মহামান্য রাষ্ট্রপতির কথা নিয়ে কিছু কথা

বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সীমিত, কিন্তু পদটি 'মহামান্য'। পদটি অত্যন্ত সম্মানজনক।

'রাষ্ট্রপ্রধান রূপে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অন্য সকল ব্যক্তির ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করিবেন এবং এই সংবিধান ও অন্য কোন আইনের দ্বারা তাঁহাকে প্রদত্ত ও তাঁহার উপর অর্পিত সকল ক্ষমতা প্রয়োগ ও কর্তব্য পালন করিবেন।' (গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদের ধারা ২)

প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী তাকে কাজ করতে হয়।

রাষ্ট্রপতি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য। আজকের আলোচনার বিষয় মূলত এটাই।

গত ২৫ ফেব্রুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি ও আচার্য কিছু দিকনির্দেশনামূলক ও গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। যেসব বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন, তার সবই গত কয়েক বছর ধরে আলোচিত এবং সমালোচিত।

রাষ্ট্রপতি বলেছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতন হতে; খেলাপি ঋণের এক শতাংশের জন্যও সাধারণ মানুষ দায়ী নয়; ছাত্র রাজনীতিকে এখন মানুষ নেতিবাচকভাবে দেখে। ছাত্র রাজনীতির টেন্ডারবাজি, স্বজনপ্রীতিসহ অন্যান্য নেতিবাচক খবর নিয়ে তিনি কথা বলেছেন।

রাষ্ট্রপতি ও আচার্য মো. আবদুল হামিদ পরপর ২ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করছেন মোট ১০ বছর। ৩ মেয়াদের আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কালের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সময় তিনি রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্যের দায়িত্ব পালন করছেন।

এই সময়কালে আমরা যদি দেশের ছাত্র রাজনীতির দিকে নজর দেই, তাহলে এক নাগারে সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, চাঁদাবাজি, মাস্তানি, রাহাজানি, খুনাখুনি পর্যন্ত দেখতে পাই।

কিন্তু ১০ বছরের মেয়াদকালে আচার্যকে এসব বিষয়ে কেনো উদ্যোগ নিতে বা কথা বলতে দেখা যায়নি। আমরা জানি, বিশ্ববিদ্যালয় সরাসরি পরিচালনা করেন উপাচার্য, আচার্য নয়। তবে উপাচার্য নিয়োগ ও অপসারণের ক্ষমতা আচার্যের হাতে। তার নিয়োগকৃত উপাচার্যদের বেশ কয়েকজন নজিরবিহীন অনিয়ম-দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত হয়েছেন। আচার্যকে নীরব থাকতে দেখা গেছে।

প্রাসঙ্গিকভাবেই প্রশ্ন আসে, কেন তিনি নীরব থেকেছেন, এখন কেন কথা বলছেন?

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের সঙ্গে টাকা ভাগাভাগির অভিযোগ পর্যন্ত উঠেছে। সেই অভিযোগে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। উপাচার্যের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ বিষয়ে আচার্য নীরব থেকেছেন।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ২৩ এপ্রিল। তিনি কথা বলছেন বিদায় বেলায়।

তিনি যে দলের রাজনীতি করেন, যে দল থেকে সংসদ সদস্য ও স্পিকার নির্বাচিত হয়েছেন, যে দল তাকে নির্বাচিত করেছে রাষ্ট্রপতি, সেই দলের ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি, শিক্ষার্থীদের ওপর নিপীড়ন-যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে আচার্য হিসেবে কেন কখনোই কোনো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করলেন না? এসব বিষয় তো বছরের পর বছর আলোচনায় থাকলো, বারবার গণমাধ্যমের শিরোনাম হলো, আওয়ামী লীগের নেতারা সেগুলো চাপা দেওয়ারও চেষ্টা করলেন।

এসব প্রশ্নের উত্তর কি রাষ্ট্রপতির থেকে দেশের মানুষ আশা করতে পারেন?

পদে থাকা অবস্থায় নিশ্চুপ, পদ থেকে বিদায় নেওয়ার সময়ে ভালো কিছু কথা বলে যাওয়াটা যেন রীতিতে পরিণত হয়েছে। সাবেক আইজিপিসহ অনেকেই এমন নজির রেখে গেছেন। রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রেও আমরা কি আমরা তেমনটাই দেখছি?

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী। এটি বঙ্গবন্ধু সরকারের অত্যন্ত সময়োপযোগী একটি অধ্যাদেশ ছিল, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জবাবদিহিতার বাইরে রাখা হয়েছিল। কারণ, তারা জ্ঞানী মানুষ, জবাবদিহিতা করবেন নিজের কাছে, অন্যের কাছে নয়।

এই ৪টি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের নিজস্ব আইনে চলে। কিন্তু যে আইনেই চলুক না কেন, বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতি।

উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে আচার্যর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতায় হয়তো সবকিছু করতে পারতেন না, কিন্তু 'নৈতিক কর্তৃত্ব' থেকে কথা তো বলতে পারতেন। উপাচার্যদের অপসারণের ক্ষমতা তো তার হাতে ছিল।

আচার্যের নিয়োগ দেওয়া কয়েকজন উপাচার্যের দিকে নজর দিতে একটু পেছনে ফেরা যাক।

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে আচার্য যাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন, তিনি তার মেয়াদকালের প্রায় পুরো সময় ক্যাম্পাসে অনুপস্থিত থেকে রাষ্ট্রীয় সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন। ক্যাম্পাসে গেলেও সকালের ফ্লাইটে গিয়ে বিকেলের ফ্লাইটে ফিরেছেন। অথচ, এই পদটি আবাসিক। তার অবস্থান করার কথা ক্যাম্পাসে, সেখানে তার বাসস্থান আছে, গাড়ি আছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অর্থের বিনিময়ে লোকবল নিয়োগ দিয়ে গণমাধ্যমের শিরোনাম হলেন, এমনকি আওয়ামী লীগ সমর্থিত শিক্ষকরাও তার বিরুদ্ধে কথা বললেন। রাতের অন্ধকারে পুলিশি নিরাপত্তার মধ্যে তিনি ক্যাম্পাস ছাড়লেন। এত অভিযোগ থাকার পরেও তাকে দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্য পদে নিয়োগ দিয়েছেন আচার্য। এর ব্যাখ্যা কী?

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষামন্ত্রী, ড. জাফর ইকবালসহ অন্যরা গিয়ে আশ্বাস দিলেন শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ১ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই দাবি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হলো না আজও। অর্থাৎ, উপাচার্যকে সরানোর যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা রাখা হয়নি। এই জায়গায় আমরা আচার্যের কোনো উদ্যোগ দেখতে পাইনি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের সঙ্গে টাকা ভাগাভাগির অভিযোগ পর্যন্ত উঠেছে। সেই অভিযোগে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। উপাচার্যের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ বিষয়ে আচার্য নীরব থেকেছেন।

এখন আলোচনায় কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্রলীগ নেত্রীরা কীভাবে শিক্ষার্থী ফুলপরীকে নিপীড়ন করেছেন, উপাচার্য-প্রক্টর-প্রভোস্ট-হাউজ টিউটররা কীভাবে নির্যাতনকারীদের পক্ষ নিয়েছে, সবই গণমাধ্যমের শিরোনাম। এ ক্ষেত্রে কিছু ব্যবস্থা দৃশ্যমান হচ্ছে হাইকোর্টের নির্দেশনার কারণে। আচার্যের কোনো উদ্যোগে নয়।

অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও এমন হাজারো অন্যায়, অনিয়ম, দুর্নীতি, অনৈতিক ঘটনা ঘটছে এবং খবর প্রকাশ হয়েছে। মেয়াদের ১০ বছরে আচার্য তা বিবেচনায় নেননি।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে কাজ করতে হয় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী। উপাচার্যদের নিয়োগের ক্ষেত্রেও সেটাই হওয়ার কথা। তারপরও উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে আচার্যর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতায় হয়তো সবকিছু করতে পারতেন না, কিন্তু 'নৈতিক কর্তৃত্ব' থেকে কথা তো বলতে পারতেন। উপাচার্যদের অপসারণের ক্ষমতা তো তার হাতে ছিল।

মাটি ও মানুষের সঙ্গে রাজনীতি করে উঠে আসা মানুষটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে সম্মানজনক পদে থেকে বিশেষ কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, এমনটি আমরা দেখতে পেলাম না। তিনি সাধারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্যও লন্ডন বা জার্মানি গেছেন বারবার।

খেলাপি ঋণের দিকে তাকালে কি দেখতে পাই? ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে, তখন খেলাপি ঋণ ছিল প্রায় সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা। সরকারের গত প্রায় ১৫ বছরের মেয়াদকালে এর পরিমাণ ঘোষিতভাবেই হয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। বাস্তবে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩-৪ লাখ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে পরিশোধযোগ্য ঋণের মাত্র ২ শতাংশ পরিশোধের মাধ্যমে ১০ বছরের জন্য ঋণখেলাপিদের নাম খেলাপির তালিকা থেকে কাটানোর জন্য বিশেষ সুযোগ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ জনগণের ব্যাংক থেকে জনগণের টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার একটি পথ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে।

এখন রাষ্ট্রপতি বলছেন, এই খেলাপি ঋণের ১ শতাংশের জন্যেও সাধারণ জনগণ দায়ী নয়। কিন্তু যারা দায়ী তাদের বিষয়ে গত ১০ বছরে রাষ্ট্রপতি একটি কথাও বলেননি।

বলা হতে পারে, এটা তার এখতিয়ারে নেই। কিন্তু, তাই যদি হয়, তাহলে এখন তিনি যে কথাগুলো বললেন, সেটাও তো তার এখতিয়ারে নেই। খেলাপি ঋণের দায় যাদের, রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা হয়তো তিনি নিতে পারতেন না, কিন্তু দেশ ও জাতির অভিভাবক হিসেবে এ বিষয়ে কথা তো বলতে পারতেন।

দুর্নীতি, আর্থিকখাতের জালিয়াতি, লাখো কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ বিষয়ে রাষ্ট্রপতি নীরব থেকেছেন তার ২ মেয়াদের পুরো সময়কালে।

মাটি ও মানুষের সঙ্গে রাজনীতি করে উঠে আসা মানুষটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে সম্মানজনক পদে থেকে বিশেষ কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, এমনটি আমরা দেখতে পেলাম না। তিনি সাধারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্যও লন্ডন বা জার্মানি গেছেন বারবার। অনেক সময় তিনি বাংলাদেশ বিমান থেকে একটি উড়োজাহাজ নিয়ে দেশের বাইরে গেছেন, যার জন্য জনগণের করের টাকা থেকে বিপুল অংকের অর্থ খরচ হয়েছে।

ক্ষমতা সীমিত হলেও, যা কিছু করার ছিল, কিছু বিষয়ে কথা বলার যে সুযোগ ছিল, আমাদের পর্যবেক্ষণ বলে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তা করেননি। এখন যে কিছু ভালো কথা বলছেন, সেটা দিয়ে হয়তো ইমেজ তৈরি হতে পারে, কিন্তু দুর্নীতি বন্ধে, খেলাপি ঋণ কমাতে বা ছাত্র রাজনীতিকে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কোনো উপকার হবে বলে মনে হয় না।

mortoza@thedailystar.net

Comments