সুস্বাদু খাবারের খোঁজে চট্টগ্রামে

চট্টগ্রামের খাবার
ছবি: ইন্তিসাব শাহরিয়ার

খাওয়াদাওয়া নিয়ে আমার মনে এক ধরনের খুঁতখুঁতে ব্যাপার আছে। আপনারা হয়তো ভাববেন, এর সঙ্গে ঘোরাঘুরির কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু আজ আমি আপনাদের বলব অন্য কথা।

একজন মানুষ যে আদতে মাংসাশী; যে কি না শাকসবজিকে মনে করে খাবারের অনুষঙ্গ আর মাছকে মনে করে অ্যাকুরিয়ামে রাখার জিনিস। তার সঙ্গে ভ্রমণের জায়গা খুঁজে বের করা বিশেষ করে আমার পছন্দের জায়গা সমুদ্রতীরে যাওয়া বেশ ক্লান্তিকর। এমন ভ্রমণসঙ্গীদের সঙ্গে যদি কোথাও যাই যারা যখন যা পায় তাই খেয়ে নেন, তাহলে সেখানে নিজের পছন্দের কথা প্রকাশ করলে উল্টো নিষ্ঠুর রসিকতারই শিকার হতে হয়।

চট্টগ্রামের খাবার
ছবি: সাজ্জাদ ইবনে সাঈদ

তাই একবারের জন্য হলেও আমি এমন জায়গায় যেতে চেয়েছিলাম যেখানে আমার পছন্দের খাবারের স্বাদ নেওয়া যায়। আর সেই জায়গাটি হলো কালা ভুনা আর মেজবানি মাংসের শহর চট্টগ্রাম। কেবল ছুটি কাটানোর জন্য চট্টগ্রাম কখনোই আমার মনে আসে না, সেই জায়গাটি কক্সবাজারের জন্য সংরক্ষিত। কিন্তু চট্টগ্রামে যাওয়ার অন্য কারণ ছিল। তাই আমি সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং ভাবলাম একবারের জন্য হলেও ভ্রমণসঙ্গী বন্ধুদের সঙ্গে শান্তিতে সময় কাটাব।

২০০০ সালের পর আর চট্টগ্রামে যাওয়া হয়নি আমার। তাই সেখানে পৌঁছানোর পর সবকিছু অন্যরকম লাগছিল। সেসময় বৃষ্টিও হচ্ছিল, তাই ভ্রমণকারী টিয়াপাখি ডোরার মতো বের হয়ে সকালের নাশতার জন্য সেরা জায়গা খুঁজে বের করতে ইচ্ছা করছিল না। তার বদলে আমরা হোটেলে চেকইন করাই ঠিক বলে মনে করলাম।

চেকইন করার পরপরই আমি হাঁটতে বেরিয়ে পড়লাম। অদ্ভুত বিষয় হলো, আশপাশে যত রেস্তোরাঁ আর খাবারের দোকান দেখছিলাম তার সবগুলোই ঢাকায় দেখেছি। অর্থাৎ একেবারে খাঁটি চট্টগ্রামের কিছু দেখছিলাম না। আবার এটাও ঠিক যে, চট্টগ্রামের মানুষ শনিবার সকাল ৯টায় উঠে অন্তত নাশতা খেতে বের হয় না।

কী আর করা! অনেকটা হতাশ হয়েই আমি হোটেলে ফিরে এলাম এবং সেখানকার বুফে ব্রেকফাস্ট খেতে গেলাম। মনে মনে হতাশ হবে এটা ভেবেই সেখানে ঢুকলাম এবং দেখলাম ৯টিরও কম খাবার পরিবেশন করা হয়েছে। সেখান থেকে বেছে নিলাম পরোটা আর মশলাদার আলুর দম। যেই না প্রথম কামড় মুখে দিলাম, মনে হলো স্বর্গে পৌঁছে গেছি।

তাড়াতাড়ি বুফে টেবিলে ফিরে গেলাম এবং খিচুড়ি, গরুর মাংস, সসেজ নিয়ে ডিমভাজার অর্ডার দিয়ে এলাম। আমি জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে বুফে ব্রেকফাস্ট করেছি। তবে হলফ করে বলতে পারি, এটা আমার খাওয়া সেরা ১০ এর তালিকায় থাকবে।

আমি চট্টগ্রামে বেড়াতে গেলেও আমার ভ্রমণসঙ্গীরা গিয়েছিলেন কাজে। তাদের কাজের মধ্যে ছিল চট্টগ্রামের খাবার নিয়ে আলোচনাও। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম খাবারের জায়গাগুলোয় তাদের সঙ্গে যাওয়ার। তারা তাদের কাজে আমার সাহায্য নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু আমি বারবারই বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম যে, আমি বেড়াতে এসেছি। এখন কোনো কাজ নয়।

বিকেলের দিকে আমরা গেলাম পুরোনোর বিলাসী রেস্তোরাঁ মেরিডিয়ানে। দুঃখের বিষয় হলো, সেখানকাম কর্মীরা ভুলেই গিয়েছিলেন যে গ্রাহক কী অর্ডার করেছেন। তাদের কাছে অর্ডারের চেয়ে রান্নাঘরে আড্ডা দেওয়াই বেশি আনন্দদায়ক বলে মনে হয়েছে। ফলে সেখান খাবার না খেয়েই আমাদের বেরিয়ে আসতে হয়। যদিও অনেকের কাছে প্রশংসা শুনেই সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

বিকেলের আলো তখন নিভে আসছে, আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আরেকটু দেরিতেই খাবে এবং সরাসরি চলে যাবে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে। যেহেতু সমুদ্র আমার পছন্দ তাই মেরিডিয়ানে খেতে না পারার কষ্ট সহজেই ভুলে গেলাম। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর পর আরেক দফা হতাশ হলাম। এক সময়ের বিস্তৃত সমুদ্র সৈকতকে দেখলাম অনেক উন্নত করতে গিয়ে আটকে ফেলা হয়েছে। অনেকটা গ্রামের পুকুরপাড়ের সিঁড়ির মতো বানানো হয়েছে সৈকতে নামার পথকে।

এই হতাশা কাটাতে এগিয়ে এলেন একজন ব্যস্ত ঝালমুড়ি বিক্রেতা। যিনি বিক্রি করছিলেন বোম্বাই মরিচ আর চানাচুর মেশানো মজার ঝালমুড়ি। এরপর খেলাম চোখে পানি আসা নাগা ফুচকা। যদি কখনও পতেঙ্গায় যান, এটি অবশ্যই খেয়ে দেখবেন। সমুদ্রের পাড়ে বাতাসের মধ্যে বসে চানাচুর খাওয়ার মজাই আলাদা।

সমুদ্রদর্শন শেষে ফিরে গেলাম জিইসির মোড়, কারণ আমি কালা ভুনা খেতে চেয়েছিলাম। জামান রেস্টুরেন্টে খাওয়ার পরামর্শ পেয়েছিলাম, তো আমরা সেখানেই গেলাম। আমার ভ্রমণসঙ্গীরা সেখানে মাছসহ অন্যান্য খাবার অর্ডার করছিলেন। আর আমি অর্ডার করলাম কালা ভুনা, ডাল, ভাত আর আলুভর্তা। সত্যি বলতে কী, এর চেয়ে ভালো স্বাদের কালা ভুনা আমি ঢাকাতেই খেয়েছি। ফলে সকালের নাশতাটুকু বাদ দিলে প্রথম দিনটি খাবার হিসেবে বেশ খারাপই গেল বলা চলে।

দ্বিতীয় দিনটি শুরু হলো বিতর্কের মধ্য দিয়ে। আমি হোটেলেরই বুফে নাশতা খেতে চাইলাম। কিন্তু আমার সঙ্গীরা স্থানীয় ড্রাইভারের পরামর্শ অনুযায়ী পরবর্তী গন্তব্য বাড়বকুণ্ড সৈকতে যাওয়ার পথের রয়েল ফুডসে নাশতা করতে চাইলেন। যেহেতু দলটির সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি আমি, তাই বাকিদের সঙ্গে বেশি কথা না বাড়িয়ে সেটাই মেনে নিলাম। কিন্তু দেখা গেল, রোববার সকাল ৮টায় রয়েল ফুডস খোলে না। তাই বাধ্য হয়ে পথের ধারের একেবারে সাধারণ রেস্তোরাঁয় আমাদের নাশতা করতে হলো। সেই সময় মনে হচ্ছিল, আমার প্রায় জেন-জি সহকর্মীদের কাছে বুঝি আমি একজন তান্ত্রিক হিসেবে ধরা দিয়েছি যার ইচ্ছার অমান্য করায় পথের ধারে বসে নাশতা করতে হচ্ছে!

যাই হোক, নাশতা শেষ করে আমরা বাড়বকুণ্ড সমুদ্র সৈকতের দিকে রওনা দিলাম। পছন্দমতো নাশতা না পাওয়া দিয়ে শুরু হওয়া দিনটা ছিল আমাদের জন্য বেশ স্মরণীয়। কিছুক্ষণ পর দুপুরের খাবার খেতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং আবারও ড্রাইভারের পরামর্শ শুনে আমার তরুণ সহকর্মীরা উত্তেজিত হয়ে উঠলেন!

এবারের রেস্তোরাঁর অবস্থান সীতাকুণ্ড মহাসড়কের ঠিক পাশেই, যেটি স্থানীয়দের কাছে ভাবির হোটেল নামে পরিচিত। দোকানটি বেশ লোকজনে পরিপূর্ণ ছিল। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর আমরা একটি টেবিলে বসতে সক্ষম হলাম। সেখানে ছিল ভাত, ডাল, চুইঝাল দিয়ে গরুর মাংস, টমেটো ভর্তা আর আলু ভর্তা। খেলে এগুলোই খেতে হবে, নাহলে বেরিয়ে যেতে হবে।

চট্টগ্রামে বসে মেজবানি মাংস বা কালা ভুনার বদলে চুইঝাল দিয়ে রান্না করা মাংস খেতে হবে ভেবে আমি একটু দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম। তারপরও যা পরিবেশন করা হয়েছিল, চুপচাপ খেয়ে নিলাম। চুইঝাল দিয়ে গরুর মাংসের স্বাদ ঠিকঠাক ছিল, টমেটো ভর্তাটা ছিল সুস্বাদু। তবে আলু ভর্তাটা ছিল অসাধারণ। সত্যি বলতে কী, এই ভ্রমণের দুই মাস পেরিয়েছে। কিন্তু আমি এখনও এটার স্বাদ ভুলতে পারিনি। আমি তো সেদিন বড় এক বাক্স আলু ভর্তা প্যাকেট করে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সবাই মানা করল। কারণ হোটেল পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতে এটি নষ্ট হয়ে যাবে।

তৃতীয় দিন কোনও তর্ক-বিতর্ক ছাড়াই হোটেলের বুফে নাশতার মাধ্যমে শুরু হলো। বাকি দিনটাও সাধারণ ছিল, বিশেষ করে খাবারের দিক থেকে। আমি ফ্লেভার্স নামে একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকেছিলাম। লোগো দেখে ভেবেছিলাম ওটা বুঝি ঢাকার অতি পরিচিত প্রিমিয়ার সুইটস। আদতে সেটি ছিল ফ্লেভার্স।

সেখানে প্লাস্টিকের কন্টেইনারে বিক্রি হওয়া বিস্কিট থেকে শুরু করে মিষ্টি এবং চিপসসহ অন্যান্য ভাজা আইটেম, সবগুলোর স্বাদই ছিল অসাধারণ। ফ্লেভার্সের চিপসের স্বাদ দারুণ। সঠিক পরিমাণে লবণ আর মশলা দেওয়া, দারুন মুচমুচে। আমি ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আট বাক্স চিপসসহ অন্যান্য আইটেম কিনে নিলাম।

এরপর গেলাম এক পুরোনো বন্ধুর কাছে, আর সেই বন্ধুটির নাম গণি বেকারি। সেখান থেকে কিনলাম দুই কেজি দুধের টফি এবং দুই কেজি বিস্কুট। বিস্কুটগুলো দারুণ ছিল। টফির স্বাদ ছিল আসাধারণ। এতটাই মজার ছিল যে আমার গণি বেকারির আশপাশের বাসিন্দাদের ওপর হিংসা হচ্ছিল।

আমি হিসাব করে দেখলাম এরই মধ্যে প্রায় পাঁচ কেজি খাবার কিনে ফেলেছি। তাই নতুন ব্যাগ কেনার জন্য চট্টগ্রাম নিউ মার্কেটে যেতে হলো। সেখানে স্বাদ নিতে গেলাম বিখ্যাত নিউ লিবার্টি ড্রিংক হাউজের ফালুদার। সেটি ছিল দুর্দান্ত। অবশ্য ফালুদার চেয়ে আমার কাছে আকর্ষণীয় ছিল সেখানকার ভেতরের পরিবেশ এবং কর্মীদের পোশাক। আপনি যদি কখনো আর্চিসের মতো পুরোনো কমিকসগুলো পড়ে থাকেন তাহলে এই ধরনের পোশাক সম্পর্কে জানবেন।

দিনশেষে গেলাম ডিএফসি বা ডরোথিস ফ্রায়েড চিকেনে। এটি দীর্ঘদিন ধরে একজন কোরিয়ান নারী চালিয়েছেন এবং এখনও তার রেসিপি অনুযায়ীই সেখানে মশলাদার কোরিয়ান ফ্রায়েড চিকেন তৈরি করা হয়।

আমরা বেশকিছু খাবার অর্ডার করলাম। সত্যি করে বললে, ঢাকায়ও এ ধরনের চিকেন ফ্রাই পাওয়া যায়। তবে এই স্থানের বয়স বিবেচনা করলে একে অগ্রগামীদের তালিকায় ফেলতেই হবে।

এর মধ্য দিয়েই আমার ভ্রমণ শেষ হলো। আমার সহকর্মীরা যদিও কাজ শেষে একদিন আগেই ঢাকায় ফিরে আসেন। ফলে তারা চলে যাওয়ার পর আমি ভাবনাচিন্তার জন্যও আলাদা সময় পেয়েছিলাম। আমি এসেছিলাম চট্টগ্রামের খাঁটি স্বাদের কালা ভুনা খেতে। হোটেলের রুমে বসেই অর্ডার করে খেয়েছিলাম সেটি। সেইসঙ্গে মেজবানি মাংসও খেয়েছিলাম। দিনশেষে দেখা গেল, মাংস খেতে এসে আমি পাঁচ কেজি বিস্কুট আর ভাজা চিপসজাতীয় খাবার সঙ্গে বয়ে নিয়ে যাচ্ছি এবং ভাবির হোটেলের আলুভর্তা মিস করছি! কী আর করা!

অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ

 

Comments

The Daily Star  | English

Jamaat rally commences at Suhrawardy Udyan

Supporters continued to arrive at the venue in processions, chanting slogans and carrying banners in support of the demands

38m ago