বাংলাদেশের ‘উন্নয়ন গল্প’ ও আমার সিঙ্গাপুর দর্শন

ছবি: মো. মেহেদী হাসান/স্টার

গত ১৬ বছরে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের আমলে দেশের বিভিন্ন মন্ত্রী ও নীতিনির্ধারকরা প্রায়ই সিঙ্গাপুরের গল্প শোনাতেন। তারা বাংলাদেশের উন্নয়নের গল্প বলার সময় সিঙ্গাপুরের সঙ্গে তুলনা করতেন। অথচ সিঙ্গাপুর এশিয়ার অন্যতম ব্যবসায়িক কেন্দ্র।

কথা ও লেখার প্রসঙ্গে এখানে কয়েকটি উদাহরণ টানতে হচ্ছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দাবি করেছিলেন, ২০২৪ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ অর্থনীতিতে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াকে ছাড়িয়ে যাবে।

একজন বিজনেস সাংবাদিক হিসেবে সরকারি অনুষ্ঠানে গিয়ে এসব তুলনা অনেকবার শুনেছি। এত শুনেছ যে—একসময় তা একঘেয়ে লাগতে শুরু করে।

আ হ ম মুস্তফা কামাল এখন দেশে নেই, নেই তার আওয়ামী লীগ সরকার। গত বছরের আগস্টে আওয়ামী সরকারের পতন হয়। তারপর দায়িত্ব নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও সেই পুরনো সিঙ্গাপুরের তুলনা শোনা গেছে। সম্প্রতি এক আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলনে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেছেন, ২০৩৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি আঞ্চলিক উৎপাদন হাবে রূপ নেবে এবং 'সিঙ্গাপুরের মতো একটি দেশ' হয়ে উঠবে।

কিন্তু এ ধরনের তুলনা শুনতে ভালো লাগলেও বাস্তবতা ভিন্ন। কারণ একটু বিশ্লেষণ করলে এই তুলনাকে বাস্তবতা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন মনে হবে। তাই তুলনা হোক কিংবা আলোচনা বা সমালোচনা যাই হোক না কেন—সবকিছু প্রাসঙ্গিক হওয়া উচিৎ। এখানে কিছু তথ্য বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে।

২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী, সিঙ্গাপুরের মাথাপিছু জিডিপি প্রায় ৮৫ হাজার ডলার, যেখানে বাংলাদেশের মাত্র ২ হাজার ৭০০ ডলার। শুধু সংখ্যার দিক থেকেই নয়, বরং অর্থনৈতিক অবকাঠামো, শাসনব্যবস্থা, উদ্ভাবনী শক্তি, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার দিক থেকে সিঙ্গাপুর বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে।

লি কুয়ান ইউয়ের দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে দেশটি মানবসম্পদ উন্নয়ন, অবকাঠামোগত উৎকর্ষতা ও ব্যবসাবান্ধব শাসনব্যবস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছে।

এখানে বাংলাদেশের অবস্থা সিঙ্গাপুরের সম্পূর্ণ বিপরীত। বাংলাদেশ এখনো দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, যানজট ও বিনিয়োগবান্ধব নীতির অভাবে ভুগছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আমাদের অনিশ্চিত নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়া দেখে আতঙ্কিত হন। বিনিয়োগ করার আগেই তারা পিছিয়ে যান।

তবুও, এই ঘন ঘন তুলনার কারণে একসময় আমার সিঙ্গাপুরকে নিজ চোখে দেখার সাধ জাগে। যে দেশটিকে আমাদের নেতারা বারবার উন্নয়নের মডেল হিসেবে তুলে ধরেন—বোধ করি সেই দেশটিকে দেখার সাধ আরও অনেকের আছে।

তবে ২০২৫ সালের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সাংবাদিকতা ফেলোশিপে নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে আমার সেই স্বপ্ন সত্যি হলো। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল প্রেস ফাউন্ডেশন ও সিঙ্গাপুরের হিনরিচ ফাউন্ডেশনের যৌথ আয়োজনে জুনের শেষ সপ্তাহে সিঙ্গাপুরে এক সপ্তাহ কাটিয়েছি। সেই অভিজ্ঞতা আমাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে, কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি করেছে।

আমার যাত্রা শুরু হয় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে। লাগেজে ল্যাপটপ থাকায় স্ক্যানের পর থামানো হলো। তারপর ব্যাগ খুলতে বলা হয়। তবে আমি না খুলতে অনুরোধ করি, কারণ ব্যাগটি খুব আঁটসাঁটভাবে ছিল। অবশ্য তারা জোর করে খুলতে বাধ্য করে।

ব্যাগে কিছু না পেয়ে ছেড়ে দিলেন। তবে আমি কিছুটা অপমানিত বোধ করি। পরে ইমিগ্রেশনে আবার বাধা—কারণ আমি একজন সাংবাদিক। 'উচ্চ কর্তৃপক্ষের অনুমতি' লাগবে জানিয়ে আটকানো হলো। সেখান থেকে পরে ছাড়া হলো। তবে ওই মুহূর্তে যে মানসিক চাপ ও বিড়ম্বনার ভেতর দিয়ে গেছি, তা বলার নয়।

সিঙ্গাপুরে যাওয়ার পর এই অভিজ্ঞতা আমাকে অনেকবার ভাবিয়েছে। এত বিশৃঙ্খল একটি ব্যবস্থাপনা নিয়ে কীভাবে আমরা 'পরবর্তী সিঙ্গাপুর' হওয়ার স্বপ্ন দেখি?

কারণ মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টার ফ্লাইটের পর যখন সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম, তখন মনে হলো—সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পৃথিবীতে পা রাখলাম।

প্রথম অভিব্যক্তি—অভিভূত! মাত্র তিন মিনিটে ইমিগ্রেশন পার হলা। যেখানে কোনা মানুষের হস্তক্ষেপ ছিল না, পুরো প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয়। আমরা তিন ঘণ্টা এয়ারপোর্ট ঘুরেই কাটিয়ে দিই। সেখানকার সৌন্দর্য ও পরিচালনা কৌশল যে কাউকে অভিভূত করবে।

ওই সময়টা বাংলাদেশের বিমানবন্দরের কথা মনে পড়ে বারবার খারাপ লাগছিল। ভাবছিলাম—এই অবস্থা দেখে কোনো বিনিয়োগকারী এখানে আসতে আগ্রহী হবেন?

সিঙ্গাপুরে রাস্তা প্রশস্ত, ট্রাফিক নিয়মিত ও সুসজ্জিত। পথচারীদের জন্য নির্দিষ্ট জেব্রা ক্রসিং। গাড়ি ট্রাফিক সিগন্যাল মেনে চলে—পুলিশ ছাড়াই। কোনো ট্রাফিক পুলিশ চোখে পড়েনি। কারণ পুরো ব্যবস্থাই অটোমেশন-নির্ভর। সর্বত্র পরিচ্ছন্ন, কেউ রাস্তায় ময়লা ফেলে না। ধূমপানের জন্য নির্দিষ্ট জোন। অবৈধ বাহনের চলাচল নেই—ব্যাটারিচালিত রিকশার জট নেই।

সবচেয়ে বিস্মিত হয়েছি ডিজিটাল সংযোগ দেখে। আলাদা সিম কার্ড কিনতে হয়নি—পাবলিক ওয়াইফাই সব জায়গায়। হোয়াটসঅ্যাপেই পুরো সময় যোগাযোগ চালিয়ে নিতে পেরেছি।

আরেকটি বড় বিষয় ছিল নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা। সর্বত্র নজরদারি, কঠোর আইন প্রয়োগ—যার ফলে সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় থাকে। সবাই দেশের প্রচলিত আইন মেনে চলে।

এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ব্যবসা ও অর্থনীতি নিয়ে রিপোর্ট করার অভিজ্ঞতায় অনেক কিছু দেখেছি। কীভাবে বাংলাদেশের প্রশাসনিক জটিলতা, দুর্নীতি ও অকার্যকর ব্যবস্থা উদ্যোক্তাদের দমন করে তা দেখেছি। কষ্ট হলেও বলতেই হচ্ছে—আমরা যদি এভাবে চলতে থাকি, তবে ২০৩৫ সাল নয়—২০৯০ সালেও হয়তো সিঙ্গাপুরের ধারেকাছে পৌঁছাতে পারব না।

আমাদের নীতিনির্ধারকদের এখন মাটিতে নামতে হবে ও বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। শুধু আশাবাদ দিয়ে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি হয় না। প্রয়োজন কাঠামোগত সংস্কার।

দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের উন্নয়ন-আলোচনাগুলোকে পেছনে টেনে ধরে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, আইন প্রয়োগে ব্যর্থতা ও নীতির স্থায়িত্বের অভাব। এখানে অনেক তথাকথিত ব্যবসায়ী শ্রেণি দেশীয় বিনিয়োগে আগ্রহী নয়, বরং টাকা পাচারে বেশি মনোযোগী। কাগজে-কলমে নিয়ম-কানুন থাকলেও, তেমন প্রয়োগ এখানে দেখা যায় না।

এখন সময় এসেছে বাস্তবতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার। কেবল বক্তৃতা, আলোচনা, সেমিনারে সিঙ্গাপুরের নাম না নিয়ে, তাদের থেকে শিক্ষা নিতে হবে। তারপর সেগুলো প্রয়োগ করতে হবে। না হলে এই তুলনা কেবল জনগণের মধ্যে হতাশা বাড়াবে, কাঙ্ক্ষিত সংস্কারকে আরও দূরে সরিয়ে দেবে।

Comments