ড. ইউনূসের সাজা কি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য অশনি সংকেত?

ড. ইউনূসের কারাদণ্ড
আদালত প্রাঙ্গণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ১ জানুয়ারি ২০২৪। ছবি: রাশেদ সুমন/স্টার

শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে গত ১ জানুয়ারি ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন ঢাকার একটি আদালত। সর্বজন শ্রদ্ধেয় ড. ইউনূসের সাজার রায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কী বার্তা দিচ্ছে? তারা এই রায়কে কীভাবে নেবেন? তারা কী ধরেই নেবেন বাংলাদেশে বিনিয়োগে তাদের ঝুঁকি বাড়বে?

আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, এই রায় বাংলাদেশ ও দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। কারণ বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো আস্থা হারালে বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আরও কমে যেতে পারে।

নীতিনির্ধারক ও শিক্ষাবিদরা দীর্ঘদিন ধরে স্বীকার করে আসছেন, দেশের সফল উন্নয়ন কৌশলের একটি মূল উপাদান এফডিআই। কারণ অর্থনৈতিক রূপান্তরে প্রয়োজনীয় মূলধন ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের সুযোগ তৈরি করে দেয় এফডিআই। তবে বাংলাদেশে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অপর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা, মানবসম্পদ এবং আইন ও বিধি-বিধানের প্রয়োগ নিয়ে নানান সমস্যা আছে। এ কারণে বাংলাদেশে এফডিআই প্রবাহ সবসময়ই কম ছিল। আর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে এই রায়ের ফলে দেশের আইন প্রয়োগকে ঘিরে বিদেশিদের নেতিবাচক ধারণা আরও বাড়তে পারে। কারণ তাকে আইনের বেড়াজালে আটকাতে প্রচুর আইনি যুক্তি দেখানো হয়েছে।

বাংলাদেশে শ্রম আইন-২০০৬ অনুযায়ী, কোম্পানির মুনাফার পাঁচ শতাংশ কর্মচারীদের ভাগ দিতে হয় এবং বিভিন্ন কর্মী ফান্ডে যোগ করতে কয়। ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আটকাতে এই আইনটি ব্যবহার করা হয়েছে। বলা হয়েছে, গ্রামীণ টেলিকমের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ড. ইউনূস এই আইন মেনে চলেননি, তিনি শ্রম আইন লঙ্ঘন করেছেন। সহজ করে বললে বলতে হবে, গ্রামীণ টেলিকম তার কর্মীদের অর্জিত মুনাফার ভাগ দেয়নি।

আইন অনুযায়ী যুক্ত ঠিক আছে, কিন্তু যখন জানা যায়- গ্রামীণ টেলিকম একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, তখন এই আইনি যুক্তির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কারণ, একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান কখনো কোনো মুনাফা অর্জন করে না। সুতরাং প্রশ্ন হলো- যে প্রতিষ্ঠান মুনাফা অর্জন করে না তারা কীভাবে কর্মচারীদের মুনাফার ভাগ দেবে? তাই অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কর্মচারীদের মুনাফার ভাগ দেওয়ার বিষয়টি প্রাসঙ্গিক নয়।

এখানে আইনের আরেকটি ফাঁকফোকর আছে, তা হলো দেশের শীর্ষস্থানীয় মোবাইল ফোন অপারেটর ও শেয়ারবাজারের বৃহত্তম কোম্পানি গ্রামীণফোনের ৩৪ শতাংশ শেয়ারের মালিক গ্রামীণ টেলিকম। সেই হিসেবে গ্রামীণ টেলিকম অবশ্যই গ্রামীণফোনের কাছ থেকে মুনাফার অংশ নেয়। কিন্তু, সেই মুনাফা সামাজিক ব্যবসায়ে ব্যয় করে গ্রামীণ টেলিকম।

কিন্তু গ্রামীণ টেলিকমের কর্মীরা মনে করেন, গ্রামীণফোনের মুনাফার পাঁচ শতাংশ তাদের প্রাপ্য। এটি একটি অযৌক্তিক দাবি হলেও গ্রামীণ টেলিকম তাদের দাবিতে সম্মত হয়েছে।

এখানেও ত্রুটি খুঁজে বের করা হয়েছে, গ্রামীণ টেলিকম ও তার কর্মচারীদের মধ্যে আদালতসম্মত এই নিষ্পত্তিকে ঘুষ হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই লেনদেনটি দেরিতে সম্পন্ন হওয়ায় অর্থপাচার হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

গ্রামীণ টেলিকমের সঙ্গে আচরণে আরেকটি সমস্যা পাওয়া গেছে, তা হলো- তারা ৬০ জন চুক্তিভিত্তিক কর্মচারীকে নিয়মিত করেনি।

গ্রামীণ টেলিকম যখন যাত্রা শুরু করেছিল, তখন এর লক্ষ্য ছিল গ্রামীণ নারীদের হাতে মোবাইল ফোন ‍তুলে দেওয়া, যা অর্থ উপার্জনের কাজে ব্যবহার করা হবে এবং তাতে নারীর ক্ষমতায়ন হবে। কিন্তু বর্তমানে মোবাইল ফোন সহজলভ্য হয়ে পড়েছে, তাই গ্রামীণ টেলিকমের এই প্রধান কার্যক্রম এখন অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে।

অলাভজনক প্রতিষ্ঠানটি পরবর্তীকালে তাদের অনেক কর্মীকে ছেড়ে দিয়েছে। তাদের মধ্যে ৬৯ জনকে চুক্তিভিত্তিতে রেখেছিল এবং তারা স্থায়ী চাকরির সব সুবিধা ভোগ করেছে। তাদের চুক্তিতে রাখার কারণ হলো গ্রামীণ টেলিকমের কাজের আদেশের ওপর তাদের কাজ নির্ভর করে।

কিন্তু, বাংলাদেশে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান আছে যারা তাদের কর্মীদের মুনাফার পাঁচ শতাংশ ভাগ দেয়নি এবং চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের স্থায়ী করেনি। এমন কয়টি প্রতিষ্ঠানকে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে? এটাই এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

অথচ ড. ইউনূসের মতো একজন বিশ্বখ্যাত, শ্রদ্ধেয় নাগরিক প্রায় ২০০টি মামলার সম্মুখীন হয়েছেন। যদি তার মতো নোবেলজয়ীকে এভাবে আইনি হয়রানির শিকার হতে হয়, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য কী অপেক্ষা করছে? এখানে বার্তা পরিষ্কার, যদি তারা যদি নিয়ন্ত্রণে না থাকেন তাহলে আইনি জালে আটকা পড়তে পারেন।

ইতোমধ্যে নরওয়ের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান টেলিনরের মালিকানাধীন গ্রামীণফোনকে ক্রোধের মুখে পড়তে হয়েছে। নিম্নমানের সেবার অজুহাতে ছয় মাসের জন্য গ্রামীণফোনের সিম কার্ড বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

নিঃসন্দেহে এ কথা বলা যায় যে, ড. ইউনূসের সাজার পদ্ধতি বিদেশি বড় বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশের প্রতি আস্থা বাড়াবে না এবং ইতোমধ্যে যেসব তথ্য আছে বা ঘটনা ঘটেছে তাও আশাব্যঞ্জক নয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের চাপের কারণে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বাংলাদেশ থেকে তাদের মুনাফা ফেরত নিতে বাধার মুখে পড়ছে। ফলে গত কয়েক বছর ধরে এফডিআইয়ের যে নিম্ন মাত্রা ছিল তা আরও সংকুচিত হতে শুরু করেছে।

২০২২-২৩ অর্থবছরের কথাই ধরা যাক, কাগজে-কলমে নিট এফডিআই প্রবাহ ছিল ৩ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৫ দশমিক ৫ শতাংশ কম। কিন্তু তথ্যের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে, প্রকৃতপক্ষে এই অর্থের মাত্র এক চতুর্থাংশ নতুন প্রবাহ ছিল এবং গত অর্থবছরে এফডিআইয়ের ৭২ দশমিক ৯ শতাংশ পুনঃবিনিয়োগ করা আয় ছিল।

২০২১-২২ অর্থবছরে পুনঃবিনিয়োগ করা আয় ছিল ৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের নিট এফডিআইয়ের ৫৯ দশমিক ৪ শতাংশ। বিপরীতে, ৩৯ দশমিক ২ শতাংশ নতুন বিনিয়োগ ছিল, যা তার আগের অর্থবছরের ৩২ দশমিক ৬ শতাংশের চেয়ে বেশি।

বর্তমানে রিজার্ভের ওপর যে চাপ আছে তা কমতে সময় হয়তো লাগবে, হঠাৎ করে কমার সম্ভাবনাও নেই। সুতরাং বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশ থেকে মুনাফা নেওয়ার অনুমতি দিতে কিছুটা সময় লাগবে। আর যদি তারা মুনাফা নিয়ে যেতে না পারে, তাহলে বাংলাদেশে অর্থ রাখার জন্য তারা আর কী প্রণোদনা পাবে?

ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে এভাবে সাজার রায় ঘোষণার পর বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উৎসাহে ভাটা পড়তে পারে।

Comments

The Daily Star  | English

Gaza rescuers say Israeli forces kill 60, half near aid centres

Civil defence spokesman Mahmud Bassal told AFP that five people were killed while waiting for aid in the southern Gaza Strip and 26 others near a central area known as the Netzarim corridor, an Israeli-controlled strip of land that bisects the Palestinian territory

11m ago