জাতীয় বীরদের পুনর্বাসন

উন্নত চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের দাবিতে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) সামনে অবস্থান নিয়েছিলেন জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আহতদের একাংশ। তাদের কেউ কেউ হুইল চেয়ার বা ক্র্যাচে ভর দিয়েই সেখানে অবস্থান নেন। ছবিটি ১৪ নভেম্বর ভোররাতে তুলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের আলোকচিত্রী রাশেদ সুমন।

'নির্লজ্জ সে জাতি, যে জাতি তার বীরদের স্মরণ করে না'—ফিলিপাইনের বিপ্লবী নেতা হোসে রিজাল।

যে গণঅভ্যুত্থান স্বৈরাচারী শাসনকে উৎখাত করেছে, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যুব সমাজের গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজের আকাঙ্ক্ষায় পরিচালিত এ আন্দোলন একটি বিশাল বিজয় অর্জন করেছে। তবে এর জন্য অনেক বড় মূল্য দিতে হয়েছে। আনুমানিক এক হাজার ৬০০ জন প্রাণ হারিয়েছেন এবং ২২ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন, যার মধ্যে প্রায় ৫০০ জন সম্পূর্ণ শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিকার।

বাংলাদেশ যখন এই দুঃখজনক অধ্যায় থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে, তখন শহীদ পরিবার এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন একটি অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। এটি কেবল রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্বই নয়, বরং জাতির ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যন্ত জরুরি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, মূলধারার গণমাধ্যম, যাদের এই বিষয়টি তুলে ধরা উচিত ছিল, তাদের বেশিরভাগই এ ব্যাপারে নীরব। রাজনৈতিক দলগুলোও এই গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধানের চেয়ে নিজেদের ক্ষমতায় আসার বিষয়কেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।

জাতীয় বীরদের পুনর্বাসন কেন গুরুত্বপূর্ণ

যারা শহীদ বা আহত হয়েছেন, তারা গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, আইনের শাসন ও সমতার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন দেশের সব মানুষের হয়ে। তাদের গভীর ত্যাগকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা জাতির নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। পুনর্বাসন শুধু ওই পরিবারগুলোর প্রতি আমাদের ঋণ শোধের মাধ্যম নয়, এটি জাতীয় নিরাময় ও পুনর্মিলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

গণতন্ত্র উত্তরণের সংগ্রামে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সুষ্ঠু পুনর্বাসন দেশের নাগরিকদের মনোবল বাড়াবে। যখন জনগণ উপলব্ধি করে যে, দেশের জন্য যারা প্রাণ দেয় সমাজ তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়—সম্মান ও সহযোগিতা নিয়ে—তখন গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের পক্ষে দাঁড়ানোর মানুষের অভাব হয় না। এটি ভবিষ্যতের যেকোনো ন্যায়ভিত্তিক সংগ্রামে নাগরিকের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে, যা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন রক্ষায় অপরিহার্য ও একমাত্র কার্যকরী পন্থা।

পুনর্বাসনের কৌশল

অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের লক্ষ্যে কয়েকটি কমিশন গঠন করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের জন্যও একটি আলাদা কমিশন হতে পারে। রাষ্ট্রকে বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে ক্ষতিগ্রস্তদের তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি উভয় প্রয়োজনকেই সমভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় নিচের নির্দেশিকা একটি রোডম্যাপ হিসেবে কাজ করতে পারে:

সঠিক তালিকা প্রস্তুত: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো শহীদ ও যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করা। প্রকৃত ভুক্তভোগীদের একটি তালিকা দ্রুত প্রস্তুত করতে হবে, যাতে তথ্য হারিয়ে না যায় বা পরিবর্তিত না হয়।

তাৎক্ষণিক আর্থিক ক্ষতিপূরণ: একটি সমন্বিত পুনর্বাসন কর্মসূচি শুরু হওয়ার আগে ক্ষতিগ্রস্তদের জরুরি প্রয়োজন, যেমন: চিকিৎসা খরচ ও জীবিকা নির্বাহের জন্য দ্রুত আর্থিক সহায়তা দেওয়া দরকার। প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে গঠিত 'জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন'র মাধ্যমে তা নিশ্চিত করা যেতে পারে।

স্বাস্থ্যসেবা ও পুনর্বাসন সেবা: শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধকতার শিকার ব্যক্তিদের জন্য বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশাধিকার অপরিহার্য। আন্দোলনে আহত সব ব্যক্তির জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা, অপারেশন, কৃত্রিম অঙ্গ স্থাপন ও পোস্ট-ট্রমাটিক পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে। এই উদ্দেশ্যে একটি জরুরি বাজেট বরাদ্দ করা উচিত। বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে স্বেচ্ছায় সেবা প্রদানে উৎসাহিত করা যেতে পারে। নিজেদের আর্থিক সক্ষমতা অনুযায়ী আহত ব্যক্তিদের বিনামূল্যে সেবা প্রদান তাদেরও সামাজিক দায়িত্ব।

আজীবন পেনশন: শহীদ এবং সম্পূর্ণভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পরিবারের জন্য আজীবন পেনশনের ব্যবস্থা করতে হবে। পেনশনের পরিমাণ এমন হতে হবে যাতে একটি পরিবারের মৌলিক চাহিদা পূরণ হয়। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এক হাজার ৬০০ শহীদ পরিবার এবং ৫০০ সম্পূর্ণভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, মোট দুই হাজার ১০০ পরিবার রয়েছে। তাদের জন্য প্রতি মাসে ৪০ হাজার টাকা করে পেনশন প্রদানের জন্য বার্ষিক ১০০ কোটি ৮০ লাখ টাকা প্রয়োজন।

অন্যান্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রোগ্রাম: আংশিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে সমাজে পুনর্বহাল করা যেতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে:

  • প্রতিবন্ধীদের জন্য উপযুক্ত পেশাদারি প্রশিক্ষণ, যা তাদের উৎপাদনশীল কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেবে।
  • রাষ্ট্রের চাকরির কোটায় অগ্রাধিকার দেওয়া।
  • উদ্যোক্তা হতে ইচ্ছুক বা সম্ভাবনাময় ব্যক্তিদের জন্য সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ, ব্যবসায়িক প্রশিক্ষণ ও ক্ষুদ্র ঋণ সহায়তা দেওয়া।
  • ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য অগ্রাধিকার-ভিত্তিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বেসরকারি সংস্থাগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে। প্রতিবন্ধীদের কাজের জন্য বিশেষ ব্যবস্থার প্রয়োজন হলে (যেমন: বিশেষ ধরনের বসার ব্যবস্থা বা যন্ত্রপাতি) সরকার তা বিনামূল্যে সরবরাহ করতে পারে।
  • মৃত ও প্রতিবন্ধীদের সন্তানদের জন্য সর্বস্তরে বিনামূল্যে শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি: বীরদের জাতীয় স্বীকৃতি দিতে হবে। এটি শুধুমাত্র পরিবারগুলোকে সান্ত্বনাই দেবে না, বরং সমাজের জন্য স্বার্থহীন ত্যাগে জনগণকে উদ্বুদ্ধও করবে।

অর্থায়নের পরিমাণ ও সম্ভাব্য উৎস

গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের সহায়তায় একটি বিশেষ বাজেটের ব্যবস্থা করতে হবে। স্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে দেড় হাজার কোটি টাকার এককালীন বাজেট থেকে বরাদ্দ করে তা ১০ শতাংশ মুনাফা দেয় এমন একটি ফান্ডে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে চার হাজার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে মাসিক ৪০ হাজার টাকা করে পেনশন দেওয়ার পরও ফান্ডে অতিরিক্ত যে অর্থ থাকবে, তা পুনরায় বিনিয়োগ করলে মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব থেকে ফান্ডটি সুরক্ষিত থাকবে।

বাংলাদেশের জিডিপি ও বর্তমান জাতীয় বাজেটের আকার বিবেচনায় দেড় হাজার কোটি টাকা একটি নগণ্য পরিমাণ—কম গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে সামান্য পরিবর্তন করেই এটি ব্যবস্থা করা সম্ভব। এ ছাড়াও অল্প সময়েই এমন বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়, যা সরকারি কোষাগারে এর চেয়েও বেশি অর্থ সরবরাহ করতে পারে যেমন: প্রতারণামূলক মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করে তাদের সুবিধা বাতিল, দুর্নীতিবাজদের সম্পদ পুনরুদ্ধার এবং অটোমেশনের মাধ্যমে সিভিল সার্ভিসের আকার কমানো ইত্যাদি।

সাইফুর রহমান: জ্যেষ্ঠ তথ্য প্রযুক্তিবিদ ও সার্টিফায়েড প্রফেশনাল অস্ট্রেলিয়ান কম্পিউটার সোসাইটি

Comments