অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে দেশে মোটরসাইকেল শিল্প

Motorcycle industry

দৈনন্দিন নগর-জীবনে ট্র্যাফিক জ্যামের বিকল্প খুঁজতে দুই-চাকার বাহনের চাহিদা বেড়েছে বেশ। পাশাপাশি গ্রামগঞ্জেও দ্রুত বাহন হিসেবেও মোটরসাইকেলের জনপ্রিয়তা বেড়ে চলছে। আর তাই, ক্রেতাদের চাহিদা মেটাতে মোটরসাইকেল প্রস্তুতকারক প্রায় আধ-ডজনের বেশি কারখানা তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশে।

সম্প্রতি, রাইড শেয়ারিং সার্ভিস শুরু হওয়ার সাথে সাথে দুই-চাকার এই বাহন নতুন আঙ্গিকে হাজির হয়েছে মানুষের সামনে; বেগ সঞ্চার করেছে ধীর গতিতে বাড়তে থাকা এই মোটরসাইকেল খাতে। তথ্য-উপাত্ত বলছে, এখন বাজারে প্রতিদিন প্রায় ১,০০০ মোটরসাইকেল বিক্রি হচ্ছে, যা মাত্র পাঁচবছর আগেও ছিল এর অর্ধেক।

সংশ্লিষ্টরা ধারণা করেন, মোটরসাইকেলের এই বাজার ভবিষ্যতে আরো বহু গুণে বাড়বে। মানুষের আয়ের ধারাবাহিক বৃদ্ধি, অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি আর অনুকূলে থাকা নীতিমালা এবং শুল্ক ব্যবস্থা ধীরে ধীরে বাংলাদেশকে মোটরসাইকেল উৎপাদনের দিকে নিয়ে যাবে। তারা আশা করেন, শীঘ্রই বাংলাদেশকে আর মোটরসাইকেল আমদানি করতে হবে না।

“এটি বিপুল সম্ভাবনার খাত,” বললেন বাংলাদেশের প্রথম মোটরসাইকেল এ্যসেমব্লিং প্ল্যান্ট রানার অটোমোবাইলসের চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান খান। “এখানে ব্যবসা সম্প্রসারণের প্রচুর সুযোগ আছে।”

বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ, ছয় শতাংশের ওপর ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি আর বিশাল যুবসমাজের ওপর ভিত্তি করেই তার এই পূর্বাভাস। ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিবেচনায় বাংলাদেশকে সারাবিশ্বেই এক উদীয়মান অর্থনীতি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

“এই প্রবৃদ্ধি-সমৃদ্ধ অঞ্চলের এক অনন্য বৈশিষ্ঠ হলো এর ৭৫ ভাগেরও বেশি জনসংখ্যা হচ্ছে যুবসমাজ- যাদের বয়স ৪০-এর নিচে। স্বাধীনচেতা এই যুবসমাজ দৈনন্দিন চলাচলে সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় একটি সমাধান চায়। একটি মোটরসাইকেল এই চাহিদা মেটাতে সক্ষম,” যোগ করলেন হাফিজুর।

“বর্তমানে, বাংলাদেশে প্রায় ১৯ শতাংশ বাসাবাড়িতে মোটরসাইকেলের ব্যবহার রয়েছে। কিন্তু, প্রতিবেশী ভারতেই চিত্রটা ভিন্ন – সেখানে প্রায় ৪৭ ভাগ বাসাবাড়িতে মোটরসাইকেলের ব্যবহার আছে, চীনে সংখ্যাটা প্রায় ৬০ শতাংশ, পাকিস্তানে ৪৩ শতাংশ, মালয়েশিয়াতে ৮৩ শতাংশ এবং থাইল্যান্ডে ৮৭ শতাংশ,” জানালেন মুকেশ শর্মা, রানার অটোমোবাইলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।

অর্থনীতির নিয়ম মতে, একটি দেশের মাথাপিছু ক্রয়ক্ষমতা চার হাজার মার্কিন ডলার ছাড়ালে যানবাহন কেনার চাহিদা বহু গুণে বেড়ে যায়। বাংলাদেশের মাথাপিচু ক্রয়ক্ষমতা প্রায় ৪ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলারের কাছাকাছি– যা কী না এদেশের অটোমোবাইল শিল্পের জন্য একটি শুভ সংকেত।

নজরকাড়া ইয়ামাহা সিরিজের মোটরসাইকেলের আমদানিকারক এসিআই মোটরস-এর নির্বাহী পরিচালক সুব্রত রঞ্জন দাস বলেন, “আমরা মোটরসাইকেলের বাজারে বিপুল সম্ভাবনা দেখি।”

আমদানি শুল্ক আর নীতিমালা অপরিবর্তিত থাকলে আগামী ২০২১ সাল নাগাদ ১০ লাখের বেশি মোটরসাইকেল বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনা দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়ে তিনি বলেন, “ভবিষ্যতে এসিআই মোটরস ইয়ামাহা ব্র্যান্ডের গাড়িগুলো বাংলাদেশেই প্রস্তুত করার বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে।”

সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৩ সালে মোটরসাইকেল বিক্রি ছিল বছরে দুই লাখেরও নিচে। পরবর্তীতে সরকার মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশের আমদানির ওপর সম্পূরক শুল্ক কমিয়ে আনার পর বাজার ব্যাপকভাবে চাঙ্গা হয়ে উঠে।

এরপর, ২০১৬-১৭ সালে দেশেই এ্যসেমব্লিং প্ল্যান্ট স্থাপন করার জন্য আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনার পর মোটরসাইকেলের দাম দ্রুত হ্রাস পায়। এতে মোটরসাইকেল কিনতে ক্রেতারা উৎসাহিত হন।

গত এক বছরে, মোটরসাইকেল কেনার হিড়িক পড়ে যায়– বিক্রি হয় সাড়ে ৩ লাখের ওপর গাড়ি, যা ছিল তার আগের বছরের তুলনায় ৪৪ শতাংশ বেশি। এসিআই মোটরস-এর নির্বাহী পরিচালক সুব্রত দাস জানান, “এটিই ছিল এক বছরে সর্বোচ্চ মোটরসাইকেল বিক্রির রেকর্ড।”

র‌্যানকন মোটর বাইকস লিমিটেডের আঞ্চলিক বিক্রয় ব্যবস্থাপক আশিকুল ইসলাম আশা করেন, মোটরসাইকেলের এই ক্রমবর্ধমান বাজার ২০১৯ সালের শেষ নাগাদ অটুট থাকবে। তিনি বলেন, “বছরখানেকের মধ্যেই সব বড় বড় কোম্পানি দেশে মোটরসাইকেল এ্যাসেমব্লি প্ল্যান্ট চালু করবে, আর দেশেই প্রস্তুত করবে নামি-দামি ব্র্যাণ্ডের গাড়ি।”

উল্লেখ্য, র‌্যানকন মোটরস ঢাকার অদূরে গাজীপুরে স্থাপন করছে নিজস্ব এ্যসেমব্লি প্ল্যান্ট যেখানে তারা জাপানের সুজুকি কোম্পানির মোটরসাইকেল প্রস্তুত করবে।

আশিকুল ইসলামের মতে, সম্প্রতি রাইড শেয়ারিং সার্ভিস চালু হওয়ার পর থেকে মোটরসাইকেলের চাহিদা বেড়ে গেছে। “এখন ক্রেতারা বাইক চালিয়ে আয়-রোজগার করার সুযোগ খুঁজতে চাচ্ছেন।”

রানার মোটরসাইকেলের চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান মনে করেন, এই রাইড শেয়ারিং সার্ভিসগুলো মোটরসাইকেলের বাজারে একটা বড় প্রভাব ফেলেছে। এখন রাইড শেয়ারিং সার্ভিসগুলোর ব্যাপক বিস্তারের সাথে সাথে সরকার এদের জন্য কেন্দ্রীয় নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। এতে আয়-রোজগারের সুযোগ থাকায়, যুবকেরা সুন্দর এবং স্বাচ্ছন্দ্যময় ইনকামের পথ বেছে নিয়েছেন।

তিনি মনে করেন, এই রাইড শেয়ারিং সার্ভিসগুলো গ্রাম থেকে কাজের খোঁজে শহরে আসা এক বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য সহজ আয়ের উৎস হবে।

এসিআই-এর সুব্রত রঞ্জন দাসও মনে করেন মোটরসাইকেলের সম্প্রসারিত বাজারের পেছনে এই রাইড শেয়ারিং সার্ভিসগুলোর বড় অবদান আছে। তিনি জানান, এর ফলে বিগত সময়ে ১১০ সিসি থেকে ১২৫ সিসির গাড়ি বিক্রি বেড়ে গেছে।

তবে, মোটরসাইকেলের শিল্প সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা হিসেবে তারা চিহ্নিত করেছেন ব্যাংক ও বেসরকারি ঋণের অভাবকে। তারা মনে করেন, ঋণ সুবিধা থাকলে এই শিল্পের আরো সম্প্রসারণ ঘটত।

বর্তমানে, কোন বেসরকারি ঋণদাতা মোটরসাইকেলের জন্য ঋণ সুবিধা দেয় না, জানান রানার অটোমোবাইলসের হাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, “পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেই চিত্রটা ভিন্ন। এ ঋণ সুবিধার কারণেই পাশের দেশগুলোতে মোটরসাইকেল ব্যবহারের সংখ্যা বেড়েছে। সরকারর উচিত, বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে মোটরসাইকেলের জন্য ঋণ প্রদান করতে উৎসাহিত করা।”

এসিআই-এর সুব্রত দাসও একই কথাই বললেন। তিনি বলেন, “মোটরগাড়ির মত মোটরসাইকেলের জন্যও ঋণ সুবিধা থাকা উচিত। পাশাপাশি, এ শিল্পকে আরো উৎসাহ যোগাতে সরকারের পক্ষ থেকে মোটরসাইকেল-বান্ধব নীতিমালা অব্যহত রাখা উচিত।”

গত বছর, বাংলাদেশ সরকার অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে দেশের ভেতরেই মোটরসাইকেল প্রস্তুত করার লক্ষ্যে এবং রফতানি সম্ভারকে আরো সম্প্রসারিত করতে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে। সেই নীতিমালায় ২০২১ সালের মধ্যে পাঁচ লাখ এবং ২০২৭ সাল নাগাদ এর দ্বিগুণ মোটরসাইকেল প্রস্তুত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়।

হাফিজুর রহমান মনে করেন, “এ নীতিমালার মাধ্যমে দেশের ভেতর শুধু কর্মসংস্থান বৃদ্ধিরই পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, সাথে সাথে সল্প খরচে মানসম্মত মোটরসাইকেলের বাজারও তৈরি করা হয়েছে।” তিনি জানান, গাজীপুর এবং ময়মনসিংহের ভালুকায় রানারের কারখানায় এখন তৈরি হচ্ছে মোটরসাইকেলের বডি ফ্রেম, ফুয়েল ট্যাংক, সুইং আর্ম, স্ট্যান্ড ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ।

রাষ্ট্রপতির পদকপ্রাপ্ত এই প্রতিষ্ঠান আরো উদ্যোক্তাদের মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশ তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করতে চায় জানিয়ে হাফিজুর বলেন, “রানার এখন দেশের বিভিন্ন উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে সিট, ড্রাইভ চেইন, টায়ার, ব্যাটারি এবং বিভিন্ন প্লাস্টিক অংশ সংগ্রহ করছে। এখন, রানার দেশের গণ্ডি পেরিয়ে মোটরসাইকেল রফতানি করছে ভুটানেও।”

র‌্যানকন মটরস-এর আশিকুল ইসলাম বলেন, “দেশে মোটরসাইকেল প্রস্তুত কারখানাগুলো গড়ে ওঠার সাথে বিভিন্ন সহযোগী কারখানা গড়ে উঠেছে যারা সম্পুরক পণ্য তৈরি করছে।”

এসিআই-এর সুব্রত দাস বলেন, “স্কুটারের ওপর আরোপিত শুল্ক পুননির্ধারনের সময় এসে গেছে। মোটরসাইকেল এবং স্কুটারের পৃথক শুল্ক কাঠামো থাকা জরুরি। স্কুটারের ওপর শুল্ক কমানো হলে নারীরা স্কুটার কিনতে আরো উৎসাহিত হবেন। এটি নারীর ক্ষমতায়নের পথে একটি পাথেয় হয়ে থাকবে।”

Click here to read the English version of this news

Comments

The Daily Star  | English

Family reunited after 18 years

Stranded in Malaysia, man finally comes back home

1h ago