পাহাড়ে ফরেস্টার খুন এবং সুইমিং পুল ও বাস্কেট বল মাঠ
পার্বত্য জেলা বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে ব্যাংক ডাকাতির খবর গণমাধ্যমের শিরোনাম হলেও এই মুহূর্তে দেশের পাহাড়গুলো আলোচনায় আছে অন্য তিনটি ঘটনায়।
১. কক্সবাজারে পাহাড় বাঁচাতে গিয়ে ট্রাকচাপায় বন কর্মকর্তা খুন
২. পাহাড় কেটে সুইমিংপুল; সাজেকের 'মেঘপল্লী' রিসোর্টকে ২ লাখ টাকা জরিমানা
৩. কুমিল্লায় পাহাড় কেটে নির্মিত হচ্ছে বাস্কেটবল মাঠ
প্রথম খবরে নজর দেওয়া যাক।
কক্সবাজারের উখিয়ায় রাতের আঁধারে কোথাও না কোথাও অবৈধভাবে পাহাড় কাটা চলে। এই অপতৎপরতা ঠেকাতে নিয়মিত অভিযান চালায় বন বিভাগ। সেই ধারাবাহিকতায় গত ৩১ মার্চ রোববার সেহেরির সময় ডাম্পারযোগে পাহাড়ের মাটি পাচার করার খবরে সেখানে অভিযানে যান উখিয়া রেঞ্জের দোছড়ি বিট কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামান সজল।
মোটরসাইকেল চালিয়ে তিনি এবং তার সহকর্মী মোহাম্মদ আলী ঘটনাস্থলে গিয়ে ডাম্পারটি থামানোর সংকেত দিলে মাটিভর্তি ডাম্পার গাড়িটি তাদের চাপা দিয়ে চলে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই মর্মান্তিক মৃত্যু হয় সজলের। আহত হন সঙ্গে থাকা মোহাম্মদ আলী।
শোনা যায়, পাহাড়ে ডাম্পার চালকদের বেশির ভাগ অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং তাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। প্রতিদিন তাদের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। গণমাধ্যমের খবর বলছে, গত দুই বছরে অন্তত ১০ জন খুন হয়েছেন ডাম্পারের ধাক্কায়।
প্রশ্ন হলো, যারা পরিবেশ রক্ষার দায়িত্বে আছেন, তাদের নিরাপত্তা কতটুকু? নিরাপত্তারক্ষীদের জীবন যখন অনিরাপদ, তখন তারা কী করে দুর্বৃত্তদের হাত দেশের পাহাড় ও বনজ সম্পদ বাঁচাবেন?
বন ও পাহাড় সুরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিতদের সুরক্ষা সামগ্রী পর্যাপ্ত কি না; সেই প্রশ্নটি বেশ পুরোনো। তাছাড়া দিনের পর দিন সুন্দরবন ও পাহাড়ের বিচ্ছিন্ন ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় যারা দায়িত্ব পালন করেন, তাদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধাই বা কতটুকু—সেই প্রশ্নও আছে।
যদিও বন ও পাহাড় সুরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত অনেকের বিরুদ্ধেই রাষ্ট্রীয় সম্পদ বেচে দেওয়া বা দুর্বৃত্তদের সহযোগিতার অভিযোগ আছে।
যেমন: এক-এগারোর সরকারের সময়ে বনখেকো ওসমান গনি একটি আলোচিত চরিত্রে পরিণত হয়েছে। তার বাসার বালিশের ভেতর থেকে বিপুল টাকা উদ্ধার হয়েছিল। কিন্তু বন বিভাগের সকলেই ওসমান গনি নন।
গণমাধ্যমের খবর বলছে, নিহত বন কর্মকর্তা সজল কোনো ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। বরং পাহাড় থেকে মাটি ও গাছ কেটে নেওয়া ঠেকাতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতেন বলে তিনি স্থানীয় দস্যুদের রোষানলে ছিলেন—এমনটিও শোনা যাচ্ছে। যদি তা-ই হয়, তাহলে এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
বাস্তবতা হলো, যে দেশে শত কোটি বা হাজার কোটির নিচে এখন কোনো রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন প্রকল্প হয় না, সেখানে দেশের সম্পদ বাঁচানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের 'নিধিরাম সর্দার' বানিয়ে রাখলে পাহাড়-বন-নদী সবই বেহাত হয়ে যাবে।
দ্বিতীয় খবরের ঘটনাস্থল দেশের জনপ্রিয় পর্যটন স্পট সাজেক।
রাঙামাটির পর্যটন উপত্যকা সাজেকে পাহাড় কেটে সুইমিং পুল তৈরি হচ্ছে—এমন একটি ছবি গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে এবং পাহাড় কেটে সুইমিংপুল নির্মাণের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি রিট হয়।
এরপর সম্প্রতি 'মেঘপল্লী' রিসোর্টে অভিযান চালায় স্থানীয় প্রশাসন। তারা ওই সুইমিং পুল তৈরির কাজ বন্ধ করে দেয় এবং দুই লাখ টাকা জরিমানা করে।
প্রশ্ন হলো, পাহাড় কেটে সুইমিং পুল বানাতে হবে কেন? সাজেকে যারা ঘুরতে যান, তারা কি পাহাড় দেখতে যান নাকি সাঁতার কাটতে? সাজেক ভ্রমণকারীদের প্রধান আকর্ষণ বর্ষায় মেঘ ও পাহাড়ের মিতালি। সেখানে সুইমিং পুলের উপযোগিতা কতটুকু?
'মেঘপল্লী' নামে ওই রিসোর্ট মূলত পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা এবং আরও বেশি টাকায় এর রুম ভাড়া দেওয়া জন্যই যে এখানে সুইমিং পুল বানানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু সৌন্দর্যবর্ধন এবং ব্যবসা বাড়ানোর জন্য রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করা যে ফৌজদারি অপরাধ—সেই বোধটুকু হয়তো কর্তৃপক্ষের মনে ছিল না।
তবে প্রশাসন যে কাজ বন্ধ করে দিয়ে জরিমানাও করেছে, এটি একটি ভালো উদাহরণ তৈরি হলো এবং আশা করা যায় ভবিষ্যতে সাজেকে আর কেউ এই ধরনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের সাহস পাবেন না।
তৃতীয় খবরটির কুমিল্লার।
গণমাধ্যমের খবর বলছে, লালমাই পাহাড়ের পাদদেশে নির্মিত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না নিয়ে আবারও পাহাড় কাটা হচ্ছে। আর এই পাহাড় কাটা হচ্ছে বাস্কেটবল খেলার মাঠ বানানোর জন্য। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটিকে 'পাহাড় কাটা' বলতে নারাজ। তারা এটিকে বলছেন 'পাহাড় ড্রেসিং'।
দেশের মানুষের কাছে 'পাহাড় ড্রেসিং' শব্দটা খুব অদ্ভুত মনে হতে পারে। তবে এটা যতটা না অদ্ভুত তার চেয়ে বেশি উদ্ভট। কারণ, পাহাড় ড্রেসিং করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কেউ দেয়নি বা এই ধরনের অনুমতি দেওয়ার সুযোগও নেই।
পাহাড় একটি প্রাকৃতিক সম্পদ। সে তার মতো থাকবে। এখানে ড্রেসিংয়ের নামে তার মাটি কেটে ফেলা কিংবা পাহাড়ের বড় গাছ কেটে ফুলের গাছ লাগিয়ে সৌন্দর্য বর্ধনও পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতিবিরুদ্ধ।
'পাহাড় ড্রেসিং' শব্দটির সঙ্গে 'নদী শাসনের' মিল আছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীগুলো শাসন, খনন, সংস্কার ও উন্নয়নের নামে কী দশা করা হয়েছে, তার অনেক ভয়াবহ উদাহরণ এরইমধ্যে তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের মগজে শাসন ব্যাপারটি এতই শক্তভাবে প্রোথিত যে, তারা মানুষ তো বটেই, নদীকেও শাসন করতে চান। অথচ শব্দটি হওয়ার কথা ছিল নদী ব্যবস্থাপনা। নদীকে শাসন করার আপনি কে? আপনি কি নদীর অভিভাবক? নদী তার আপনবেগে চলবে। মানুষের সুবিধা অনুযায়ী বড়জোর সেটিকে ব্যবস্থাপনার আওতায় আনবে। কিন্তু যখনই বলা হয় নদী শাসন, তখনই বোঝা যায়, কর্তৃপক্ষ নদীর গতিপথ ও চরিত্র বদলে তার সুবিধা অনুযায়ী ব্যবহার করতে চায়। কেননা তার মাথার ভেতরে প্রকল্প। 'পাহাড় ড্রেজিং' শব্দটির সম্ভবত একটি আমলাতান্ত্রিক পরিভাষা।
প্রশ্ন হলো, বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের জন্য পরিবেশের জন্য সংবেদনশীল স্থান কেনে বেছে নিতে হবে? তারচেয়ে বড় প্রশ্ন, বাংলাদেশের মতো একটি ছোট্ট আয়তনের দেশে প্রতিটি বিভাগে একাধিক এবং পারলে জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে কেন?
একটি বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের মানেই হলো বিপুল পরিমাণে কৃষিজমি অধিগ্রহণ। নদী-খাল-পুকুর ও প্রাকৃতিক জলাশয় ভরাট করে সেখানে উঁচু উঁচু দালান নির্মাণ। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে এরকম হাজার হাজার বা লাখ লাখ ভবন বানাতে বানাতে একটা সময়ে ফসল আবাদের মতো কোনো জমি থাকবে কি না; মাছের জন্য কোনো নদী ও জলাশয় থাকবে কি না; পাহাড়ের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য গাছ ও ভূমির ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য পাহাড় থাকবে কি না—সেটি বিরাট প্রশ্ন।
তবে আশা জাগাচ্ছে চট্টগ্রাম।
সাম্প্রতিক খবর হলো, চট্টগ্রামের টাইগারপাস থেকে সিআরবিমুখী পাহাড়ি রাস্তার মাঝের ঢালে এলিভিটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প নির্মাণের যে প্রস্তাব করেছিল চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, আন্দোলনের মুখে তা সংশোধনের আশ্বাস দিয়েছে সিডিএ।
অর্থাৎ নাগরিকদের আন্দোলনের মুখে পিছু হটেছে তারা। আন্দোলনকারীদের দাবি, টাইগারপাস-সিআরবি এলাকার দ্বিতল সড়ক নষ্ট করে এবং গাছ কেটে ওই স্থানে কোনো র্যাম্প তারা চান না।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রামের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে নিউমার্কেট-কদমতলি এলাকা থেকে যেসব যানবাহন উঠবে, সেগুলোর জন্য টাইগারপাস-সিআরবির দ্বিতল সড়কে একটি র্যাম্প নির্মাণ করার প্রস্তাব আছে সিডিএর প্রকল্প পরিকল্পনায়। বিষয়টি জানার পর আন্দোলনে নামে চট্টগ্রামের একাধিক নাগরিক সংগঠন।
পরিশেষে, মানুষকে জাগতে হবে। প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হবে। নদী, পাহাড়, বন ও প্রাকৃতিক সব সম্পদের মালিক যে রাষ্ট্রের জনগণ, সেই মালিকানার বোধটি জাগ্রত করতে হবে।
বিপুল জনসংখ্যার ভারে ন্যূব্জ ছোট্ট আয়তনের একটি দেশের লাইফ লাইন নদী, পাহাড়, বন ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ বেহাত হয়ে গেলে কিংবা বিপন্ন হলে যে আখেরে দেশের মানুষই বিপন্ন হবে—সেই উপলব্ধিটা জরুরি।
নদীর পলি জমে জন্ম বলে যে দেশের নাম নদীমাতৃক; অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর উর্বর জমির কারণে মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইলের দেশে ১৮ কোটি বা তারও বেশি যে মানুষ অন্তত খেয়েপরে বেঁচে আছে; কৃষিনির্ভর অর্থনীতির কারণে দেশে যে অন্তত খাদ্য সংকট নেই—সেই দেশ থেকে নদী, জলাশয়, বন, ফসলের জমি নষ্ট করে কোনো ধরনের শিল্প-কারখানা, কোনো রাস্তা, কোনো অবকাঠামো গড়ে তুলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বসবাস অনুপযোগী দেশ গঠন প্রক্রিয়া প্রতিহত করতে এখনই পাড়ায়-মহল্লায় সচেতন নাগরিকদের প্লাটফর্ম গড়ে তোলা দরকার।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন
Comments