ইবি উপাচার্য-প্রক্টর-প্রভোস্ট কি নির্যাতনকারীদের পক্ষে

ছাত্রলীগের ২ নেত্রীর নেতৃত্বে সারারাত ধরে নির্যাতন করা হয়েছে সাধারণ এক অনাবাসিক শিক্ষার্থীকে। আলোচনার বিষয় সরাসরি এটা নয়, আলোচনার বিষয় নির্যাতন পরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রক্টর ও হল প্রভোস্টের ভূমিকা নিয়ে।
ছবি: স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিপীড়ন-নির্যাতনে এক ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে ছাত্রলীগ। বুয়েটের আবরার হত্যা থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল, প্রথমে 'শিবির' আখ্যা দিয়ে সারারাত ধরে নির্যাতন। আজ আলোচনা করব কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) নির্যাতনের ঘটনাটি নিয়ে। সবাই জানি যে, ছাত্রলীগের ২ নেত্রীর নেতৃত্বে সারারাত ধরে নির্যাতন করা হয়েছে সাধারণ এক অনাবাসিক শিক্ষার্থীকে। আলোচনার বিষয় সরাসরি এটা নয়, আলোচনার বিষয় নির্যাতন পরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রক্টর ও হল প্রভোস্টের ভূমিকা নিয়ে। 

প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো পরিচালনার দায়িত্ব তারা অঘোষিতভাবে ছাত্রলীগকে দিয়ে রেখেছেন। দ্বিতীয়ত, হলে একটি নির্যাতনের ঘটনা ঘটার পরে উপাচার্য-প্রক্টর-হল প্রভোস্ট তথা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কী করে? তারা কি প্রকৃত সত্য জানার চেষ্টা করে? নির্যাতনকারীদের পক্ষে না বিপক্ষে অবস্থান নেয়? নির্যাতনের ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার আগে ও পরে ইবি প্রশাসনের অবস্থান কেমন ছিল?

খুব সংক্ষেপে ঘটনাটি আবার একটু জেনে নেই। ১২ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টার দিকে একজন অনাবাসিক ছাত্রী ফুলপরীকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের গণরুমে ডেকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা ও তাবাসসুম ইসলামের নেতৃত্বে  ভোররাত সাড়ে ৩টা পর্যন্ত নির্যাতন করা হয়েছে।

নির্যাতনের একপর্যায়ে তাকে বিবস্ত্র করে ভিডিওধারণ করা হয় জানিয়ে ফুলপরী লিখিত অভিযোগে বলেছেন, 'বিবস্ত্র করে ভিডিওধারণের সময় হুমকি দেওয়া হয়। বলা হয়, এই কথা কাউকে জানালে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হবে। সানজিদা, তাবাসসুম আপুরা মারার সময় বলছিল, মুখে মারিস না, গায়ে মার যেন কাউকে দেখাতে না পারে।'

বিষয়টি নিয়ে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে টেলিফোনে কথা বলেছিলাম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রক্টর ও হল প্রভোস্টের সঙ্গে।

প্রক্টর বললেন, 'আমি ২টি অভিযোগ পেয়েছি। যিনি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিনি লিখিত অভিযোগ করেছেন। সানজিদা চৌধুরী অন্তরাও একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।'

সানজিদা চৌধুরী অন্তরা মানে যার বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ?

'হ্যাঁ, তিনিও একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন', বলেন প্রক্টর।

সানজিদা কী লিখেছেন?

'ভুক্তভোগী নতুন মেয়েটি লিখিতভাবে নির্যাতনের অভিযোগ দিয়েছেন এবং অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেত্রীও লিখিতভাবে নিজের অবস্থান জানিয়ে ও নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করেছেন। লিখেছেন তারা এ ধরনের কোনো নির্যাতন করেননি।'

তার মানে তো অভিযোগ নয়, সানজিদা আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন?

'আমি ২টি আবেদনের ওপর প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার কথা লিখে উপাচার্যের কার্যালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি।'

এত গুরুতর অভিযোগের পর ৩ দিন চলে গেল। কিছুই করা সম্ভব হলো না?

প্রক্টরের বক্তব্য, 'আমরা বিষয়টি জানতে পেরেছি ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনের প্রায় শেষের দিকে। ১৫ ফেব্রুয়ারি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি ৭ দিন পর প্রতিবেদন দিলে তার ওপর ভিত্তি করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

১২ ফেব্রুয়ারি  হলে যে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, প্রক্টর বলছেন তিনি তা জেনেছেন ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনের শেষে। হলের দায়িত্বে থাকা প্রভোস্ট ড. শামসুল আলম এই সময়কালে কী করেছিলেন?

১৫ ফেব্রুয়ারি প্রশ্নটি করেছিলাম ড. শামসুল আলমকে। তিনি বললেন, '১২ ফেব্রুয়ারি দুপুর আড়াইটার দিকে আমার কাছে ৩০-৩৫ জন ছাত্রী আসে নতুন অনাবাসিক ছাত্রী ফুলপরীকে সঙ্গে নিয়ে। ফুলপরীকে একটু কাঁদো কাঁদো দেখলাম। তারা বলে, ফুলপরীর বড় বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তিনি তার বন্ধুকে দিয়ে আমাদের হুমকি দিয়েছেন।'

৩০-৩৫ জন শিক্ষার্থী অভিযোগ করলেন?

'হ্যাঁ, তারা সবাই অভিযোগ করলেন।'

তাদের মধ্যে কি নির্যাতনকারী হিসেবে অভিযুক্ত সানজিদা অন্তরা ও তাবাসসুম ছিলেন?

'হ্যাঁ, ছিল।'

ফুলপরীর বড় বোনের বন্ধু ঢাকা থেকে দাপুটে ছাত্রলীগ নেত্রী সানজিদাদের হুমকি দিলেন কীভাবে?

'টেলিফোনে হুমকি দিয়েছে বলে তারা অভিযোগ করে।'

নতুন একজন অনাবাসিক ছাত্রী তার ঢাকায় থাকা বোনের বন্ধুকে দিয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের হুমকি দেওয়ালেন? আপনার কাছে এটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো?

'তারা তো অভিযোগ করছে। যা–ই হোক, ফুলপরী কীভাবে হলে উঠেছে তাও আমি জানি না। ছাত্রীরা দাবি করছে, তাকে হল থেকে বের করে দিতে হবে। আমি ফুলপরীকে বললাম, তুমি তাহলে হলের বাইরে থাকো, মেসে থাকো। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পরে সোয়া ৩টার দিকে ৩০-৩৫ জন ছাত্রী ফুলপরীকে নিয়ে আবার আমার কাছে এলো। তারা বলল, ফুলপরী তার বোনের আরও কোনো বন্ধুকে দিয়ে আবার হুমকি দিয়েছে। তখন আমি প্রক্টরকে জানাই। প্রক্টরিয়াল বডির ২ জন সদস্য আসেন। আমরা তখন জানলাম, ফুলপরীর বাবা ভ্যানচালক। ও এখন কোথায় যাবে। কয়েকটি দিন সময় দেই। সে যদি সংশোধন হয়ে যায়, তাহলে তো সমস্যা নেই। অভিযোগকারী ছাত্রীদের কনভিন্স করার চেষ্টা করলাম। তারাও মেনে নিলো। আমরা মিটমাট করে দিলাম। ১৩ ফেব্রুয়ারি সকালে জানলাম যে ফুলপরী হল থেকে চলে গেছে। বাই দ্য বাই জানলাম যে রাতে তার ওপর আরও টর্চারিং হয়েছে। যদিও আমার কাছে লিখিত কোনো অভিযোগ আসেনি।'

ফুলপরী একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছিল না?

'না, ১৩ তারিখে দেয়নি। ১৩ তারিখ দিবাগত রাতে সানজিদাসহ কয়েকজন ফুলপরীকে টর্চারিং করেছে, এমন সংবাদ পেপারে এসেছে। হলের আবাসিক ছাত্রীরা অনেক রাতে মিছিল বের করে। হলের তালা ভেঙে মিছিল নিয়ে উপাচার্যের বাংলোতে যায়। প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা আসেন। আমি যাই। তাদের দাবি, পেপারে যা এসেছে তা প্রত্যাহার করতে হবে। উপাচার্য টেলিফোনে তাদের আশ্বাস দিয়ে হলে ফেরত পাঠায়।'

ফুলপরীর লিখিত কোনো অভিযোগ পাননি?

১৪ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টার দিকে ফুলপরী একটি লিখিত অভিযোগ দিয়ে গেছে হলে। তার পরিপ্রেক্ষিতে একটি তদন্ত কমিটি করে দিয়েছি। ৭ কর্মদিবসের মধ্যে তারা রিপোর্ট দিলে সবকিছু জানা যাবে।'

এরপর কথা বলি উপাচার্য অধ্যাপক শেখ আব্দুস সালামের সঙ্গে। তিনিও বললেন, ২টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ৭ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিলে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে।

উপাচার্যকে প্রশ্ন করেছিলাম, আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে একজন শিক্ষার্থীকে সারারাত ধরে নির্যাতনের অভিযোগ আসলো, বিবস্ত্র করে ভিডিওধারণের অভিযোগ উঠল। ৩ দিন হয়ে গেল। কিছুই করলেন না?

তার বক্তব্য, 'তদন্ত কমিটি রিপোর্ট না দেওয়া পর্যন্ত কিছু করা সম্ভব না। আমাদের তো সত্যতা জানতে হবে।'

কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রক্টর-প্রভোস্ট-উপাচার্যের বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এর মধ্য দিয়ে বোঝা যায় কেন এবং কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিপীড়ন-নির্যাতন চলছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কীভাবে নির্যাতনকারীদের পক্ষ নেয়, তা মোটামুটি পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। 

লক্ষ্য করুন, ফুলপরীর মতো দরিদ্র-নতুন একজন শিক্ষার্থীর ওপর নির্যাতন শুরু হয়েছে ১২ ফেব্রুয়ারি দুপুর থেকে। প্রভোস্ট প্রক্টরিয়াল বডিকে জানিয়েছেন ১৩ ফেব্রুয়ারি বিকেলে। প্রক্টর বলছেন, তিনি জেনেছেন ১৪ তারিখ দিন শেষে। বক্তব্যের গড়মিল লক্ষণীয়। আরও লক্ষণীয়, প্রভোস্ট নির্যাতনকারী সানজিদাদের পক্ষ নিয়ে, বিশ্বাস করে ফুলপরীকেই অভিযুক্ত করছেন যে, তিনি হুমকি দিয়েছেন বোনের বন্ধুদের দিয়ে। হলটি নিয়ন্ত্রণ করেন ছাত্রলীগ নেতা সানজিদারা। তাদের মতো এমন দাপুটে নেতাদের হুমকি দেওয়াবেন ফুলপরী, তা বিশ্বাস করছেন প্রভোস্ট। অথচ হল প্রভোস্টই সবচেয়ে ভালো জানেন সানজিদাদের দাপট ও ক্ষমতা সম্পর্কে।

১২-১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তদন্ত কমিটি গঠন করা ছাড়া আর কোনো উদ্যোগ নেয়নি ইবি প্রশাসন। ১৬ ফেব্রুয়ারি একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের নির্দেশনার পর কিছু ব্যবস্থা দৃশ্যমান হয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশে প্রভোস্ট অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা সানজিদা চৌধুরী অন্তরা ও তাবাসসুম ইসলামকে হল ছাড়ার নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে ছাত্রলীগও সংগঠন থেকে তাদের সাময়িকভাবে অব্যাহতি দিয়েছে।

একজন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তার সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি গঠনেরও নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
দুটি তদন্ত কমিটি ইতোমধ্যে নির্যাতনের শিকার ফুলপরীর বক্তব্য শুনেছেন। তদন্তে প্রকৃত সত্য বের হয়ে আসবে, সম্ভাবনা কতটা? তদন্তের আগে 
মন্তব্য করা যাবে না। তবে এ কথা বলা যায় যে, তদন্ত কমিটি বিষয়ক অভিজ্ঞতায় আশাবাদী হওয়ার তেমন সুযোগ থাকে না।

তবে সবচেয়ে মৌলিক প্রশ্ন এটা যে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের অপকর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে, প্রকারান্তরে 
অপরাধীদের পক্ষ নেয়, কোনো তদন্ত কমিটি করে সুফল পাওয়া যাবে? সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নির্যাতন বন্ধ হবে?

Comments

The Daily Star  | English

Upazila Polls: AL, BNP struggle to keep a grip on grassroots

The upazila election has exposed how neither of the two major parties, the Awami League and BNP, has full control over the grassroots leaders.

7h ago