আজীবনের ‘খলনায়ক’ টিআইবির প্রতিবেদন থেকে শিক্ষা নিন এবং তাদের প্রাপ্য সম্মান দিন
'দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া ট্র্যাকিং' নামে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি), যা ৫০টি নির্বাচনী এলাকায় দীর্ঘ সাত মাস জরিপ চালিয়ে তৈরি করা হয়েছে। প্রত্যাশিতভাবেই আওয়ামী লীগ সরকার, আরও সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে সরকারের তিনজন মন্ত্রী এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন।
এই গবেষণায় জানা গেছে, 'একপাক্ষিক' নির্বাচনটিকে 'পাতানো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ' করা হয়েছে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'এটা বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত।'
তিনি জানান, ২০২৩ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যে আটটি বিভাগের ৩০০টি নির্বাচনী এলাকা থেকে দৈবচয়ন ভিত্তিতে ৫০টি নির্বাচনী আসন বেছে নিয়ে এই গবেষণা পরিচালনা করা হয়েছে এবং নির্বাচনের দিন জরিপের আওতাভুক্ত প্রতিটি এলাকায় একাধিক অনিয়ম চিহ্নিত হয়েছে।
প্রতিবেদনটি প্রকাশ পেতে না পেতেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অভিযোগ করেন, 'যে ভাষায় বিএনপি কথা বলে, সেই একই ভাষায় টিআইবি কথা বলে।' বিষয়টিকে তিনি আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে দাবি করেন, 'টিআইবি বিএনপির দালাল।' তার এই মন্তব্য আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় ২০০৬ সালে বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব মান্নান ভুঁইয়ার দেওয়ায় একই ধরনের একটি মন্তব্যকে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, 'বিএনপির ভাষা আর টিআইবির ভাষা মিলে গেছে।' তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত বলেন, 'জাতীয় নির্বাচন শেষ হওয়ার ১০ দিনের মধ্যে টিআইবি এই গবেষণা করেছে এবং বেশ কিছু উপসংহারে পৌঁছেছে। আমি জানি না কীভাবে এত অল্প সময়ের মধ্যে এই গবেষণা পরিচালনা করা সম্ভব।' যদিও প্রতিবেদনটি ১০ দিনে নয়, বরং ২০২৩ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত মোট সাত মাস সময় নিয়ে তৈরি করা হয়েছে।
স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর থেকে বাংলাদেশের গত ৩৩ বছরের রাজনীতি সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞানও যাদের রয়েছে, তারাও জানেন যে—সব ব্যাপারেই বিপরীত অবস্থানে থাকে আমাদের শীর্ষ দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। কিন্তু একটি বিষয় বা সংস্থার ব্যাপারে এই দুই দল সব সময় একমত। বলতে পারবেন সংস্থাটির নাম কী? উত্তরটি হচ্ছে টিআইবি, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) বাংলাদেশ অধ্যায়।
১৯৯৬ সালে ট্রাস্ট হিসেবে যাত্রা শুরু করা টিআইবি ১৯৯৮ সালে এনজিও হিসেবে নিবন্ধিত হয়। ২০০১ সালে প্রথমবারের মতো বৈশ্বিক দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) প্রতিবেদন প্রকাশ করে টিআই। বছরটি ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তৎকালীন মেয়াদের (১৯৯৬-২০০১) শেষ বছর। সেই সিপিআই প্রতিবেদনে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় শীর্ষে জায়গা পায় বাংলাদেশ।
এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর তুলকালাম কাণ্ড শুরু হয়ে যায় বললেও হয়তো কম বলা হবে।
কেবল প্রশংসা ছাড়া বাকি সবকিছুতেই ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে পেতে অভ্যস্ত আওয়ামী লীগ স্বভাবতই নজিরবিহীন আক্রোশসহ তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বলে, মাত্র কয়েক মাস পরে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের মানহানির 'ষড়যন্ত্র' ছাড়া এই প্রতিবেদন আর কিছুই না। ক্ষমতাসীন থাকায় সেই সময় আওয়ামী লীগের প্রচারযন্ত্রও ছিল বেশ শক্তিশালী এবং সেটাকে কাজে লাগিয়ে তারা নবগঠিত টিআইবির বিরুদ্ধে সমন্বিত বিষোদগার করতে থাকে।
তখন বারবার বলা হয়েছে যে এই প্রতিবেদনটি বাংলাদেশ-ভিত্তিক সংস্থা টিআইবির নয়, বরং বার্লিন-ভিত্তিক সংস্থা টিআইয়ের এবং এই প্রতিবেদন তৈরিতে টিআইবির কোনো ভূমিকা নেই। কিন্তু সেসব কথা কানে তোলেনি কেউই।
অপরদিকে, সিপিআই প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিএনপির বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। তারা এই প্রতিবেদনটিকে আওয়ামী লীগ বিরোধী প্রচার-প্রচারণার সবচেয়ে খাঁটি প্রমাণ হিসেবে ধরে নেয়। টিআইবির প্রতি সেইসময়ে বিএনপির প্রশংসারও কোনো অন্ত ছিল না।
কিন্তু ২০০২ সালে যখন বিএনপি ক্ষমতায় ফিরল, তখন প্রত্যাশিতভাবেই তাদের সুর পাল্টে গেল। বিএনপিও টিআইবির প্রতি আক্রোশ দেখিয়ে আক্রমণ করতে থাকে। আওয়ামী লীগ তখন টিআইবির প্রশংসায় এবং বিএনপি টিআইবিকে তিরস্কারে ব্যস্ত।
২০০২ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে টানা চারবার বাংলাদেশ দুর্নীতিতে শীর্ষস্থানে থাকে। তখন বিএনপি বলতে থাকে, টিআইবি একটি আওয়ামীপন্থী সংস্থা এবং খালেদা জিয়ার সরকারকে সরিয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনাই তাদের গোপন এজেন্ডা।
এ ছাড়া, টিআইবি তাদের নিজস্ব গবেষণায় দুর্নীতি দমনে বিএনপি সরকারের ব্যর্থতা এবং কীভাবে সারা দেশে সংক্রামক রোগের মতো দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে, তা উন্মোচন করে। ২০০৬ সালে বিএনপির আক্রোশ এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, তারা ৬৪ জেলায় টিআইবির বিরুদ্ধে মামলা করে তাদের সব শাখা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেয়।
সংস্থাটির একটি প্রতিবেদনে স্থানীয় সরকারের দুর্নীতির চিত্র বিশেষভাবে উঠে আসে। ফলে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন মন্ত্রী ও বিএনপি মহাসচিব মান্নান ভুঁইয়া টিআইবিকে হেয় করার বিষয়টিকে ব্যক্তিগত যুদ্ধ হিসেবে নেন এবং সরকারযন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে সংস্থাটিকে হয়রানি, অসম্মান ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন। বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীরা লালমনিরহাট ও ফরিদপুরে টিআইবির অন্তত দুটি শাখা ভাঙচুর করেন এবং সংস্থাটির তরুণ স্বেচ্ছাসেবকদের মারধর করেন।
বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন টিআইবির প্রতি আওয়ামী লীগের প্রশংসাবাণী ঝরেছে বর্ষার বৃষ্টির মতো অঝোর ধারায়। আওয়ামী লীগের মতে, টিআইবির মতো সাহসী ও সত্যনিষ্ঠ সংস্থা যেন আর হয় না।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতাসীন হলে রাতারাতি তাদের সুরও পাল্টে যায়। জাতীয় খানা জরিপ প্রতিবেদনের মাধ্যমে আইনি সেবায় সর্বোচ্চ দুর্নীতির চিত্র উন্মোচিত হলে কুমিল্লা, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামে আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা টিআইবির বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন, যার প্রতিটির অভিযোগ ছিল হুবহু একই।
দুটি দলের শাসনামলেই টিআইবিকে তিরস্কার করার সংস্কৃতি সংসদীয় আলোচনাতেও অব্যাহত থাকে।
'পার্লামেন্ট ওয়াচ' নামে টিআইবির একটি প্রতিবেদনে জাতীয় সংসদের কার্যকারিতার ক্ষেত্রে দুর্বলতার বিষয়গুলো উন্মোচিত হলে এর বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান প্রয়াত বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সাবেক সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তিনি টিআইবির নিবন্ধন বাতিল করে দেওয়ার হুমকি দেন এবং তার তৈরি করা খসড়ার ভিত্তিতে সংসদে বৈদেশিক অনুদান (স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম) রেগুলেশন আইন, ২০১৬ তে একটি ধারা যোগ করা হয়—যার মাধ্যমে আজও এনজিওগুলোর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
এই ধারা অনুযায়ী, সংসদ ও সকল সংসদীয় সংস্থার সমালোচনা ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। যার ফলে শুধু টিআইবি নয়, বরং সার্বিকভাবে এনজিও খাত এবং যারাই সুশাসন ও অধিকার নিয়ে কাজ করেন, তাদেরকে ভয়ভীতি প্রদর্শনের উপযোগী একটি পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
উভয় দলের শাসনামলেই মন্ত্রী ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা ধারাবাহিকভাবে টিআইবির অর্থায়নের উৎস নিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, হাস্যকর ও ভিত্তিহীন সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। অথচ, এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর নিরবচ্ছিন্ন নজরদারির কারণে সংস্থাটির অর্থায়নের উৎস সম্পর্কে সবার আগে সরকারই জানতে পারে।
বিএনপি সরকার ধারণা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালায় যে টিআইবি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান এনরন ও ওয়ার্ল্ডকমের কাছ থেকে তহবিল পায় এবং আওয়ামী লীগ সরকার অভিযোগ আনে, টিআইবি অস্ট্রেলীয় মাইনিং প্রতিষ্ঠান বিএইচপির কাছ থেকে তহবিল পায়। অথচ, এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে টিআইবির কোনো যোগসূত্রই নেই।
উভয় সরকারের আমলেই টিআইবিকে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা, যেমন: এনজিও বিষয়ক ব্যুরো ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সুনির্দিষ্টভাবে হয়রানি করেছে এবং বিভিন্ন সরকারি সংস্থা তাদের নজরদারিতে রেখেছে।
প্রশ্ন হলো—এত বছর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে টিআইবির সমালোচনা ও চরিত্রহনন করে কোনো ক্ষমতাসীন সরকার কি একটুও উপকৃত হয়েছে? তারা যদি টিআইবির প্রতিবেদনগুলো আরও ভালো করে যাচাই-বাছাই করত, তাহলে কি আরও উপকৃত হতে পারত না? সেক্ষেত্রে সরকারগুলো জানতে পারত যে টিআইবির লক্ষ্য হচ্ছে রাষ্ট্র ও এর সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আরও সক্ষম ও বলিষ্ঠ করে তুলতে সহায়তা করা।
প্রতি বছর টিআইবি সরকারি সংস্থাগুলোর দুর্নীতির মাত্রা সম্পর্কে ধারণা দিতে ১০ থেকে ১২টি গবেষণা পরিচালনা করে এবং প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সংস্কারের সুপারিশ করে। তাদের অন্যতম প্রধান গবেষণা হলো দুই বছর পর পর পরিচালিত 'সেবাখাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ'। এই জরিপ প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার, ভূমি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, আয়কর, পাসপোর্ট সেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে দুর্নীতির মাত্রা সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করা হয়।
এই গবেষণা এতটাই বিস্তারিত ও তথ্যবহুল যে চাইলে এখান থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই সরকার জনগণের ভোগান্তি বড় আকারে লাঘব করতে পারে। কিন্তু, এই প্রতিবেদনগুলোকে কখনোই ভালোভাবে যাচাই-বাছাই না করে বরং তাৎক্ষণিকভাবে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখানো হয় এবং এগুলোকে ভিত্তিহীন ও হুমকি হিসেবে দেখা হয়।
বর্তমান সরকার টানা চতুর্থ মেয়াদ শুরু করেছে। এ অবস্থায় আমরা আশা করি যে তারা আগের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সব ধরনের সমালোচনামূলক প্রতিবেদন ও মতামত যাচাই না করেই নাকচ করে দেওয়ার প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসবে। আশা করি, এবার তারা সমালোচকদের শত্রু হিসেবে না দেখে স্বাধীন গণমাধ্যমসহ সবধরনের সমালোচনাকারী কণ্ঠস্বরকে আরও পরিপক্বতার সঙ্গে মোকাবিলা করবে এবং বাস্তব সত্যকে আমলে নিয়ে সেই অনুযায়ী কাজ করবে।
মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার
অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments