নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপি ও জামায়াতের সুর কি অভিন্ন হচ্ছে?

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ইসির সঙ্গে বৈঠক শেষে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছিলেন, সংস্কার ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে নয় তাদের দল। জামায়াত মনে করে, নির্বাচন সংক্রান্ত জরুরি সংস্কারগুলো শেষ করেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়া উচিত।

এর দুমাস পর ১৬ এপ্রিল ঢাকায় সফররত মার্কিন কূটনীতিক দলের সঙ্গে বৈঠকের পর জামায়াত আমির শফিকুর রহমান বলেছেন, আগামী রমজানের আগে জাতীয় নির্বাচন হওয়া দরকার। জামায়াত মনে করে, আগামী বছরের জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করলে বর্ষা-ঝড়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসবে। তখন নির্বাচন অনিশ্চিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে। এজন্য জামায়াতের প্রস্তাব রমজানের আগেই যাতে নির্বাচন হয়ে যায়।

জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে জামায়াত যেদিন তাদের অবস্থান স্পষ্ট করলো, তার ঠিক আগের দিন গণমাধ্যমের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খবরের শিরোনাম 'লন্ডনে খালেদা জিয়ার সঙ্গে জামায়াত আমিরের সাক্ষাৎ'। খবরে বলা হয়, গত রোববার লন্ডনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন জামায়াত আমির শফিকুর রহমান ও নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।

লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বাসায় তাদের এ সাক্ষাৎ হয়। এ সময় তারেক রহমানও উপস্থিত ছিলেন। সুতরাং, লন্ডনে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সঙ্গে জামায়াতের দুই শীর্ষ নেতার সাক্ষাৎ এবং আগামী বছরের রোজার আগেই জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানানোর ঘটনাটি যে বিচ্ছিন্ন নয়—সেটি খুব পরিষ্কার।

একই দিন দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি ও নির্বাচনের রোডম্যাপ ইস্যুতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, 'আমরা স্পষ্ট করেই বলেছি, ডিসেম্বরের মধ্যে যদি নির্বাচন না হয়, তাহলে দেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে। সেটা তখন নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন হবে।'

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় মির্জা ফখরুল যে দীর্ঘ লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন সেখানেও তিনি বলেছেন, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য যেসব আইন, বিধি-বিধান সংস্কার এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর যেসব পরিবর্তন জরুরি, তা সম্পন্ন করার মাধ্যমে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্ভব।

স্মরণ করা যেতে পারে, গত বছর সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ১৮ মাসের মধ্যে যাতে নির্বাচন হতে পারে, সেজন্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো সম্পন্ন করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। রয়টার্সের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমি বলব যে এই সময়সীমার মধ্যেই আমাদের একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করা উচিত।'

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে গত বছরের ৮ আগস্ট। সেই হিসাবে ১৮ মাস হয় আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে। জামায়াত বলছে, তারা আগামী বছরের রোজার আগে নির্বাচন চায়। আগামী বছরের রোজা হওয়ার কথা ফেব্রুয়ারি মাসে। তার মানে রোজার আগে নির্বাচন হতে হলে জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারির শুরুতে হতে হবে।

এই টাইমলাইন সেনাপ্রধানের প্রত্যাশিত সময়ের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। আবার বিএনপি বলছে, তারা ডিসেম্বরেই নির্বাচন চায় এবং নির্বাচনের জন্য যেসব জরুরি সংস্কার প্রয়োজন সেগুলো ডিসেম্বরের মধ্যেই সম্ভব।

দেশের রাজনীতিক অঙ্গনে আলোচনা আছে, জামায়াত ডিসেম্বরে নির্বাচন করতে চায় না। ডিসেম্বর মাসের ব্যাপারে তাদের একধরনের 'অ্যালার্জি' আছে। সেটা ১৯৭১ প্রশ্নে।

যদি তাই হয়, তাহলে বিএনপির দাবি ডিসেম্বর এবং জামায়াতের দাবি রোজার আগে—মানে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে। তার সঙ্গে সেনাপ্রধানের ১৮ মাস। সব মিলেয়ে এই তিনটি বড় পক্ষের মধ্যে একটা মিল পাওয়া যাচ্ছে। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

কিছুদিন আগেও দেখা গেছে, নির্বাচন, সংস্কার ও বিচার প্রশ্নে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের একটা বড় ধরনের দূরত্ব ছিল। মূলত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের দূরত্ব সৃষ্টির প্রধান কারণ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিএনপির 'তাড়া' এবং তার বিপরীতে অন্তর্বর্তী সরকারকে সংস্কারের জন্য আরও বেশি সময় দিতে জামায়াতের নীতিগত অবস্থান। এই বাস্তবতায় বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতাও মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকার প্রসঙ্গ টেনে তাদের সমালোচনা করেছেন। এসব কারণে অনেকেরই মনে হচ্ছিলো, নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি ও জামায়াতের দূরত্ব আরও বাড়বে।

কিন্তু লন্ডনে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সঙ্গে জামায়াতের দুই শীর্ষ নেতার সাক্ষাতের পরে পরিস্থিতি যে অনেকখানি বদলে গেছে—তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

জামায়াতের আমির যদিও সাংবাদিকদের বলেছেন এটি নিতান্তই একটি সৌজন্য সাক্ষাৎ। যেহেতু বেগম জিয়া দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ এবং চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গিয়েছেন, আর ডা. শফিকুর রহমানও ব্যক্তিগত কাজে লন্ডনে গিয়েছিলেন, অতএব খালেদা জিয়ার শারীরিক খোঁজ-খবর নেওয়াটা জামায়াতের দায়িত্ব বলে তারা মনে করেছেন।

এটা হচ্ছে মিডিয়াকে দেওয়া ডা. শফিকুর রহমানের বক্তব্য। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দুটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলের প্রধান শুধুই সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন বা একজন আরেকজনের স্বাস্থ্যের খোঁজ নিতে গেলেও সেখানে যে রাজনীতির আলোচনা হয় না—সেটি ভাবার কোনো কারণ নেই। অন্তত এই মুহূর্তে, অর্থাৎ যখন দেশ একটি অন্তর্বর্তীকাল পার করছে; যখন নির্বাচন নিয়ে অস্পষ্টতা ও ধোঁয়াশা আছে—সেরকম একটি সময়ে দুটি অন্যতম প্রধান দলের প্রধানরা কথা বলবেন এবং সেখানে নির্বাচনের প্রসঙ্গ থাকবে না বা নির্বাচন ইস্যুতে তারা পরস্পরের স্বার্থ নিয়ে কথা বলবেন না—সেটা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

ফলে এটা মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়, তাদের মধ্যে আগামী নির্বাচনের দিনক্ষণ এবং নির্বাচনের কৌশল নিয়ে কথা হয়েছে। এর আরেকটি সম্ভাবনা এই কারণে যে, সাক্ষাৎ হাসপাতালে হয়নি। বরং জামায়াত আমির গিয়েছেন তারেক রহমানের বাসায়—যিনি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। উপরন্তু জামায়াত আমিরের সঙ্গে ছিলেন দলের আরেকজন সিনিয়র নেতাও। এটাও লক্ষণীয়।

সেখান থেকে ধরে নেওয়া যায় যে এটা নিতান্তই সৌজন্য সাক্ষাৎ ছিল না। এই সাক্ষাতে তারা অবশ্যই দেশের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন এবং নির্বাচন ও নির্বাচনী জোট নিয়ে কথা বলেছেন।

আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে যখই নির্বাচন হোক, সেটা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হলে বিএনপির জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা যেহেতু বেশি এবং তখন জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির ক্ষমতার ভাগাভাগি কী হবে—সেসব নিয়েও আলোচনা হয়ে থাকতে পারে। এসব নিয়ে খুব বিস্তারিত না হলেও অন্তত কৌশলগত আলোচনা যে হয়েছে তার প্রমাণ হলো, এই সাক্ষাতের পরেই জামায়াত স্পষ্টভাবে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে কথা বলেছে। নির্বাচন নিয়ে তাদের এমন স্পষ্ট অবস্থান গত আট মাসে এটিই প্রথম।

সুতরাং একই দিনে বিএনপি ও জামায়াতের এই বক্তব্য এবং তার সঙ্গে সেনাপ্রধানের প্রত্যাশিত ডেডলাইন মাথায় রাখলে নির্বাচন হয়তো আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে হতে পারে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকে।

আলোচনাটা সেখানেই যে, ফেব্রুয়ারি আসতে এখনও প্রায় ১০ মাস বাকি। অনেক সময়। মানবসন্তান মায়ের গর্ভে বেড়ে উঠে পৃথিবীতে আসতেও এত সময় লাগে না। সুতরাং এই ১০ মাসে দেশের রাজনীতিতে কী কী হবে; কী ঘটবে; কী কী ঘটানো হবে—তা এখনই বলা মুশকিল।

এই সময়ের মধ্যে যা যা ঘটবে তার ওপর নির্ভর করবে আসলেই সেনাপ্রধানের প্রত্যাশিত এবং বিএনপি ও জামায়াতের দাবিকৃত সময়ের মধ্যে নির্বাচন হবে কি না। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন না হলে যে দেশের অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে, সেই ইঙ্গিতও মির্জা ফখরুল দিয়েছেন।

রাজনীতি-সচেতন এবং সাধারণ মানুষের মনেও যে প্রশ্নটি আছে সেটি হলো, মৌলিক কিছু সংস্কার ছাড়া যদি আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হয়ে যায়, তাহলে কি রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোনো গুণগত পরিবর্তন আসবে? যদি না আসে তাহলে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হাজারো মানুষের প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার কী মানে আছে? অন্তত একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যে ধরনের প্রশাসনিক কাঠামো এবং যেরকম দলীয় ও রাষ্ট্রীয় প্রভাবমুক্ত নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রয়োজন, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

সেইসঙ্গে পাবলিক অফিস তথা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্নীতিমুক্ত করার ক্ষেত্রে যদি এই সরকার বড় ধরনের এবং একটি কার্যকর সংস্কার করে যেতে না পারে, তাহলে দেশ যে তিমিরে ছিল, সেখানেই থাকবে।

সুতরাং কিছু মৌলিক সংস্কারের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোকে একমত হতে হবে এবং রাজনৈতিক দলের ভেতরে যে পরিবারতন্ত্র ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতার চর্চা—সেখানেও যদি কাঙ্ক্ষিত সংস্কার না আসে, তাহলে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে হয়তো একটি দলের বদলে আরেকটি দল ক্ষমতায় আসবে—কিন্তু আখেরে দেশ ও মানুষের কোনো কল্যাণ হবে না।


আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক

Comments

The Daily Star  | English
Mahdi Amin, adviser to BNP acting chairperson Tarique Rahman

‘BNP’s 31-point charter embodies public will’

Mahdi Amin, adviser to BNP acting chairperson Tarique Rahman, speaks to The Daily Star

12h ago