তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া

হেলমেট পরিচয় লুকাতে পারে না

ছবি: স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

আমাদের হৃদয় এতটাই শক্তপোক্ত হয়ে গেছে যে, নাহিদ মিয়াদের পিটিয়ে হত্যার ভিডিওচিত্র অবলীলায় দেখে ফেলতে পারি। হত্যাকারী হেলমেট বাহিনীকে দেখে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাই যে, তাদের কিছু হবে না। আমাদের কিছুটা আবেগ তাড়িত করে হত্যার শিকার নাহিদের স্ত্রীর হাতের তালুর মেহেদির রঙে লেখা ভালোবাসার কথা। সেই আবেগ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। সামনে আসে দোকান কর্মচারী মোরসালিনের মৃত্যুর সংবাদ। যিনি শিক্ষার্থী-ব্যবসায়ী সংঘর্ষে আহত হয়েছিলেন। চিকিৎসকরা তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনিও চলে গেছেন। তার ওপরও নির্ভরশীল ছিল একটি পরিবার। স্ত্রী, দুটি ফুটফুটে সন্তানের জীবন বিপন্ন হয়ে গেল। মোরসালিনের মেয়ে আর কোনোদিন বলতে পারবে না, বাবা আমার চুলের ব্যান্ড নিয়ে এসো!

পরিবারটির অবস্থা এখন কী হবে, খোঁজ নেওয়ার বা জানার সময় নেই কারও। এরইমধ্যে ২৪ জনের নামসহ ৩ মামলায় অজ্ঞাত আসামি ১২০০। ইতোমধ্যে প্রধান আসামি বিএনপি নেতা মকবুলকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।

এরমধ্যে ২টি হত্যা মামলা। যদিও পরিবারের পক্ষ থেকে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় বলা হয়েছে, বিচার চাই না। বিচার হয় না বা বিচার চাওয়ার জন্যে যে অর্থ দরকার তা তাদের নেই।

পুলিশের করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, অ্যাডভোকেট মকবুলসহ অজ্ঞাত ২০০ থেকে ৩০০ আসামি লাঠি, রড ও হকিস্টিক নিয়ে হামলা চালান।

মামলার প্রধান আসামি অ্যাডভোকেট মকবুল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি নিউমার্কেট এলাকায় ৪ মাস ধরে যাই না। এই ঘটনায় রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমাকে প্রধান আসামি করা হয়েছে।' (২১ এপ্রিল ২০২২)।

মামলার এজাহারে লেখা পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী অ্যাডভোকেট মকবুলের নেতৃত্বে হামলা হয়েছে। আর মকবুল বলেছেন, গত ৪ মাস তিনি নিউমার্কেট এলাকায় যান না। কার বক্তব্য সঠিক? কে সত্য বলছেন?

দ্য ডেইলি স্টারের আলোকচিত্রী ডেলিভ্যারিম্যান নাহিদকে রড দিয়ে পেটানো ও গরু জবাই করা ছুরি দিয়ে কোপানোর দৃশ্য ধারণ করেছেন।

দ্য ডেইলি স্টার তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, আলোকচিত্র ও ভিডিওতে কালো হেলমেট ও ধূসর টি-শার্ট পরা এক যুবককে ধারালো অস্ত্র দিয়ে নির্বিচারে নাহিদকে আঘাত করতে দেখা গেছে। লাল টি-শার্ট ও হেলমেট পরা আরেকজন যুবক তাকে বাধা দিতে আসেন। এরপর তারা ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের পাশে ফিরে যান।

হত্যা মামলার তদন্তকারী গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নাহিদকে কোপানো যুবকের নাম জাকির। জাকির ছাত্রলীগের কর্মী বলে জানান তারা।

নাহিদকে প্রথম আঘাত করেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী কাইয়ুম। তার পরনে সাদা ডোরাকাটা নীল টি-শার্ট ছিল বলে জানান তারা। (২৪ এপ্রিল ২০২২)।

এখন পর্যন্ত জনসম্মুখে আসা কোনো আলোকচিত্র বা ভিডিওচিত্রে বিএনপি নেতা মকবুলসহ মামলায় নাম উল্লেখ করা আসামিদের কাউকে দেখা যায়নি। নিউমার্কেট থেকে ঢাকা কলেজ এই এলাকায় অনেক সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। সেইসব সিসিটিভি ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করলে কোনো না কোনো ক্যামেরায় মকবুলসহ নাম উল্লেখ আসামিদের দেখা যাওয়ার কথা। পুলিশ তা দেখেছে বা তেমন কোনো তথ্য পুলিশের কাছে আছে, তা জানা যায়নি। যাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি, তাদের নামে মামলা হলো। গ্রেপ্তারও করা হলো। আর যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ, ভিডিওচিত্রে যাদের দেখা গেল, তাদের কারও নামে এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হলো না। গ্রেপ্তার তো পরের কথা। নাম প্রকাশ না করে পুলিশের একটি সূত্র দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছে, উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে চাচ্ছে না পুলিশ। এতে পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। সময় নেওয়া হচ্ছে।

হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত অপরাধী ধরার ক্ষেত্রে এটা কেমন যুক্তি?

বিএনপি নেতাদের নামে মামলা-গ্রেপ্তারে পরিস্থিতির অবনতি হবে না, ফলে তড়িঘড়ি ব্যবস্থা?

নিউমার্কেটের দুই দোকানের কোন্দলকে কেন্দ্র করে একপক্ষের হয়ে ঢাকা কলেজ থেকে মাঝরাতে নিউমার্কেটে গিয়ে হেলমেটধারী যারা ভাঙচুর করেছিল, তাদের পরিচয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গণমাধ্যমের জানা। পরের দিনের সংঘর্ষে ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব দেওয়া হেলমেট বাহিনীর পরিচয়ও এখন আর অজানা নয়। এই হেলমেট বাহিনী প্রথম দৃশ্যমান হয়েছিল ২০১৮ সালে স্কুল শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময়। সেই সময় হেলমেট বাহিনী স্কুল শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছিল। হেলমেটের আড়াল থেকে গণমাধ্যম তাদের অনেকের পরিচিতি প্রকাশ করেছিল। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনুসন্ধান করেনি, ব্যবস্থা নেয়নি।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়র এক ছাত্রলীগ নেতা শিক্ষার্থী তরিকুলকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পঙ্গু করে দিয়েছিল। টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিয়ে সেই নেতা দায় স্বীকার করে বলেছিল, আমি হলেই আছি পালিয়ে যাইনি। তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সেই ধারাবাহিকতাতেই এবারের সংঘর্ষে আবার দেখা মিলল হেলমেট বাহিনীর। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ব্যবসায়ীদের পক্ষেও হেলমেট বাহিনী দেখা গেছে। সংঘর্ষে নিজেকে রক্ষা ও চেনা না যাওয়ার ঢাল হিসেবে হেলমেট ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত, হত্যার দায়ে অভিযুক্তদের দায়মুক্তি দিয়ে বা দায় অন্যের ওপর চাপিয়ে আমরা কেমন দেশ-সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছি?

'বিচার হয় না', 'বিচার পাব না', 'বিচার চাই না'- তেমন সমাজ-দেশই কী আমরা প্রতিষ্ঠা করছি না?

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

If consensus commission fails, it will be a collective failure: Ali Riaz

He made the remarks in his opening statement during the 14th day of the second phase of dialogues with political parties

1h ago