শিক্ষকরা কঠোর, সরকার অনড়, বড় ক্ষতি শিক্ষার্থীদের

নিশ্চিতভাবেই এই আন্দোলনে শিক্ষকদের দাবি ও যুক্তিগুলো যৌক্তিক। কিন্তু দাবি আদায়ে ক্লাস ও অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।

ঈদের ছুটি শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হয়েছিল ২৩ জুন। মাত্র দুই দিন পুরোদমে ক্লাস চলার পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫ জুন শুরু হয় আংশিক কর্মবিরতি। ২৫, ২৬ ও ২৭ জুন দুপুর ১টা পর্যন্ত কর্মবিরতি পালন করেন শিক্ষকরা। যদিও বেশিরভাগ বিভাগেই দুপুরের পর আর পুরোদমে ক্লাস হয়নি। এরপর ২৮ ও ২৯ জুন সাপ্তাহিক ছুটির পর ৩০ জুন পালিত হয় পুরোদিনের কর্মবিরতি। আর আজ ১ জুলাই থেকে শুরু হলো সর্বাত্মক কর্মবিরতি। ক্লাস, পরীক্ষা, দাপ্তরিক কাজ সব বন্ধ। মোটামুটি বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তালা লাগানোর মতো অবস্থা।

শিক্ষকদের এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ও  যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে কয়েকটি কথার স্পষ্ট উচ্চারণ খুবই প্রয়োজন। একমাত্র দুর্যোগ-দুর্বিপাক ছাড়া কোনো অবস্থাতেই দেশের কোনো স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ হওয়া উচিত নয়। চূড়ান্ত বিচারে এতে বড় ক্ষতি শিক্ষার্থীদের। শিক্ষাসূচির এই ছেদ অপূরণীয়। ন্যূনতম সংবেদনশীল ও অগ্রসর সমাজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কখনই এভাবে বন্ধ হয় না। কোরবানি ঈদের ছুটির পর মাত্র দুই দিন ক্লাস করে জগন্নাথের মতো সারাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে প্যাঁচে পড়লেন, তাতে ক্ষতি শুধু ছাত্র-ছাত্রীদের। এ ক্ষতি ব্যাপক, অপূরণীয়।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মবিরতির বিরুদ্ধে বলছি বলে আমি শিক্ষকদের আন্দোলনের বিরোধী, বিষয়টি তা নয়। এখানে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে চিন্তার সুযোগ আছে, আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা সরকার সমর্থক শিক্ষকরা ঠিক কেন চূড়ান্ত কর্মসূচি দিতে বাধ্য হলেন, সে বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে।

এবার আসা যাক আন্দোলনের যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে। মূল বিরোধ প্রত্যয় স্কিম নিয়ে। গত ১৩ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে পুরোনো পেনশন ব্যবস্থাপনার অধীনে থাকা স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত বা আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানের নতুন কর্মীদের জন্য ১ জুলাই থেকে বাধ্যতামূলকভাবে প্রত্যয় স্কিম চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়। যা দেশের বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন প্রত্যাখ্যান করে।

তাদের দাবি, এটি কোনো অবস্থাতেই সর্বজনীন স্কিম নয়। এ ছাড়া এই পরিকল্পনায় শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বার্থবিরোধী ও অস্পষ্ট বেশ কিছু ধারা রয়েছে। যা নিশ্চিতভাবেই শিক্ষকদের অনুকূল নয়। অনেকেই এর পেছনে শক্তিশালী আমলাতন্ত্রের ষড়যন্ত্র দেখেন। কারণ ২০২৩ সালে যখন সর্বজনীন পেনশন প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন শুরু হয়, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এর বাইরে ছিলেন। ২০২৩ সালের ১৭ আগস্ট যখন এই সর্বজনীন পেনশনের উদ্বোধন করা হয়, সেই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, 'এই পেনশন সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য নয়। এর বাইরের যে জনগোষ্ঠী, শুধুমাত্র তাদের জন্য এই ব্যবস্থাটা আমরা করে দিচ্ছি।'

সর্বজনীন পেনশন স্কিমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী যা-ই বলে থাকুন না কেন, চলতি বছরের ১৩ মার্চ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যুক্ত করে প্রত্যয় স্কিমের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। আর এরপরই শুরু হয় ধারাবাহিক আন্দোলন। যে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে বা সমন্বয় করছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। শুরু থেকেই সংগঠনটি বলছে, এই স্কিম বৈষম্যমূলক। এ ছাড়া বর্তমান ব্যবস্থায় পেনশনগ্রহীতা ও মনোনীত ব্যক্তি আজীবন পেনশন সুবিধাপ্রাপ্ত হন। একইসঙ্গে বর্তমানে পাঁচ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট পাওয়ার সুবিধা আছে। কিন্তু প্রত্যয় স্কিমে ৭৫ বছর পর্যন্ত পেনশনপ্রাপ্তির সুযোগ আছে, আজীবন নয়। সর্বজনীন স্কিমে ইনক্রিমেন্টের বিষয়টিও পরিষ্কার নয়। এ ছাড়া সরকারি চাকরিজীবীরা এখনো নতুন এই পরিকল্পনার বাইরে রয়েছে। যদিও সম্প্রতি সেবক নামের সরকারি কর্মচারীদের জন্য একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। যা কার্যকর হবে প্রত্যয় কার্যকরের এক বছর পর ২০২৫ সালের ১ জুলাই থেকে।

বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ও নীলদলের শিক্ষকদের নেতৃত্বে পরিচালিত বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের এই আন্দোলনে নতুন দুটি দাবি যুক্ত হয়েছে। বর্তমান বেতন কাঠামোয় সুপার গ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, কার্যকর করতে হবে শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল। যদিও এই দাবি দুটি খুব জরুরি বা মূল বিষয় বলে মনে হয় না। শিক্ষকদের মূল আপত্তি প্রত্যয় স্কিম। যার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে লাগাতার কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। গণমাধ্যমেও বিষয়টি নিয়ে সরব আন্দোলনরত শিক্ষকরা।

এই আন্দোলন নিয়ে একটি গণমাধ্যমকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বলেছেন, প্রত্যয় স্কিম নিয়ে আন্দোলনের যাওয়ার আগে তারা একটি বিশেষজ্ঞ দল দিয়ে নতুন এই পরিকল্পনাটি মূল্যায়ন করিয়েছেন। তাতে শিক্ষকরা দেখতে পেয়েছেন, চলমান কাঠামোর বিপরীতে প্রত্যয় স্কিম অর্থনৈতিকভাবে বৈষম্যমূলক, মানসিকভাবে নিপীড়নমূলক এবং সামাজিকভাবেও অসম্মানজনক। অধ্যাপক জিনাত হুদা শেষ কথায় বলেছেন, এই পরিকল্পনা চরম বৈষম্যমূলক, এক ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন। শিক্ষকদের বিশ্লেষণে বৈষম্যমূলক এই ব্যবস্থা নিয়ে ধারাবাহিক আন্দোলন চললেও যতদূর জানা যায়, এখনো পর্যন্ত দাপ্তরিকভাবে কেউ শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি, যা শিক্ষকদের আরও ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। ফলাফল আজ থেকে সর্বাত্মক কর্মবিরতি।

দেশের সব নাগরিকের জন্য পেনশন নিশ্চিতভাবেই একটি ইতিবাচক প্রকল্প। বিশ্বের উন্নত দেশের সব নাগরিক পেনশন পরিকল্পনার আওতায় থাকেন। বাংলাদেশেও সর্বজনীন এই পরিকল্পনা চালু হওয়া নিশ্চিতভাবেই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু যেসব প্রতিষ্ঠানে একটা গ্রহণযোগ্য কাঠামোয় আগে থেকেই পেনশন আছে, সেখানে 'বাধ্যতামূলক'ভাবে চাপিয়ে দেওয়াটা যুক্তিসঙ্গত নয়। যদি স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত বা আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানের চলমান পেনশন কাঠামোর বিপরীতে প্রত্যয় স্কিম অধিক আকর্ষণীয় ও সুবিধাসম্বলিত হয়, তাহলে শিক্ষকরা নিজ উদ্যোগেই সেখানে যাবেন। তাদের কেন বাধ্য করতে হবে। আর আন্দোলনরত শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপ করে বুঝতে পেরেছি, শিক্ষকরা সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনার ওপর পুরোপুরি আস্থাশীল নন। এর কারণ হিসেবে আর্থিক খাতের কেলেঙ্কারির কথা তারা তুলে ধরেছেন। যদিও সে কথাগুলো তারা প্রকাশ্যে বলছেন না।

শেষ কথায় আসা যাক, নিশ্চিতভাবেই এই আন্দোলনে শিক্ষকদের দাবি ও যুক্তিগুলো যৌক্তিক। কিন্তু দাবি আদায়ে ক্লাস ও অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। সেই বিষয়টি আমলে নেওয়া জরুরি। খুব জরুরি। তার আগে প্রয়োজন সরকারের সঙ্গে শিক্ষকদের দ্রুততম সময়ে বিস্তারিত আলোচনা। এই আলোচনা কবে শুরু হবে, কবে খুলবে শ্রেণিকক্ষের তালা, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Comments