রোডম্যাপ ঘোষণা করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৫ বছর পূর্তিতে দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে আয়োজিত আলোচনা সভায় অংশ নেওয়া বক্তারা। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

২৫ বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে যে চুক্তি হয়েছিল, তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া বক্তারা। তারা বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয়য়গুলো এখনো অবাস্তবায়িত থাকার কারণে এ অঞ্চলে এখনো স্থায়ীত্বশীল শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পাশাপাশি এ এলাকায় বিশেষ শাসন ব্যবস্থা কার্যকর না হওয়ার কারণে স্থায়ীত্বশীল, গণমুখী ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন নানাভাবে ব্যহত হচ্ছে।

এ অবস্থায় একটি রোডম্যাপ ঘোষণার মাধ্যমে দ্রুত পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন তারা।

আজ সোমবার রাজধানীর দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে 'পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৫ বছর: পার্বত্য চট্টগ্রামের টেকসই উন্নয়ন, সংকট ও সম্ভাবনা' শীর্ষক এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

কাপেং ফাউন্ডেশন, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, এএলআরডি ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম যৌথভাবে এই সভাটির আয়োজন করে।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে এ 'শান্তি' চুক্তি হয়েছিল। তবে দীর্ঘ সময়েও চুক্তির বেশির ভাগ বাস্তবায়ন করা হয়নি বলে অভিযোগ করে আসছেন পাহাড়ি নেতারা।

আজকের আলোচনা সভায় এই চুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে চুক্তি স্বাক্ষরকারী ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা বলেন, 'আমার জীবদ্দশায় আমি এই চুক্তি বাস্তবায়নের যে আশা-সম্ভাবনা সেটা আমি দেখি না। কিন্তু তরুণদের তা দেখতে হবে। নতুন আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তাদের এগিয়ে আসতে হবে।'

তিনি আরও বলেন, 'পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে অনেকগুলো মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন আছে। এখানে বিশেষ শাসন ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে আরও অনেক কিছু সংযোজনের প্রয়োজনও আছে।'

তবু পার্বত্য অঞ্চলের স্থায়ী অধিবাসীদের জন্য ৩ জেলা পরিষদ এবং আঞ্চলিক পরিষদের আইনের মধ্য দিয়ে দেওয়া বিশেষ শাসনের মধ্য দিয়ে যতটুকু অধিকারের স্বীকৃতি এখানে আছে, সেটুকুই আদায় করে নেওয়ার তাগিদ দেন তিনি।

এছাড়া বক্তব্যের বড় অংশজুড়ে পাহাড়ে 'পরিবেশবিনাশী' উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কঠোর সমালোচনা করেন সন্তু লারমা। তিনি বলেন, 'উন্নয়নের পূর্বশর্তটা কী? উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা। সুষ্ঠু প্রশাসন। সুষ্ঠু আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনা। এগুলো ব্যতিরেকে উন্নয়নের তো সম্ভাবনা নাই। আমি দেখি না।

তিনি আরও বলেন, 'সুষ্ঠু শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা না থাকলে, আইনশৃঙ্খলার ব্যবস্থাপনা না থাকলে সে উন্নয়ন জনগণের অনুকূলে যেতে পারে না। জনগণের স্বার্থ পূরণ করে দিতে পারে না।'  

চুক্তি স্বাক্ষরের পর খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে যেদিন অস্ত্র সমর্পন হয় সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন অর্থনীতিবিদ ও এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। সেদিনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, 'সেদিনের যে উচ্ছ্বাস, সেদিনের যে প্রত্যাশা, সেদিনের যে আকাঙ্ক্ষা, উভয়পক্ষের যে ত্যাগের মনোভাব, আজ ২৫ বছর পর তা অনেকটাই তিরোহিত হয়ে গেছে।'

আলোচনা সভায় বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মেজবাহ কামাল বলেন, 'চুক্তি না করার যদি কোনো পথ থাকত তাহলে রাষ্ট্র এই চুক্তি করত না। খুব বাধ্য হয়ে চুক্তি করেছে রাষ্ট্র। কিন্তু এই চুক্তি বাস্তবায়ন করছে না। ফলে আমাদের সম্মিলিত যে সংগ্রাম সেই সংগ্রামটা চলছে।'

তার ভাষ্য, 'যদি বাঙালির চোখ দিয়ে আদিবাসীদের দেখা হয় তাহলে সেই সমস্যা বুঝতেই পারবে না, অনুধাবন করতে পারবে না (রাষ্ট্র)। এই রাষ্ট্র (পাহাড়িদের) বাঙালির চোখ দিয়ে দেখে। প্রায়শ মুসলমানের চোখ দিয়ে দেখে।'

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, 'প্রতিবছর আমরা একই কথা বলি যে, এমন ঐতিহাসিক একটি কাজ করার পরেও কেন সরকার এটি ঠিকমতো বাস্তবায়ন করার জন্য উদ্যোগ নিলো না। আমরা যখন এই প্রশ্নগুলো তুলি তখন বলা হয়, এতগুলো ক্লজের ভেতর এতগুলো বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আমরা যদি এই ক্লজগুলো পরীক্ষা করে দেখি, তাহলে দেখা যাবে, আসল যে ক্লজগুলোর বাস্তবায়ন হওয়ার কথা ছিল সেগুলোই হয়নি।'

পাশাপাশি এখন পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের মানবাধিকার, তাদের মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, 'এ অবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের হতাশ হওয়ার প্রচুর কারণ রয়েছে।'

বেসরকারি সংস্থা এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, 'চুক্তি করার পর এর অঙ্গীকার থেকে দূরে সরে গিয়ে চুক্তি বিরোধী কার্যক্রমকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে, পুষ্ট করা হয়েছে, যেটা গ্রহণযোগ্য না।'

মুক্ত আলোচনা পর্বে অংশ নেওয়া বান্দরবানের পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সদস্য জুয়ামলিয়ান আমলাই আক্ষেপ করে বলেন, 'শান্তিচুক্তির কোনো সুফল আমরা পাইনি। বরং আমাদের বম সম্প্রদায়ের মানুষের পালিত গয়াল, ছাগল, মুরগি, শুকর বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে একটি নির্দিষ্ট চক্রের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়। আমরা এখনো বর্ণবাদের শিকার। আমাদের সম্প্রদায়ের অনেকে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন।'

সভার শুরুতে আলোচনার মূল বিষয়ের ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা। তিনি এই চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়নে একটি রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানান। পরে তার এই দাবির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন অন্যরা।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রংয়ের সভাপতিত্বে সভায় আরও বক্তব্য দেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন, বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজল দেবনাথ, প্রমুখ।

Comments

The Daily Star  | English
Income inequality in Bangladesh

Growth obsession deepened rich-poor divide

Income inequality in Bangladesh has seen a steep rise over the past 12 years till 2022, according to official data, as economists blame a singular focus on growth rather than sorting out income disparities.

16h ago