অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের গুরুত্ব

ইলাস্ট্রেশন: কাজী তাহসীন আগাজ অপূর্ব

খুব সম্ভবত ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের ২৫ বছর পূর্তির মাইলফলকটি জাঁকজমকের সঙ্গে উদযাপনের জন্য সরকারি কর্মকর্তারা উঠেপড়ে লেগেছেন। তবে স্থানীয় শিল্পীরা এসব আয়োজনে অংশ নেবেন ভারাক্রান্ত হৃদয়ে। এই অনিচ্ছুক শিল্পী, সংশ্লিষ্ট বেসামরিক ও সামরিক ব্যক্তিবর্গ এবং অন্যান্যদের সঙ্গে আমি সমব্যথী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরছি। 

বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানে দেশের পার্বত্য অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়নি। ২০১১ সালে এতে নতুন করে ২৩(ক) অনুচ্ছেদটি যোগ করা হয়, যেখানে এই গোষ্ঠীকে 'উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়' হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এই শব্দগুলোর বর্ণবাদী ও বৈষম্যমূলক অন্তর্নিহিত অর্থ আইনজ্ঞ, মানবাধিকার কর্মী, নৃতত্ত্ববিদ ও যাদের এসব নামে ডাকা হচ্ছে, তাদের আজও বিহ্বল করে যাচ্ছে। 

পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠী নিজেদের 'আদিবাসী' হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং তাদের কাছে এই বিচিত্র ও নতুন শব্দগুলো অবমাননাকর। 

ওড়না ও টিপের উপাখ্যান 

আপনারা হয়তো ২০২২ সালের ২ এপ্রিলে টিপ পরা নিয়ে বিতর্কের ঘটনাটির কথা শুনে থাকবেন। তেজগাঁও কলেজের সনাতন ধর্মাবলম্বী অধ্যাপক ড. লতা সমাদ্দারকে পুলিশের একজন সদস্য মৌখিকভাবে হেনস্তা করেন। তার 'দোষ' কী ছিল? তিনি টিপ পরেছিলেন। পুলিশের সেই সদস্য ভেবেছিলেন তিনি একজন মুসলমান নারীর সঙ্গে কথা বলছেন। তবে তা সত্ত্বেও, টিপ-পরিহিত নারী যে ধর্মই পালন করুন না কেন, এ ধরনের আচরণ পুলিশ সদস্যের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। 

একইভাবে, পার্বত্য জনগোষ্ঠী ও বাঙ্গালী নারীদের পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা তল্লাশির চৌকিতে ওড়না না পড়ার কারণে হেনস্থা করা হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলের অনেক পুরুষকে হাফ-প্যান্ট পরার জন্যেও অপমানজনক কথা শোনানো হয়েছে। কেন? কারণ এটা নাকি 'অশালীন' ও বাংলাদেশের 'সংস্কৃতি-সামাজিকতার' পরিপন্থী। 

২০১১ সালে সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমে দৃষ্টিভঙ্গির আকস্মিক পরিবর্তন 

বাংলাদেশ ইতালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কস লিমিটেড (২০১০) ও সিদ্দিক আহমেদের (২০১১) মামলার রায়ে দেশের সুপ্রিম কোর্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনের সময় জারি করা আইনকে বাতিল, অবৈধ ও অসাংবিধানিক হিসেবে ঘোষণা দেন।

১৯৭৫ সালের ক্যুর পর দেশের মতাদর্শ, রাজনৈতিক অর্থনীতি, আইন ও প্রশাসনের মৌলিক রূপান্তর ঘটে। এর ফলে দেশের ভেতরে ও বাইরে বিভিন্ন দেশ, জনগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ ও বৈরি সম্পর্ক, উভয়ই তৈরি হয়। সে সময়ের কিছু কার্যক্রম ও সম্পর্কের নেতিবাচক প্রভাব আজও আমাদের বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। 

সমাজতন্ত্রের কিছু ধ্যানধারণাকে (অনুচ্ছেদ ৮ ও ১০) ২০১১ সালে আবারও সংবিধানে ফিরিয়ে আনা হলেও তা ছিল শুধু প্রতীকী, বাস্তবে এর কোনো প্রয়োগ ছিল না। ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতার অনুচ্ছেদগুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল, যেটি ১৯৭১ সালের চেতনাকে অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করেছে। রাষ্ট্রধর্ম সংক্রান্ত অনুচ্ছেদে ২(ক) ইসলাম ছাড়া অন্যান্য ধর্মকে মেনে নেওয়া হলেও এটি ৮ ও ১২ নম্বর ধারার মতাদর্শের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়, বিশেষত ১২(ঘ), যেখানে বলা হয়েছে, 'কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন, বিলোপ করা হইবে'। 

টিপ, ওড়না ও হাফ প্যান্টের প্রেক্ষাপটে সংবিধানের উল্লেখিত অনুচ্ছেদগুলো প্রয়োগ করা হলে, যেকোনো সাংবিধানিক আইন ও মানবাধিকারের শিক্ষার্থীর কাছে বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে পরিষ্কার হবে, বাংলাদেশের একজন অমুসলিম নাগরিককে জানানো, তিনি টিপ পরতে পারবেন না, ওড়না পরতে তিনি বাধ্য—এ বিষয়টি সংবিধানের উল্লেখিত অনুচ্ছেদের সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। 

একইভাবে, একজন বাংলাদেশি মুসলিম নারীকে জানানো যে, তিনি ওড়না পরতে বাধ্য কিংবা তিনি টিপ পরতে পারবেন না এবং একইসঙ্গে একজন বাংলাদেশি নারী বা পুরুষকে জানানো, তিনি হাফ প্যান্ট পরতে পারবেন না, কিন্তু তার অমুসলিম বন্ধুরা পরতে পারবেন—এ বিষয়গুলো সংবিধানের ২৭ ও ২৮(ক) অনুচ্ছেদের মতাদর্শের সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। এই অনুচ্ছেদগুলোতে বলা হয়েছে, 'সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী (অনুচ্ছেদ ২৭) এবং কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না (অনুচ্ছেদ ২৮(ক)।' এ ছাড়া অনুচ্ছেদ ২(ক)-তে বলা হয়েছে, 'প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।'

একটি বহুজাতিক বাংলাদেশ ও ১৯৯৭ সালের চুক্তির বাস্তবায়ন 

পার্বত্য চট্টগ্রাম হচ্ছে বাংলাদেশের অল্প কিছু জায়গার অন্যতম, যেখানে আপনারা প্রতিদিনই ধর্মনিরপেক্ষতা, বহুসংস্কৃতিবাদ ও অসাম্প্রদায়িকতার  চর্চা দেখবেন। অন্তত, যেখানে স্থানীয় সংগঠন ও নাগরিকরা সংশ্লিষ্ট আছেন।

আমি পার্বত্য চট্টগ্রামের এমন কোনো ঘটনার কথা শুনিনি, যেখানে একজন নারীকে বোরখা, হিজাব বা টিপ পরার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করা হয়েছে। এখানে উল্লিখিত নারীর ধর্ম কোনো ভূমিকা রাখেনি। ওড়না ও হাফ প্যান্টের ঘটনাগুলো সাম্প্রতিক। উভয় ক্ষেত্রেই ঘটনাগুলো নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের উদ্যোগে ঘটেছে। এর জন্য তাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগও দায়ী হতে পারে, আবার তাদের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সরাসরি নির্দেশেরও ভূমিকা থাকতে পারে। উভয় ক্ষেত্রেই, তাদের নেওয়া উদ্যোগগুলো সংবিধানের সুনির্দিষ্ট অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন করেছে, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনীর শৃঙ্খলা ও পেশাদারিত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে বড় আকারের সমস্যা সৃষ্টি করেছে। 

যদি ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম  চুক্তি পুরোপুরি এবং নিষ্ঠার সঙ্গে বাস্তবায়ন করা হতো, তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের পথে পথে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের এতগুলো তল্লাশি-চৌকি বসাতে হত না। কাপড়, মেকআপ বা এ ধরনের বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর তো কোনো প্রশ্নই উঠতো না। এসব কার্যক্রম এমনিতেও তাদের আইনি সনদ বা বাংলাদেশের কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা নিরাপত্তা সংস্থার সনদের অংশ নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামেও নয়, দেশের অন্য কোনো জায়গাতেও নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে এ ধরনের বৈষম্যপূর্ণ আচরণের সংখ্যা যদি বাড়তে থাকে বা একই ধারায় চলতে থাকে, তাহলে তা শুধু এ অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষদের পরিচয় ও চারিত্রিক সততার প্রতি হুমকিস্বরুপ হবে না, বরং একই সঙ্গে সামগ্রিকভাবে দেশের অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চার ওপর হুমকি হিসেবে বিবেচিত হবে। 

১৯৯৭ সালের চুক্তির বাস্তবায়ন শুধু শান্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠা বা স্বায়ত্তশাসনের বিষয় নয়, এর সঙ্গে সংস্কৃতি, আত্মপরিচয় ও পুনর্বাসনসহ অন্য অনেক কিছু জড়িত। বস্তুত এই চুক্তির বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ সার্বিকভাবে আরও অনেক ধরনের সুফল পাবে।  

প্রথমত, ভূমি ও বন ব্যবস্থাপনায় পাহাড়ি জনগোষ্ঠী সুষ্ঠু ভূমিকা পালন করলে তা বন, নদীর পানি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। দ্বিতীয়ত, আর কখনো সাম্প্রদায়িক ও ধর্মভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনগুলো পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বে প্রতি কোনো ধরনের হুমকির সৃষ্টি করতে পারবে না। (ধারণা করা হয়, সাম্প্রতিককালে সশস্ত্র ইসলাম-ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনগুলো বান্দরবন জেলায় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের হত্যা করেছে)। তৃতীয়ত, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমানা আরও স্থিতিশীল ও নিরাপদ থাকবে। এতে দীর্ঘমেয়াদে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের উপকার হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের পক্ষে শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ করে তাদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও সামাজিক সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে পারবেন। 

 

রাজা দেবাশীষ রায়: পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা সম্প্রদায়ের প্রথাগত রাজা। তিনি একইসঙ্গে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী। তিনি লন্ডনের ইনস অব কোর্ট স্কুল অব ল থেকে ব্যারিস্টার-এট-ল ডিগ্রি লাভ করেন। এ ছাড়া তিনি মানবাধিকার ও পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

 

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

 

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

14h ago