেই বিধান নেই। ফলে দলীয় সরকারের আমলে যেমন সরকারি দল তথা প্রধানমন্ত্রীর পছন্দই শেষ কথা, অন্তর্বর্তী, তত্ত্বাবধায়ক তথা কোনো নির্দলীয় সরকারের আমলেও পদ্ধতি একই। রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিয়েছেন বলা হলেও কার্যত এটি নিয়োগ দিয়েছেন সরকার প্রধান। অর্থাৎ প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ নয়।
দ্বিতীয়ত, আইনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারের যে যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে সেটিও বৈষম্যমূলক। যেমন সিইসি এবং নির্বাচন কমিশনার হওয়ার জন্য তাকে সরকারি, আধা সরকারি, বেসরকারি বা বিচার বিভাগীয় পদে কমপক্ষে ২০ বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
এই আইনের একটি বড় ত্রুটি হচ্ছে সিইসি ও কমিশনারদের বয়স। আইনে বলা হয়েছে, তাদের বয়স কমপক্ষে ৫০ বছর হতে হবে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হতে গেলে যেখানে ন্যূনতম ৩৫ এবং প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য হতে গেলে ন্যূনতম ২৫ বছর হলেই হয়, সেখানে নির্বাচন কমিশনার হতে গেলে তার বয়স কেন ৫০ হতে হবে? ফলে এটি মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, এই বিধানের মধ্য দিয়ে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারের পদগুলোকে মূলত সাবেক সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য নির্ধারিত করে দেওয়া হয়েছে।
আইনে স্পষ্ট বলা না থাকলেও এখন নির্বাচন কমিশনের ফরম্যাট কী হবে সেটি দেশের একজন সাধারণ মানুষও বুঝতে পারেন। যেমন সেখানে তিনজন সাবেক আমলা, একজন সাবেক জজ এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদমর্যাদার একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা থাকবেন। আর এই পাঁচজনের মধ্যে একজন হবেন নারী। ফলে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার খোঁজার জন্য গত ২৯ অক্টোবর যেদিন সার্চ কমিটি গঠন করা হয়, সেদিনই ধারণা করা গিয়েছিল যে, এবারও হয়তো এমন পাঁচজনকে নিয়েই কমিশন গঠিত হবে এবং কার্যত তা-ই হয়েছে।
প্রশ্ন হলো, সাবেক আমলা, সাবেক বিচারক এবং অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তার বাইরে সমাজের আর কোনো অংশের কেউ কি সিইসি বা নির্বাচন কমিশনার হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না? এইসব পেশার বাইরে শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক ও নাগরিক সমাজের এমনও অনেক মানুষ রয়েছেন, যারা দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচনি ব্যবস্থা, সংবিধান ও আইন-কানুন নিয়ে কাজ করছেন। যাদের প্রশাসনিক দক্ষতাও রয়েছে। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক যদি উপাচার্য হওয়ার পরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে পারেন, তাহলে তিনি কেন নির্বাচন কমিশনার বা সিইসি হতে পারবেন না?
মূলত আমাদের পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাই যে আমলানির্ভর, ইসি আইনে তার প্রতিফলন স্পষ্ট। যারা সারা জীবন সরকারের নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন, অবসরে গিয়ে মোটা অংকের পেনশন পেয়েছেন আবার সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে আদর্শের রং ও ভোল পাল্টেছেন, তারাই ঘুরেফিরে রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদগুলোর দায়িত্ব পান। বছরের পর বছর ধরে এই যে দুষ্টুচক্র গড়ে উঠেছে, এটি ভাঙার সাহস কেউ করেন না। প্রশ্ন হলো, ৫ আগস্টের বিরাট পটপরিবর্তনের পরেও সেই পুরোনো পথের রেখায় কেন রাষ্ট্র হাঁটবে? এই অভ্যুত্থানের পরে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত যে 'সংস্কার'—সেই সংস্কার ইসিতে কেন অনুপস্থিত?
তবে এটিও অস্বীকার করার সুযোগে নেই যে, দেশের সবচেয়ে দক্ষ-যোগ্য ও ভালো মানুষদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করলেই তারা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারবেন না, যদি নির্বাচনের সকল অংশীজন এতে সহায়তা না করে। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে সরকার যদি না চায় তাহলে শুধু নির্বাচন কমিশনের পক্ষে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব নয়। যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব দল এটা বিশ্বাস না করে যে তারা সবাই ভালো নির্বাচন চায়—তাহলে একা ইসির পক্ষে খুব বেশি কিছু করা সম্ভব নয়। নির্বাচনের একটি বড় স্টেকহোল্ডার বা অংশীজন হচ্ছে গণমাধ্যম। অতএব নির্বাচন গণমাধ্যমের কী ভূমিকা থাকবে বা গণমাধ্যম কতটুকু স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারবে তার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করে।
নির্বাচনী সংস্কার কমিশন এইসব বিষয় নিয়েও কাজ করছে। এসব সংকটের সমাধানে তারা কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেবে বলে শোনা যাচ্ছে। সুতরাং সেইসব প্রস্তাব বা সুপারিশের আলোকে যদি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হতো, সেটি অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হতো।
যে পাঁচজনকে নিয়ে নতুন কমিশন গঠিত হলো তারা এই পদের যোগ্য নন, এমন কথা বলছি না। কিন্তু যে প্রক্রিয়া ও পদ্ধতিতে তাদের নিয়োগ দেওয়া হলো, সেটি পুনর্বিবেচনার অবকাশ রয়েছে। ত্রুটিপূর্ণ আইন, পদ্ধতি ও কাঠামোর মধ্যে থেকে খুব বেশি কিছু পরিবর্তন করা বা সত্যিকারের সংস্কার করা অসম্ভব।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক
Comments