প্রত্যয় কেন চাপিয়ে দিতে হচ্ছে?

জুলাইয়ের মাঝামাঝি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের একটি ব্যাচের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা—যে প্রক্রিয়া আপাতত বন্ধ। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহেই কয়েকটি ব্যাচের নতুন সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হওয়ার কথা—সেটাও করা যায়নি। গুচ্ছ পদ্ধতির আওতায় ২০২৪-২০২৫ শিক্ষাবর্ষের নতুন শিক্ষার্থীদের ভর্তি কার্যক্রম চলার কথা—সেটাও স্থগিত।

এটা শুধু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের চিত্র নয়, সারা দেশের ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগেরই চিত্র। এই অনির্ধারিত বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রমের যে ক্ষতি হচ্ছে, তা নিশ্চিতভাবেই অপূরণীয়। আর সরাসরি শিক্ষকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শিক্ষাজীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত এই ছেদ পড়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যেও ক্ষোভ বাড়ছে।

অনেকেই শিক্ষকদের 'স্বার্থপর', 'স্বার্থ সচেতন' ও 'অবিবেচক' বলছেন। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের জিম্মি করছেন, এমন কথাও শোনা যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের এই কথাগুলো পুরোপুরি সত্য নয়। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা যে অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হচ্ছেন, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

'প্রত্যয়' নিয়ে সর্বাত্মক শাটডাউনের পর সরকারের তরফ থেকে অনেকেই কথা বলছেন, ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। ব্যাখ্যা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এক ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, এই আন্দোলন অযৌক্তিক। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে খানিকটা উষ্মার সঙ্গেই তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, কীসের সুবিধা কমে যাচ্ছে?

এদিকে ব্যাখ্যা দিয়েছে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষও। এক বিজ্ঞপ্তিতে ৬৫ বছর নয়, আজীবন পেনশনের কথা উল্লেখ করেছে। একইসঙ্গে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় সংশোধনীর কথাও বলা হয়েছে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের বিজ্ঞপ্তিতে।

আন্দোলনের শুরু থেকে বর্তমান পেনশন কাঠামোর সঙ্গে প্রত্যয় পরিকল্পনার দুর্বলতা ও শিক্ষকদের স্বার্থবিরোধী বিষয়গুলো ধরে ধরে দেখিয়ে দিয়েছেন শিক্ষকরা। এটা মোটামুটি পরিষ্কার, এই পরিকল্পনায় শিক্ষকরা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাদের আর্থিক সুবিধা কমবে, তৈরি হবে অনাকাঙ্ক্ষিত অনিশ্চয়তা। কিন্তু তারপরও সরকার অনড়। মাত্র ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে 'প্রত্যয়' কাঠামোতে বাধ্য করে আনতে সরকার যেন বদ্ধ পরিকর। কিন্তু কেন? কেন বাধ্য করতে হবে?

সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় নতুন পরিকল্পনা প্রণয়ন অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু একজন সুবিধাভোগীর জন্য নতুন পরিকল্পনা হতে হয় আগের চেয়ে অধিক সুবিধাসম্বলিত, সহজ ও নিরাপদ। যাতে একজন নাগরিক আগ্রহী হয়ে সেই পরিকল্পনায় যুক্ত হতে পারেন।

'প্রত্যয়' পরিকল্পনা যদি অধিক লাভজনক ও নিরাপদ হয়, তাহলে তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তা প্রত্যাখ্যান করার কথা না। বরং ফুল হাতে নিয়ে হুমড়ি খেয়ে সেই পরিকল্পনায় যুক্ত হওয়ার কথা। চারদিকে স্তুতিবাক্যের ফোয়ারা ছোটার কথা। কিন্তু তা না করে কেন শিক্ষকরা কঠোর আন্দোলনে, সেটা বুঝতে আইনস্টাইন হতে হয় না।

নিশ্চিতভাবেই শিক্ষকরা এই সামান্য ভালো-মন্দ বুঝতে পারার বিবেচনাবোধ রয়েছে। আর সভ্য কোনো দেশে কোনো আর্থিক ব্যবস্থাপনায় ঢুকতে কেউ কি বাধ্য করে? মাত্র ৩৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কেন বাধ্য করতে হবে? শিক্ষকরা যদি এই পরিকল্পনাকে সুবিধাজনক ও নিরাপদ মনে না করেন, তাহলে কেন তাদের জোর করতে হবে? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো কেউ না কেউ দেবেন।

অন্য একটি প্রসঙ্গ। 'প্রত্যয়' পরিকল্পনার সাফাই গেয়ে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের কর্তাব্যক্তিরা ভারতের উদাহরণ টেনেছেন। বলছেন, ২০০৪ সাল থেকে ভারতে এ রকম কাঠামো রয়েছে। হ্যাঁ, কথা সত্য। কিন্তু ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন স্কেল আর বাংলাদেশের স্কেল কি এক?

৩ জুলাই খোঁজ নিয়ে জেনেছি, পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন সহকারী অধ্যাপকের সর্বনিম্ন বেতন ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। বাংলাদেশে যা প্রায় অর্ধেক। আর বর্তমান বাংলাদেশের আর্থিক খাত কতটা নিরাপদ? যারা এ বিষয়ে একটু জানতে চান, দয়া করে মাত্র এক সপ্তাহের সংবাদপত্র পাঠ করুন।

হ্যাঁ, নানা বিবেচনায় ও হিসাবের মারপ্যাঁচে সরকারের কাছে 'প্রত্যয়' পরিকল্পনা ভালো মনে হতেও পারে। কিন্তু যারা সুবিধাভোগী, যারা এর আওতায় থাকবেন, তারা না চাইলে বাধ্য করতে হবে কেন? সেটাই বোধগম্য নয়। মাত্র ৩৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বাদ রাখলে কি সরকারের অনেক ক্ষতি? নাকি এর পেছনেও জটিল কোনো স্বার্থ সমীকরণ ও পরিকল্পনা আছে।

শেষ কথা, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলে কেন যেন দম বন্ধ লাগে। সামান্য একজন শিক্ষক হিসেবে ক্লাসে যেতে না পারার বিষয়টি আমাকে দগ্ধ করে। দয়া করে দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করুন, বিশ্ববিদ্যালয় খোলার ব্যবস্থা করুন। দম বন্ধ করা পরিস্থিতির অবসান করুন। নইলে শিক্ষার্থীদেরও বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

The Daily Star  | English

CA wraps up 4-day Davos trip after joining 47 events

He joined meetings with four heads of government or state, four ministerial-level dignitaries, 10 heads or top executives of UN or similar organisation, 10 CEOs or high-level business persons, nine programmes of the WEF, eight media engagements and two other events

30m ago