গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত: ঢেউ আর সবুজের মেলবন্ধন

গুলিয়াখালী
ছবি: ইন্তিসাব শাহরিয়ার

সকাল ৭টায় হোটেলের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বুঝলাম, আজকের দিনটি আমাদের পক্ষে সহজ হবে না। সেদিন আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল, চট্টগ্রামের আকাশে ভারী মেঘদের সভা হচ্ছে, যেকোনো মুহূর্তেই ঝরে পড়ার প্রস্তুতি চলছে।

কিন্তু আমাদের তো প্ল্যান ক্যানসেল করার উপায় নেই- ক্যামেরা ফুল চার্জ নিয়ে রেডি, গাড়ি বুকিং দেওয়া হয়ে গেছে। অগত্যা আমরা বেরিয়ে পড়লাম গুলিয়াখালী সী-বিচ খুঁজে বের করার মিশনে—ইন্তি ভাইয়া একদম ছুটির মুডে, আমি কাজে, আর সঙ্গে আমাদের চিত্রগ্রাহক তানজিল (হ্যাঁ, দুইজন তানজিল, মানে ডাবল ঝামেলা!)।

চট্টগ্রাম
ছবি: কে তানজিল জামান

শহর ছাড়িয়ে হালকা বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি চালানো অদ্ভুত সুন্দর একটা ব্যাপার। বৃষ্টিভেজা চট্টগ্রাম এক নীরব সঙ্গীর মতো লাগে। শহরের সীমানা পেরোতেই সবকিছু আরও শান্ত হয়ে এলো। রাস্তা সরু হয়ে গেল, মাঝে মাঝে চোখে পড়ল জংধরা চায়ের দোকান, নির্জন গ্রাম আর অনেক গরু। এতটাই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল চারপাশ, আমরা কিছুক্ষণের জন্য ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমরা আসলে কাজে এসেছি।

অবশেষে আমরা মুরাদপুরে পৌঁছালাম। এক সময় জানলাম মোটরচালিত যান সামনে আর যাবে না। তখন এক স্থানীয় ব্যক্তি জানালেন যে বাকি পথটা খালি পায়ে হেঁটে যেতে হবে আমাদের।

বৃষ্টির কারণে সমুদ্রসৈকতের আগ পর্যন্ত রাস্তা যেন কাদামাটির তৈরি একটা রানওয়েতে পরিণত হয়েছে। প্রথমে একটু আপত্তি করছিলাম ঠিকই, কিন্তু পরে হাল ছেড়ে দিলাম, মনে হচ্ছিল বিনা পয়সার একটা মাটির স্পা যেন! পা হড়কে পড়ে, পিছলে, গজগজ করতে করতে আমরা পার হয়ে এলাম।

আর তারপর আমাদের সামনে আসল দৃশ্য উপস্থিত হলো। আর দশটা সমুদ্র সৈকতের মতো উত্তাল ঢেউ আর চিরচেনা চিত্র নেই  এখানে। এখানে আসলে মনে হবে যে কেউ এই সমুদ্র সৈকত আর ম্যানগ্রোভ বনকে একসঙ্গে মিশিয়ে এক অদ্ভুত সুন্দর জায়গা তৈরি করেছে, যার গায়ে ছড়িয়ে আছে সবুজ ঘাসের নরম চাদর। চারপাশজুড়ে খোলা ঘাসের মাঠ, তার ফাঁকে ফাঁকে চকচকে জলরেখা যেন সবুজের মাঝে রুপার শিরা টেনে দিয়েছে, আর কোথাও কোথাও উঁচু হয়ে থাকা ম্যানগ্রোভ গাছের শিকড়গুলোকে প্রাকৃতিক ভাস্কর্য মনে হচ্ছিল। গুলিয়াখালীর এই অপরূপ সৌন্দর্যে ধীরে ধীরে সেখানে মিশে যাবে যে কেউ।

সমুদ্র সৈকত
ছবি: সাবরিউল ইসলাম তানজিল

আমরা একটু আগে পৌঁছেছিলাম (বা বলা ভালো, সূর্য তার তেজ দেখানোর আগে), ফলে পুরো জায়গাটা তখন কেবল আমাদের দখলে ছিল। কাদায় ডোবানো পায়ের শব্দ, দূরে পাখির ডাক, আর ইন্তি ভাইয়ের আমাদের নিয়ে বাজে রসিকতা করা ছাড়া আর কোনো শব্দ ছিল না। একটা জায়গা যে সত্যিই বিশেষ, তা বোঝা যায় যখন যে মানুষটা শুধু বেড়াতে এসেছে, সে-ও হঠাৎ করে ভালো শটের আইডিয়া ছুড়ে দিতে শুরু করে।

আমরা এক ঘণ্টার মতো সময় শুধু চারপাশটা উপভোগ করেই কাটিয়ে দিলাম। কোনো হইহুল্লোড় নেই, কোনো ভিড় নেই। গুলিয়াখালী এখনো বাণিজ্যিক বিশৃঙ্খলার হাত থেকে মুক্ত। নেই কোনো বিচ রাইড, নেই নৌকা, এমনকি নেই লবণ-মরিচ মাখানো শসা বিক্রি করা কোনো শিশু। আর হয়তো এটাই এই জায়গাটার বিশেষত্ব। এখানে কেউ আপনাকে বিনোদন দেওয়ার জন্য বসে নেই। আপনি এখানে এসেছেন দেখতে এবং জায়গাটি উপভোগ করতে। এখানে আপনি  নীরবতার শব্দ উপলব্ধি করতে পারবেন, কেওড়া গাছের শিকড় কীভাবে শান্ত জোয়ারের খালে ছড়িয়ে পড়ে, কিংবা দিগন্ত কীভাবে একসঙ্গে সবুজ আর ধূসর হয়ে অনন্তে মিশে যায় দেখতে পাবেন।

এই জায়গাটা আপনাকে ধীরে চলতে শেখাবে। তানজিল ব্যস্ত ছিল শট সেট করতে, আর আমি কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই হাঁটছিলাম, মাঝেমধ্যে অচেনা পাখিদের ছবি তুলছিলাম। জোয়ার আসার অপেক্ষায় থাকতেই কয়েকজন মাঝি দূর থেকে হাত নেড়ে অভিবাদন জানালেন। গুলিয়াখালীর নিজস্ব একটা ছন্দ আছে, যেটা আপনার সময়সূচির সঙ্গে মিলবে না। কোনো তাড়াহুড়ো, জোরজবরদস্তি কিছুই নেই এখানে। সব কিছু শান্ত, ধীর আর নিজস্ব গটিতে বয়ে চলে।

যদি আপনি এখানে ভ্রমণের পরিকল্পনা করে থাকেন (এবং আমার পরামর্শ থাকবে, বাকিরা আবিষ্কার করার আগেই ঘুরে আসুন), তাহলে পথটা বেশ সহজ: প্রথমে চলে যান সীতাকুণ্ড বাজার, সেখান থেকে মুরাদপুর পর্যন্ত সিএনজিতে। শেষ অংশটুকু হাঁটতে হবে, তাই এমন পোশাক পরুন যা পরে সহজে চলাচল করতে পারবেন।

যদি খুব সকালে রওনা দেন তাহলে চট্টগ্রাম থেকে পুরো যাত্রায় অর্ধেক দিন লাগবে। তবে একটি বিষয় সাবধান করে দিচ্ছি- এটি তেমন পিকনিক-বান্ধব জায়গা নয়, যদি না আপনি নিজের সব কিছু নিজে নিয়ে যান। কোনো ডাস্টবিন নেই, তাই যা নিয়ে যাবেন, ফেরার সময় সঙ্গে করে আনবেন। সহজ নিয়ম: যা আপনার নয়, তা নষ্ট করবেন না।

এখানে সাঁতার কাটার মতো পরিবেশ নেই। কোনো লাইফগার্ড নেই, আর জায়গাটা খুবই অনিশ্চিত। চাইলে পা ভিজিয়ে নিতে পারেন, অথবা আশপাশে মাঝি থাকলে ছোট নৌকায় উঠতে পারেন। কিন্তু এই জায়গার আসল সৌন্দর্যই হলো মাটির কাছাকাছি থাকা। ঘাসে গা লেগে থাকুক, কাদা পায়ে মেখে থাকুক, আর বাতাস আপনার চুলগুলো এলোমেলো করে দিক - সেটাই তো এখানকার আসল আনন্দ।

গাড়িতে ফেরার পথে আমরা চুপচাপ বসে ছিলাম, গুটানো প্যান্ট, পায়ে কাদা, কিন্তু মনটা ছিল অদ্ভুত শান্ত। ইন্তি ভাইয়া, যিনি সুযোগ পেলেই ঠাট্টা করছিলেন, তিনিও এখন পুরোপুরি আমাদের ঘোরে হারিয়ে গেছেন। এর মধ্যেই দ্বিতীয়বার আসার পরিকল্পনা শুরু করে দিয়েছেন। হয়তো পরেরবার আমরা ক্যামেরা ছাড়াই আসব। শুধু বসে থাকব। আর হয়তো ঘাসের সঙ্গে জোয়ারের সেই দুষ্টুমি আবারও দেখব।

অনুবাদ করেছেন সৈয়দা সুবাহ আলম

 

Comments