প্রধানমন্ত্রীর ‘লৌহমানবী’ হয়ে ওঠা উচিত ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে’

প্রধানমন্ত্রীর ‘লৌহমানবী’ হয়ে ওঠা উচিত ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে’
ইলাস্ট্রেশন: আনোয়ার সোহেল

টানা চতুর্থ মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণ করেই গত ১৫ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, 'আমি কোনো ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম সহ্য করব না।' তিনি বলেছেন, 'স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি' নিশ্চিত করতে হবে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করে স্বচ্ছ প্রশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি আমাদের কানে যেন ভাঙা ক্যাসেটের মতো বাজে। কারণ, কথাগুলো এতো বেশি বলা হয়েছে যে এর বিশ্বাসযোগ্যতাই হারিয়ে গেছে। তারপরও আমরা এগুলো শুনতে চাই। কারণ, অন্তহীন বিশ্বাস এবং অনেকের মতে নির্বোধের মতো প্রত্যাশা নিয়ে আমরা অপেক্ষায় থাকি যে এবার বুঝি সত্যি সত্যিই কথাগুলো বাস্তবে রূপ নেবে।

দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকায় (১৩ থেকে ১৯ জানুয়ারির সংস্করণ) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে 'দক্ষিণ এশিয়ার লৌহমানবী' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এর পেছনে সম্ভাব্য কারণগুলোর মধ্যে থাকতে পারে গত ১৫ বছরে তার দেশ পরিচালনার প্রক্রিয়া, জাতীয় নির্বাচনে নিজের ও দলের জন্য পঞ্চম মেয়াদে বিজয় নিশ্চিত করা এবং তার সমালোচক, বিরোধী দল বিএনপি ও সার্বিকভাবে সব বিরুদ্ধমতের দমন।

তবে, এই মুহূর্তে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সবচেয়ে কঠোর হয়ে তিনি প্রকৃতপক্ষেই হয়ে উঠতে পারেন সেই লৌহমানবী, যাকে আমাদের প্রয়োজন।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ২০২৩ সালের মে থেকে জুলাইয়ের মাঝে একটি জরিপ পরিচালনা করে, যার শিরোনাম ছিল 'বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশ ২০২৩'। গত ১৭ জানুয়ারি এই জরিপের ফলাফল প্রকাশিত হয়। জরিপে অংশগ্রহণকারী ব্যবসায়ীদের ৬৭ দশমিক ছয় শতাংশ মনে করেন, বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনায় সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে দুর্নীতি। বিভিন্ন খাতের বড়, মাঝারি ও ছোট প্রতিষ্ঠানের ৭১ জন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এই জরিপে অংশ নেন। জরিপ অনুযায়ী, ঘুষের ক্ষেত্রে সামান্য অগ্রগতি হলেও ব্যবসায়িক কার্যক্রমে দুর্নীতির সার্বিক প্রভাব এখনো উদ্বেগের সবচেয়ে বড় কারণ।

মোটা দাগে বলতে গেলে মানুষ দুইভাবে দুর্নীতি করে। একটি অংশ কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও দুর্নীতি করে। আরেকটি অংশ প্রয়োজনে আইন নিজেদের মতো পরিবর্তন করে দুর্নীতি করে। আজকের দিনে বাংলাদেশে দ্বিতীয় অংশটি অনেক বড় ব্যবধানে প্রথম অংশের চেয়ে এগিয়ে আছে।

নির্মম ও দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, দ্বিতীয় অংশটির বেশিরভাগ সদস্য প্রধানমন্ত্রীর আশেপাশেই থাকেন এবং তাদের অনেকে আনুষ্ঠানিক পদমর্যাদাও পেয়েছেন—যারা আমাদের অর্থনীতি ও দেশকে বড় আকারে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন। আমরা যদি সবচেয়ে বড় ঋণখেলাপি, অর্থ পাচারকারী, কানাডা ও মালয়েশিয়ার 'বেগমপাড়ার' বাসিন্দাদের কথা ধরি, তাহলে দেখতে পাবো যে তাদের অনেকেই ক্ষমতার কেন্দ্রের চারপাশেই রয়েছেন। তারা ক্ষমতাশীলদের কাছাকাছি থাকার সুযোগ নিয়ে দূর থেকে 'সৎ মানুষদের টিটকারি' করেন এবং কখনো যদি কোনো সংস্থা তাদের বিরুদ্ধে কোনো রকমের তদন্ত করতেও যায়, তাহলে ক্ষমতাসীনদের পাশে থাকার এই বিষয়টিকেই তারা সুরক্ষা-বর্ম হিসেবে ব্যবহার করেন।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে 'শূন্য সহনশীলতা' নীতির প্রতি সাধারণ মানুষের ভরসা আনতে প্রধানমন্ত্রীর প্রথমেই যে কাজটি করা উচিত তা হলো, 'ইচ্ছাকৃত' ও 'পরিস্থিতির শিকার' হয়ে যারা ঋণ খেলাপি হয়েছেন তাদের আলাদা করা এবং 'ইচ্ছাকৃত' ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। এই মানুষগুলো সুকৌশলি ব্যাংক ডাকাত ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রথাগত ডাকাতরা রাতের অন্ধকারে যে কাজটি করেন, তা এই মানুষগুলো করেন প্রকাশ্য দিবালোকে। এমনকি এই সুকৌশলি ব্যাংক ডাকাতদের আইনি জটিলতার ঝামেলাও নেই।

দেশ থেকে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়, তার বেশিরভাগই খেলাপি ব্যাংক ঋণ থেকেই আসে বলে ধারণা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এই মানুষগুলো ব্যাংক থেকে জেনে-বুঝেই ঋণ নেন এবং সেই অর্থ বিদেশে 'হুন্ডি'র মাধ্যমে পাচার করেন। ঋণের অর্থ ফিরিয়ে দেওয়ার কোনো অভিপ্রায়ই তাদের থাকে না।

সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো, আইনভঙ্গের জন্য শাস্তি না দিয়ে উল্টো তাদেরকে সুযোগ দেওয়ার জন্য আইনগুলোই বারবার সংস্কার করা হয়েছে এবং ঋণ পরিশোধে আরও সময় দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে খারাপ বিষয়টি হলো, আগের ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য তাদেরকে নতুন ঋণ দেওয়া হয়েছে। সেই অর্থেরও একটি অংশ বিদেশে পাচার করা হয় এবং ব্যাংকগুলো আরও বড় খেলাপি ঋণের হিসাব কষতে থাকে। এভাবে 'ইচ্ছাকৃত' ঋণখেলাপিদের প্রতি অবিশ্বাস্য রকমের শিথিলতা দেখে যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করেন, তারা নিজেদেরকে নির্বোধ মনে করতে শুরু করেন।

আরও যে জায়গায় প্রধানমন্ত্রীকে নজর দিতে হবে তা হলো, প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সীমা ও বাজেট বাড়ানোর বিষয়টি। পাচার হওয়া অর্থের বড় একটি অংশের জোগান দিচ্ছে এই খাত। শুধু তাই নয় এর ফলে বড় আকারে জাতীয় সম্পদের অপচয় হচ্ছে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণা অনুযায়ী, ২০১২-১৩ থেকে ২০২১-২২ এই ১০ অর্থবছরের মধ্যে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ৩৬১টি প্রকল্পের মধ্যে ২৮৯টির (৮০ দশমিক ৬ শতাংশ) সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে, ২০১টির (৫৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ) বাজেট বাড়ানো হয়েছে এবং ১৭৯টির বাজেট ও সময়সীমা উভয়ই বাড়ানো হয়েছে।

গবেষণা থেকে আরও জানা যায়, প্রকল্প শেষ করতে এক মাস দেরি হলে খরচ প্রায় এক শতাংশ (শূন্য দশমিক ৯৫ শতাংশ) বেড়ে যায়। ভূমি অধিগ্রহণ, কার্যাদেশ দেওয়া, দর কষাকষি, উপদেষ্টা নিয়োগ ইত্যাদি কাজ সময়মতো শেষ বা শুরু না হওয়ার কারণে প্রকল্পের সময়সীমা ও খরচ বাড়ে।

বিআইডিএসের মতে, এসবের জন্য মূলত দায়ী দক্ষ জনবলের অভাব।

আমাদের ধারণা, দশকের পর দশক প্রকল্পের খরচ ও সময়সীমা বাড়ানোর যে ধারা এবং এগুলো বন্ধে আমাদের যে ব্যর্থতা, তা দৈবক্রমে হয়নি। এগুলো চালিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট প্রণোদনা রয়েছে, যা আমাদের সরকারি কোষাগার প্রায় খালি করে ফেললেও ব্যক্তিবিশেষের পকেট ভারি করছে।

আমরা অবিলম্বে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সংস্থা গঠনের সুপারিশ করছি, যার প্রধান হবেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই। এই সংস্থার কাজ হবে প্রয়োজনীয় সংস্কার সুপারিশ করা, যার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াটিও প্রধানমন্ত্রী নিজেই দেখভাল করবেন।

আমরা যদি কয়েকটি মেগা প্রকল্প সময়মতো বাস্তবায়ন করতে পারি, তাহলে বাকি সবগুলো না হলেও, বেশিরভাগ প্রকল্পই সময়মতো বাস্তবায়িত হবে। একটি বিশেষ মহল প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হলে আর্থিকভাবে লাভবান হয় এবং তারাই এ ধরনের সংস্কার এখন পর্যন্ত ঠেকিয়ে রেখেছে।

এখানে আরও কিছু সুপারিশ তুলে ধরছি, যেগুলো সরকার চাইলে শিগগির বাস্তবায়ন করতে পারবে।

বাংলাদেশের মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) কার্যালয়কে আরও শক্তিশালী করার বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। এই কার্যালয়ে আরও কর্মী ও ক্ষমতা দিন। শুরুতেই সিএজির সাম্প্রতিক প্রতিবেদনগুলো আমলে নিন এবং সবচেয়ে বড় অনিয়মগুলো তদন্ত করুন। বর্তমানে এই প্রতিবেদনগুলো রাষ্ট্রপতি এবং সংসদের কাছে জমা দেওয়া হয়। সংসদের সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি এগুলো যাচাই-বাছাই করে এবং জবাবদিহি নিশ্চিতের জন্য কিছু উদ্যোগ নেয়।

তবে আমাদের জানা মতে, দুর্নীতি ও অনিয়মে নিমজ্জিত বিভাগ ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সিএজিকে তার সক্ষমতা অনুযায়ী ব্যবহার না করা এবং তাদের প্রতিবেদনকে কম প্রাধান্য দেওয়ায় জবাবদিহি নিশ্চিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সংস্থার সার্বিক গুরুত্ব একেবারেই কমে গেছে।

মন্ত্রণালয়গুলোর সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিতের অন্যতম উপায় হল বিভাগীয় পর্যায়ে অডিট প্রক্রিয়াকে বলিষ্ঠ করা। এই প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে থাকলেও তা কেবলই আনুষ্ঠানিকতায় আটকে আছে। এই সংস্থাটিতে যদি একজন ক্ষমতাবান প্রধান থাকেন, যিনি সরাসরি মন্ত্রীর কাছে জবাবদিহি করবেন, তাহলে প্রশাসনিক কার্যক্রমে আকাশ-পাতাল পার্থক্য দেখা যাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) প্রকল্প বাস্তবায়নের ওপর অত্যন্ত সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায় গবেষণা পরিচালনা করে এবং এর ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি করে—বিশেষ করে, খরচ ও সময়সীমা বৃদ্ধির বিষয়ে। আমাদের বেশিরভাগ প্রকল্প খরচ ও সময়সীমার বেড়ে যাওয়ার ফাঁদে কীভাবে ধুকতে থাকে তার সীমিত তবে সুচারু চিত্র এই প্রতিবেদনগুলোতে উঠে আসে। এই সংস্থাটিকে শক্তিশালী করা হলে তা প্রকল্প দেখভালের একটি উপযোগী প্রক্রিয়া হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে। আইএমইডির আঞ্চলিক শাখা প্রতিষ্ঠা দীর্ঘদিনের দাবি। প্রকল্পে নজরদারি আরও বাড়াতে এই দাবি বাস্তবায়ন জরুরি বরে আমরা মনে করি।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কার্যক্রমে আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত। প্রায়শই এই সংস্থাটিকে নখদন্তহীন বাঘ বা কাগুজে বাঘ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে এই সংস্থাটিকে উপযোগী করে তোলার দিকে অবিলম্বে নজর দিতে হবে। আমরা মনে করি, আইনের সংস্কার এবং আরও উপকরণ ও জনবল দেওয়া উচিত দুদকে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, দুদকের স্বায়ত্তশাসন ও তদন্ত সক্ষমতার উন্নয়ন ঘটাতে হবে।

যে বিষয়টি আমরা বলতে চাচ্ছি তা হলো, অডিট ও মনিটরিংয়ের বিষয়টিকে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের কাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে নিতে হবে। দশকের পর দশক ধরে এর বিপরীত কাজ চলতে থাকায় এটি বাস্তবায়নই হবে প্রধানমন্ত্রীর জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ।

আজকের দিনে বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার পথে সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে দুর্নীতি। এর কারণে সরকারি সংস্থাগুলোর প্রতি সাধারণ মানুষের ভরসা নষ্ট হচ্ছে। যেসব সংস্থা বিভিন্ন সেবা দেয়, সেখানে 'ঘুষ' না দেওয়া পর্যন্ত কোনো কাজ হয় না। খুব কম জায়গায় আছে যেখানে ঘুষ না দিয়ে কাজ করানো যায়।

আমাদের উন্নয়নকে ধারণার চেয়েও বেশি বাধাগ্রস্ত করে রেখেছে এই দুর্নীতি। এর বিরুদ্ধে 'শূন্য সহনশীলতা' বাস্তবায়ন করতে হবে 'শূন্য সময়ক্ষেপণ' করে।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

10h ago