সংঘর্ষের ফাঁদে রাজনীতি, সমাধানের পথ কতদূর
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অর্থনীতির অধ্যাপক স্যার পল কলিয়ার 'দি বোটম বিলিয়ন' বইয়ে 'কনফ্লিক্ট ট্র্যাপ' বা সংঘর্ষের ফাঁদের কথা উল্লেখ করেছেন। কোনো জাতি এই ফাঁদে পড়লে তা হয়ে ওঠে দেশের অগ্রগতির অন্যতম প্রধান অন্তরায়।
'স্বাধীনতার চেতনা' কতগুলো আদর্শ বানী বা স্লোগানের সমষ্টি নয়। এটি হচ্ছে গণতন্ত্র ও অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি সমাজ ব্যবস্থা, যা বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষই দল ও ধর্ম নির্বিশেষে মনে ধারণ করে।
কিন্তু এই মর্মে সম্পূর্ণ কৃত্রিম একটি বিভাজন সৃষ্টি করা হয়েছে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলের স্বার্থে। রাষ্ট্রীয় সংস্থা, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ট্রেড ইউনিয়নসহ সমাজের প্রত্যেক অঙ্গ আজ দুটি ভাগে বিভক্ত। পরস্পর দ্বন্দ্বে লিপ্ত পুরো জাতি বর্তমানে একটি সংঘর্ষের ফাঁদে পতিত।
বিএনপি ও অন্যান্য সহযোগী দল নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকারের লক্ষ্যে সর্বাত্মক সংগ্রামে লিপ্ত। এতে সফল হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?
স্যার কলিয়ার একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন যে জনগণের আন্দোলন ওই দেশের মাথাপিছু আয় ও রাষ্ট্রের ধরনের ওপর নির্ভরশীল। একটি স্বৈরতান্ত্রিক দেশে জেল-হাজতের ঝুঁকি কাঁধে নিয়ে তারাই সংগ্রামে অংশ নেয়, যাদের মাথাপিছু আয় অতটা যে প্রত্যহের ভরন-পোষণের চিন্তা তাদের করতে হয় না। অন্যদিকে যে সব দেশে কার্যকর গণতন্ত্র রয়েছে, সেখানে নিম্নতম আয়ের মানুষও দাবী আদায়ের লক্ষ্যে প্রতিবাদী হতে পারে। কারণ, আইন বহির্ভূত নির্যাতনের ভয় সেখানে নেই।
ওই তত্ত্ব এবং বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার আলোকে যেকোনো গণ-আন্দোলনের চালিকা শক্তি হতে হবে উচ্চ মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী—যেমন: শিক্ষার্থী ও শহুরে যুব সমাজ, বিভিন্ন পেশাজীবী ও শ্রমিক সংগঠনের। কিন্তু তরুণ শ্রেণী বর্তমানে রাজনীতি বিমুখ। কারণ, দেশের কোনো দলই যুব সমাজকে যুগোপযোগী কোনো বিকল্পের স্বপ্ন দেখাতে পারেনি। বিএনপির আন্দোলনের সফলতা উল্লেখিত শ্রেণীর সম্পৃক্ততার ওপর নির্ভর করছে। এটাই তাদের বড় চ্যালেঞ্জ। বিফল হলে দলটি অস্তিত্বের সংকটে পরতে পারে।
স্যার কলিয়ার একটি বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন, বিশ্বের কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রগুলো নির্বাচনের ফলাফল অনুকূলে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন অপকৌশল অবলম্বন করে। এর অন্যতম হচ্ছে ভোট কেনা, বিরোধী দলের ওপর নিপীড়ন, জনসমর্থন আছে এমন বিরোধী নেতার বিরুদ্ধে মিথ্যা দুর্নীতি ও ফৌজদারি মামলার মাধ্যমে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখা ইত্যাদি।
বিএনপি ছাড়া একটি নির্বাচন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ও আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। আপাতদৃষ্টিতে সেটা যত সুষ্ঠুভাবেই অনুষ্ঠিত করা হোক না কেন।
একটি অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন বিএনপির প্রতি জনসমর্থন বৃদ্ধি করে আন্দোলনের তীব্রতা বাড়াতে সহায়ক হবে, যা দেশে চরম অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি করে অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
সেইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সীমিত আকারের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিলেও দেশের গার্মেন্টস শিল্পে ধস নেমে কয়েক লাখ শ্রমিক বেকার হতে পারে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় যেহেতু সাধারণ জনগণেরই ক্ষতি হয় বেশি, তাই আমি বিশ্বাস করি তারা ওই পথে হয়ত এগুবে না। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞার ভীতি—যা বর্তমানে বিরাজমান—বৈদেশিক বিনিয়োগ, রপ্তানি আয়, ডলার মূল্য ও রেমিট্যান্সের ওপর অত্যন্ত বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
ডলার ও রিজার্ভ স্বল্পতার কারণে সার ও কৃষি কাজে ব্যবহৃত দ্রব্যের আমদানি কমে গেলে ফসল উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষতি হবে। ফলে খাদ্যদ্রব্যের দাম সিংহভাগ জনগণের নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে। এর প্রভাবে সাধারণ মানুষের জীবনমানের চরম অবনতি হলে পরিবর্তনের জন্য জনগণ রাস্তায় নেমে আন্দোলনরত বিরোধী দলগুলোর কাতারে শামিল হতে পারে। এমন একটি পরিস্থিতি পরবর্তী সরকারের কখনই কাম্য নয়।
যেকোনো দেশে একটি সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশের জন্য প্রয়োজন প্রত্যেকটি দলের শান্তিপূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক সহাবস্থান। সরকারি ও বিরোধী দল একে অপরের পরিপূরক হতে হবে। দেশের উন্নয়ন ও পরিচালনায় বিরোধী দলের গঠনমূলক সমালোচনা, পরামর্শ ও তদারকি একান্ত জরুরি।
কিন্তু বাংলাদেশে বিজয়ী দলই দেশের সববিষয়ে একক কর্তৃত্ব গ্রহণ করে। বিরোধী দলের সেখানে কোনো স্থান নেই। তাই ক্ষমতা আঁকড়ে রাখা বা ক্ষমতায় আরোহণের জন্য দলগুলো এমনই মরিয়া হয়ে ওঠে যে দেশের স্বার্থের চেয়ে দলের স্বার্থই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। রাজনীতি কলুষিত হয় নোংরা দলাদলিতে।
পারস্পরিক বিভেদের ফলে যেহেতু দুটি দলেরই চরম ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে, তাই নিজেদের স্বার্থেই সবপক্ষের একটি সমঝোতায় আসা উচিত। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যেকোনো সমাধানে অন্তত দুটি শর্ত পূরণ হতে হবে। প্রথমত এমন একটি পদ্ধতি, যা সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করবে। দ্বিতীয়ত অকৃতকার্য দলের সবকিছু হারানোর ঝুঁকি থাকবে না।
প্রয়াত ড. আকবর আলি খান বাংলাদেশে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তনের পরামর্শ দিয়েছেন। এতে নির্বাচনে প্রাপ্ত মোট ভোট অনুযায়ী একটি দলের সংসদে সদস্য সংখ্যা নির্ধারিত হয়। তাই নির্বাচনে পরাজিত হলেও একটি দলের সবকিছু হারানোর ভয় থাকে না।
বড় দুই দলের নিবেদিত ভোটারের সংখ্যা প্রায় সমান—শতকরা ৩০ ভাগের মতো। এ অবস্থায় যেকোনো নির্বাচনে পরাজিত দলের এমপি সংসদে থাকবে ৩০ শতাংশ। যেকোনো মূল্যায়নে এটি অত্যন্ত শক্তিশালী একটি অবস্থান, যা সরকারের যেকোনো নিপীড়ন প্রতিরোধ করতে সক্ষম।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা কি আদৌ সম্ভব না? নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার বিষয়টি সরকার বা নির্বাচন কমিশনের চেয়ে তাদের ওপরই বেশি বর্তায় যারা মাঠপর্যায় নির্বাচনের কাজটি করেন। নির্বাচন কমিশন এমন ব্যক্তিদের মাঠপর্যায় নিয়োজিত করতে পারেন, সরকার বা কোনো দলের সঙ্গে যাদের কোনো প্রকার স্বার্থের সংশ্লিষ্টতা নেই।
নির্বাচন কাজে অভিজ্ঞ জুডিশিয়াল, সিভিল, পুলিশ সার্ভিস এবং সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, যারা কোনো দলের সদস্য নন, তাদের মাঠপর্যায় নির্বাচন পরিচালনার জন্য রিটার্নিং কর্মকর্তা, ম্যাজিস্ট্রেট ও নির্বাচনী এলাকার প্রধান আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। বেসরকারি সংস্থা, ব্যাংক ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক পর্যায়ের কর্মকর্তারা প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করতে পারেন।
সামরিক বাহিনীর সাধারণ সৈনিক ও পুলিশের কনস্টেবলরা এখনো রাজনীতিকরণ থেকে মুক্ত। পোলিং সেন্টারের আইন শৃঙ্খলার জন্য জুনিয়র কমিশন্ড অফিসারের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী ও বর্ডার গার্ডের সৈনিক এবং পুলিশ কনস্টেবলদের নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।
প্রতিনিধিত্বমূলক সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন, নির্বাচন ব্যবস্থাপনার আমূল পরিবর্তন ও রাজনৈতিক দলগুলোর সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি গ্রহণ একটি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই এই প্রক্রিয়ায় এগোতে হলে নির্বাচন পিছাতে হবে। সবপক্ষ একমত হয়ে দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিলে যেকোনো উদ্যোগ নিতে বাধা নেই।
সাইফুর রহমান: জ্যেষ্ঠ তথ্য প্রযুক্তিবিদ ও সার্টিফাইড প্রফেশনাল অস্ট্রেলিয়ান কম্পিউটার সোসাইটি
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments