সম্পাদক মাহফুজ আনামের ৩০ বছর

আরও গৌরবান্বিত হোক সাংবাদিকতা

গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা মানুষগুলোর স্বার্থরক্ষা ও মুক্ত গণমাধ্যমবিরোধী আইনের কলেবর বাড়তে থাকায় আইনের মোড়কে হেনস্তার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা এখন এক ক্রমবর্ধমান বাস্তবতা। তারপরও আমরা দ্য ডেইলি স্টারে সাংবাদিকতা পেশার সবচেয়ে উত্কৃষ্ট দৃষ্টান্ত তৈরির ক্ষেত্রে বদ্ধপরিকর থাকি এবং এর ফল যাই হোক না কেন, পাঠকের সম্মান ও আস্থা অর্জনে অবিচল থাকার চেষ্টা করি।

কেবলমাত্র পাঠকের অকুণ্ঠ সমর্থনের কারণেই 'সম্পাদক হিসেবে আমার পথ চলা' সম্ভব হয়েছে। শুভানুধ্যায়ী ও বিজ্ঞাপনদাতাদেরও ধন্যবাদ, যারা আমাদেরকে সেই আর্থিক অবস্থানে পৌঁছাতে সহায়তা করেছেন যা ছাড়া কোনও স্বাধীন সংবাদপত্র টিকে থাকতে পারে না। আমি দ্য ডেইলি স্টারের আলোকিত, সৎ ও নৈতিক পরিচালনা পর্ষদের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা জানাই, যাদের একটি স্বাধীন ইংরেজি দৈনিকের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করার মতো দূরদৃষ্টি ছিল এবং যারা মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে সহায়তা করতে দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছেন।

৫২ বছরের সাংবাদিকতা (১৯৭৩ সালের মে মাসে আমি বাংলাদেশ অবজারভারে যোগ দেই) এবং ৩০ বছর দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর তরুণ সহকর্মীদের প্রতি আমার শুধু এটুকুই বলার আছে—সাংবাদিক হিসেবে গর্বিত হোন (অহংকারী নয়) এবং এই পেশাকে আরও গৌরবান্বিত করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করুন। এই গর্ব যেন আমাদের পেশা নিয়ে সাধারণ মানুষকেও আরও গর্বিত করে তুলতে পারে, সেই চেষ্টা করুন।

এই গর্বের কারণ হলো, আমাদের পেশাটি সমাজের কল্যাণে নিবেদিত। আমরা জনগণ ছাড়া আর কারো সেবা করি না; কোনো ক্ষমতা, সম্পদ বা প্রভাবের কাছে মাথা নত করি না এবং কেবলমাত্র সত্যই আমাদের পাথেয়। একজন সৈনিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগে যেমন জানে যে দেশের জন্য প্রয়োজনে তাকে প্রাণ দিতে হবে, তেমনি আমরাও এই পেশায় এটা জেনেই যোগ দেই যে আমাদেরকে সব ধরনের হয়রানি, অপমান, শাস্তি, কারাবাস, এমনকি মৃত্যুর মুখোমুখিও হতে হবে—এই মৃত্যুর ধারা আবার ক্রমশ বাড়ছে—এবং এর সবই পাঠকদের সেবায়। তবে, একজন সৈনিককে তখনই আত্মদান করতে হয় যখন তার দেশ কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে আছে কিংবা তার দেশের ভেতরে কোনো গুরুতর সংকট চলছে। কিন্তু একজন সাংবাদিকের হেনস্তা হওয়ার ও শাস্তি পাওয়ার সম্ভাবনা নিত্যদিনের।

গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা মানুষগুলোর স্বার্থরক্ষা ও মুক্ত গণমাধ্যমবিরোধী আইনের কলেবর বাড়তে থাকায় আইনের মোড়কে হেনস্তার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা এখন এক ক্রমবর্ধমান বাস্তবতা। তারপরও আমরা দ্য ডেইলি স্টারে সাংবাদিকতা পেশার সবচেয়ে উত্কৃষ্ট দৃষ্টান্ত তৈরির ক্ষেত্রে বদ্ধপরিকর থাকি এবং এর ফল যাই হোক না কেন, পাঠকের সম্মান ও আস্থা অর্জনে অবিচল থাকার চেষ্টা করি।

আমাদের অতীত যতই উজ্জ্বল হোক না কেন, সাংবাদিকতার প্রতি জনসাধারণের আস্থা আরও শক্তিশালী করা জরুরি। এর জন্য আমাদেরকে আরও কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, ক্ষমতাসীনদের আরও কার্যকর প্রশ্ন করতে হবে, আরও বেশি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করতে হবে, অধিকার বঞ্চিত জনগণের পাশে দাঁড়াতে হবে, পণ্যের মূল্য বৃদ্ধিকারী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে লড়তে হবে, যে দুর্নীতির কারণে প্রকল্পের খরচ বেড়ে যায় তা উন্মোচন করতে হবে, অর্থপাচারকারীদের মুখোশ খুলে দিতে হবে, স্বেচ্ছায় যারা ঋণখেলাপি হয় তাদের সামনে আনতে হবে—এক কথায়, যা কিছু দেশ ও জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাচ্ছে, সেসব কিছুকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

আমাদের পাঠক, দর্শক, বিজ্ঞাপনদাতা ও শুভানুধ্যায়ীদের সামনে আরও বিশ্বাসযোগ্য, নির্ভীক ও সৎ সাংবাদিকতার দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে হবে, যাতে তারা আমাদের কাজ নিয়ে আরও গর্বিত হতে পারেন। কখনোই ভুলে গেলে চলবে না যে আমাদের একমাত্র শক্তি হচ্ছে জনগণের সমর্থন। বিশ্বাসযোগ্যতা, সুনাম ও জনগণের আস্থার মাধ্যমেই কেবল সরকার, দুর্নীতিবাজ ও ক্ষমতাবানদের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে পারবো। এগুলো অর্জনে সততা, পেশাদারিত্ব ও সাহসী সাংবাদিকতার কোনো বিকল্প নেই।

কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির প্রতি জমে থাকা ক্ষোভ, ব্যক্তিস্বার্থ, দ্বন্দ্ব ও ঘৃণা যেনো আমাদেরকে কখনো পরিচালিত না করে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা যখন সফল হতে থাকবো, তখন আমাদের আশেপাশে অনেক নতুন বন্ধুর আনাগোনা দেখা দেবে। তাদের বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, কারণ তাদের এই বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণের অর্থ এই না যে তাদের উদ্দেশ্য মহৎ।

গত বুধবার দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক হিসেবে আমার ৩০ বছর পূর্তি হলো। এ উপলক্ষে আমার সহকর্মীরা এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আমাকে সম্মানিত করেছে। ৩০ বছর আগে দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও প্রকাশক সৈয়দ মোহাম্মদ আলীর অকাল প্রয়াণ ঘটে—যিনি বেশিরভাগ মানুষের কাছে এসএম আলী এবং আমাদের কাছে আলী ভাই ছিলেন। তার মৃত্যুর পর আমাকে এই পত্রিকার নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ দেয় দ্য ডেইলি স্টারের সত্ত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান মিডিয়াওয়ার্ল্ডের পরিচালনা পর্ষদ।

এটা ছিল আমার জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। আলী ভাইয়ের মতো একজন মানুষের স্থলাভিষিক্ত হওয়া ছিল কল্পনাতীত। তার মতো প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা আমার ছিল না এবং তার ভূমিকায় কাজ করার মতো নেতৃত্বের গুণাবলী, পরিচিতি ও আত্মবিশ্বাসও ছিল না। আমার একমাত্র শক্তি ছিল কাজের প্রতি অঙ্গীকার ও সততা। সাংবাদিকতা ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের দিক থেকে বাংলাদেশকে সেরা ইংরেজি দৈনিক উপহার দিতে আমি বদ্ধপরিকর ছিলাম, কিন্তু তারচেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল ক্ষমতাসীনদের সামনে সত্য তুলে ধরা। এই লক্ষ্য পূরণে আমি আমার সব শক্তি ও বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগাতে বদ্ধপরিকর ছিলাম। আমার আরেকটি শক্তি হচ্ছে আমার পরিবার, বিশেষ করে আমার স্ত্রী। আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়গুলোতে তিনি আমার পাশে ছিলেন। এমনকি, কর্মীদের বেতন দেওয়ার জন্য তার কাছ থেকে টাকা ধারও নিতে হয়েছে আমাকে।

শুরুর দিকে দ্য ডেইলি স্টারের এগিয়ে যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে সহায়ক হয়েছিল তৎকালীন রাজনৈতিক পরিবেশ। রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর থেকে দেশ পরিচালনা করছিল। তার এক বছরের মধ্যেই ১৯৯১ সালের ১৪ জানুয়ারি দ্য ডেইলি স্টারের যাত্রা শুরু হয়। একটি স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর যে স্বাধীনতা পাওয়া যায়, তা এই পত্রিকা পেয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শুরুর দিকের একটি উদ্যোগ ছিল বিশেষ ক্ষমতা আইনের সব ধারা বাতিল করা, যার মাধ্যমে লাইসেন্স বাতিলসহ অন্যান্য প্রক্রিয়ায় গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো। বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে ধন্যবাদ যে ওই সময়ে বাংলাদেশে এমন কোনো আইন ছিল না, যার মাধ্যমে কোনো সংবাদপত্রকে বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব।

স্বৈরশাসকের পতনের পর জাতি যখন প্রথমবারের মতো প্রকৃতপক্ষে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল, তখন বড় রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ ইশতেহার তৈরিতে ব্যস্ত এবং সেগুলোর প্রচারণা চাইছিল। ফলে রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার সুযোগ পায় গণমাধ্যম। এটা এমন একটি দায়িত্ব, যা গণতন্ত্রের জন্য আবশ্যক। বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদের সরকার গণতন্ত্রকে উদ্দীপনা দেয় এবং দেড় দশকের সামরিক ও আধা সামরিক একনায়কত্বের পর মুক্ত গণমাধ্যমের পুনর্জন্মের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে। সেই পরিবেশেই দ্য ডেইলি স্টারের জন্ম হয়।

আমরা অনেক উৎসাহ ও প্রতিশ্রুতি নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। আলী ভাইয়ের নেতৃত্বাধীন দ্য ডেইলি স্টারের দিকে সবার দৃষ্টি ছিল। তবে, আমাদের প্রথম উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত হয় খুবই ধীর গতির প্রবৃদ্ধি। আমাদের লক্ষ্য ছিল তিন বছরের মধ্যে আয় ও ব্যয় সমানে নিয়ে আসা। কিন্তু সেটা হতে সময় লেগে যায় সাত বছর। আমরা উপলব্ধি করি, সংবাদপত্রের পাঠক তাদের পছন্দের পত্রিকার প্রতি অত্যন্ত বিশ্বস্ত। অন্য পত্রিকা ছেড়ে দ্য ডেইলি স্টারের প্রতি পাঠকদের আকৃষ্ট করতে আমাদেরকে অনেক দিক দিয়ে এগিয়ে থাকার প্রমাণ দিতে হয় এবং এর জন্য বেশ কয়েক বছর সময়ও লেগে যায়।

একজন সম্পাদক যতই প্রতিভাবান হন না কেন—সংকল্পবদ্ধ একদল কর্মীবাহিনী ছাড়া তিনি সংবাদপত্র চালাতে পারেন না। আমার সৌভাগ্য যে আমি এমন কিছু সহকর্মী পেয়েছি, যাদের চেয়ে প্রতিভাবান, সংকল্পবদ্ধ ও উৎসাহী সহকর্মী পাওয়ার কথা কল্পনাও করা যায় না। এই সৃজনশীল সহকর্মীরা সারাক্ষণ নতুন নতুন সংবাদের খোঁজে ক্লান্তিহীন ও বিরতিহীনভাবে কাজ করেছেন। সবাই জানেন, একজন সাংবাদিকের জন্য 'সোর্স' হচ্ছে সবচেয়ে বড় সম্পদ এবং আমার সহকর্মীদের মধ্যে কয়েকজনের কাছে এর খনি ছিল।

দ্য ডেইলি স্টারকে ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে আমার সবচেয়ে বড় গর্বের বিষয়ের মধ্যে অন্যতম হলো, কখনো, কোনোদিন আমার কোনো সহকর্মীর সততা নিয়ে অভিযোগ পাইনি। এমনকি, আমাদের প্রতিবেদনের কারণে যাদের অপকর্ম প্রকাশ্যে এসেছে, তারাও কখনো এমন অভিযোগ করেননি। পুরো পরিবেশটাই যেখানে দুর্নীতিতে জর্জরিত, তখন এই বিষয়টি আরও বেশি প্রশংসার দাবিদার।

দ্য ডেইলি স্টার পরিচালনার এই সময়টিতে যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন করেছে তা হলো, এই পেশায় রাজনৈতিক মেরুকরণ। মেরুকরণের কারণে নিজেদের দায়িত্ব ভুলে গিয়ে কীভাবে আশা করতে পারি যে পাঠক বা দর্শকরা আমাদের বস্তুনিষ্ঠতার দাবি মেনে নেবে? নিঃসন্দেহে প্রতিটি নাগরিকের নিজ নিজ রাজনৈতিক পছন্দ ও অপছন্দ থাকবে। কিন্তু সেই পছন্দ ও অপছন্দ যখন আমাদের পেশাদারিত্বকে খর্ব করে, তখন তা গ্রহণযোগ্য হয় না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমরা সেটাই হতে দিয়েছি।

একই পরিস্থিতি এডিটরিয়াল ইন্সটিটিউশনের। প্রতিটি বিশ্বাসযোগ্য গণমাধ্যমের বস্তুনিষ্ঠতা ও পেশাদারিত্বের পরিচয় পাওয়া যায় সম্পাদকের কর্মসূত্রে। সম্পাদকের দায়িত্ব হলো, তার কর্মীদের সঠিক পথে পরিচালনা করা এবং বাইরের চাপ ও হুমকি থেকে বাঁচিয়ে রাখা। অথচ, আমাদের মধ্যে অনেকেই কর্মীদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষায় নির্লজ্জভাবে ক্ষমতাসীনদের পক্ষপাতিত্ব করে। একটি সংবাদপত্রের প্রতি সবার আস্থা তৈরি করতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেন সম্পাদক। তার সাফল্যের ওপরই নির্ভর করে সাধারণ মানুষ ওই সংবাদপত্রকে গ্রহণ করবে কিনা।

অতীত অভিজ্ঞতা থেকে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। কিন্তু একইসঙ্গে গভীরভাবে হতাশ হই, কারণ কোনো সরকার, এমনকি ১৯৯১ সালে দেশের গণতন্ত্র ফিরে আসার পরও স্বাধীন গণমাধ্যমের অনিবার্যতা অনুধাবন করতে পারেনি। যদিও, স্বাধীন গণমাধ্যম কেন প্রয়োজন তার উদাহরণ চারপাশে ছড়িয়ে আছে। কেবলমাত্র গতিশীল ও সমালোচনামূলক গণমাধ্যমই পারে একটি দেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে।

মাহফুজ আনাম, সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments