মাহফুজ আনামের অভিমত: দ্য ডেইলি স্টারের জন্য ‘ইন্টারেস্টিং’ দিন

মাহফুজ আনামের অভিমত
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। ছবি: সংগৃহীত

টেলিভিশনের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন গতকাল দ্য ডেইলি স্টার সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেছেন, যার একটি ভিত্তিহীন এবং অপরটি বাস্তবতাবিবর্জিত।

একজন সাংবাদিক উল্লেখ করেন, 'মাহফুজ আনাম সাহেব বলেছেন, নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে'—এ বিষয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, 'এখন মাহফুজ আনাম সাহেব যেটা বলছেন, উনি সাংবাদিক। উনি বিএনপির আন্দোলন সফল হোক এবং এ ব্যাপারে তার পত্রিকাও উৎসাহিত করেছে। এখন যেভাবে তারা ভেবেছিলেন, উৎসাহ দিয়েছিলেন, বাস্তবে সেটা হয়নি। এ দুঃখবোধ তো থাকতেই পারে।'

তার এ বক্তব্যে যে তিনি কটাক্ষ করেছেন তা যেমন স্পষ্ট, আবার তার মন্তব্যটি পুরোপুরি ভিত্তিহীনও। বেশ কিছুদিন আগে লিখেছিলাম, ক্ষমতার কাছে, 'মুক্ত গণমাধ্যম মানে এখন উন্মুক্ত প্রশংসা।' সেখানে লিখেছিলাম, 'উন্মুক্ত প্রশংসা হলো সেটাই যেখানে গণমাধ্যম শুধু খোলামেলা প্রশংসার ক্ষেত্রে পুরোপুরি স্বাধীন থাকবে। যে গণমাধ্যম যতবেশি প্রশংসা করতে পারবে, সেটিকে তত মুক্ত বলে ধরা হবে। এর বাইরে যেকোনো ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি হলো ভুয়া খবর, ষড়যন্ত্র, দেশবিরোধী, উন্নয়নবিরোধী এবং কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রদ্রোহিতা।' গত তিন মাসে আমাদের বেশিরভাগ প্রতিবেদন ছিল ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে। কিন্তু এসব প্রতিবেদনে প্রশংসার কিছু ছিল না বলে সেগুলো ভালো প্রতিবেদন হয়নি। আমরা সরকারের সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এবং বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পগুলোকে ব্যাপক কাভারেজ দিলেও, আমাদের দোষ হলো, আমরা বিপরীত চিত্রগুলোও তুলে ধরি। ব্রিটেনের রাজনীতি নিয়ে বিখ্যাত ব্যঙ্গধর্মী টেলিভিশন সিরিজে যেমন বলা হতো, 'কোনো ভিন্ন দৃষ্টিকোণ, সমালোচনা ও ভিন্নমত থাকবে না, থাকবে শুধু "ইয়েস মিনিস্টার"।'

ওবায়দুল কাদের সাহেব আমাদের সেই কথাই আবার প্রমাণ করলেন।

দ্বিতীয় মন্তব্যটি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর। জাতিসংঘ মহাসচিবের শেফ দ্য ক্যাবিনেটের কাছে তার পাঠানো 'ব্যক্তিগত চিঠি'র বিষয়বস্তু প্রকাশ করায় তিনি ডেইলি স্টারের সমালোচনা করেছেন। টেলিভিশনের প্রতিবেদককে তিনি বলেছেন, 'আমি যদি আপনাকে রাতের খাবারের আমন্ত্রণ জানাই বা আপনি ও আপনার পরিবারের সবাই কেমন আছে জানতে চেয়ে চিঠি লিখি, তবে সেটি কি সংবাদ হিসেবে প্রকাশ করা উচিত? এটি কী ধরনের সাংবাদিকতা?' তিনি বলেন, 'জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যখন ছিলাম, তখনকার কিছু ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি এবং "ধন্যবাদ" দিয়ে চিঠি লিখেছি।'

যদিও, জাতিসংঘের সঙ্গে সদস্য রাষ্ট্রগুলো চিঠিতে যেভাবে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ করে,পররাষ্ট্রমন্ত্রীর লেখা ৭০০'র বেশি শব্দের চিঠিটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সেভাবেই লেখা হয়েছে।

শুরুর অভিবাদন ও উপসংহার ছাড়া চিঠিতে পাঁচটি অনুচ্ছেদ আছে, যার মধ্যে জাতিসংঘ ও বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্ক, প্রধানমন্ত্রীর সফর, জাতিসংঘের প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতি, বিভিন্ন প্রকল্প ও পরিকল্পনা যেমন 'প্যাক্ট অব ফিউচার', 'নিউ এজেন্ডা ফর পিস', রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানে আমাদের ভূমিকা, উন্নয়ন ইত্যাদি নিয়ে লেখা হয়েছে।

যে অনুচ্ছেদের কারণে আমরা চিঠিটি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করতে আগ্রহী হয়েছি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্যও নিয়েছি, সেটি উদ্ধৃত করলে দাঁড়ায়, 'বাংলাদেশ জাতিসংঘের একটি উদ্যমী ও সহযোগিতামূলক মনোভাবসম্পন্ন সদস্য রাষ্ট্র। আমরা প্রবলভাবে আশাবাদী যে, জাতিসংঘ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অগ্রগতি ও জনগণের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সহযোগিতা ও সহায়তা অব্যাহত রাখবে...তা স্বত্বেও আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশ বিভিন্ন মহলের কাছ থেকে "অযাচিত, অযৌক্তিক ও আরোপিত রাজনৈতিক চাপের" মুখোমুখি হচ্ছে। আমরা আশা করব জাতিসংঘ ও তার সেক্রেটারিয়েট, সংস্থা ও স্থানীয় কার্যালয়গুলো বাংলাদেশকে উন্নয়নের পথে ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে যেতে গঠনমূলক ও সহযোগিতামূলক ভূমিকা পালন করবে।'

আমাদের দেশের আন্তর্জাতিক অবস্থানের বিষয়ে আগ্রহী পাঠক, বিশেষজ্ঞ, সাবেক কূটনীতিকসহ সবার জন্য আমরা চিঠির বিষয়বস্তু প্রকাশ করেছি, যেন চিঠিটির তাৎপর্য এবং প্রকৃতপক্ষে এটি দেশের মর্যাদা কতটা বাড়িয়েছে, তারা তা বিচার করতে পারেন। একদিকে আমাদের মানবাধিকার ও স্বাধীনতা নিয়ে কথা বললে আমরা জাতিসংঘের সমালোচনা করি, আবার অন্যদিকে আমাদের নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ে তাদের জড়ানোর আহ্বান জানাই।

আমরা কি জানতে চাইতে পারি যে, এই চিঠির কোন অংশটি ব্যক্তিগত? পররাষ্ট্রমন্ত্রী কি চিঠির এমন একটি শব্দ দেখাতে পারবেন, যা ব্যক্তিগত বলে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে? তাহলে কেন এই ভণিতা? যদি গণমাধ্যমকে দায়িত্বহীনতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়, তাহলে অভিযোগকারীকে অবশ্যই তথ্যভিত্তিক সত্য উপস্থাপন করতে হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী কি ভেবেছেন যে, ওই চিঠিকে 'ব্যক্তিগত' বলে দাবি করলে তিনি দায়িত্ব এড়াতে পারবেন?

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

 

Comments

The Daily Star  | English
US wants Bangladesh trade plan,

Bangladesh to push for tariff cuts in USTR talks in Washington today

Bangladesh has been engaged in negotiations to sign a tariff agreement with the US

57m ago