পর্যালোচনা

আমের আদ্যোপান্ত

অনেকেই পড়েন ও লেখেন, কিন্তু কেউ কেউ দায়িত্ব নেন। তাদের আমরা যথাক্রমে বলি দায়বদ্ধ পাঠক ও লেখক। উভয়েই মূলত সত্যসন্ধানী। দায়বদ্ধ পাঠক হয়তো নিজের জ্ঞানতৃষ্ণা মেটাতেই পড়েন, কিন্তু তাদের কাজ হয়ে ওঠে নিজে সঠিক বিষয়টি জানা ও অন্যদের জানানো।

শিক্ষকতা বা অধ্যাপনায় এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে দায়বদ্ধ পাঠক যত বাড়বে, ততই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে বিচিত্র সব অন্ধকার দূর হবে। দায়বদ্ধ লেখক নিজে এমন দায় বোধ করেন, যা তার জীবনযাপনের অংশ হয়ে ওঠে—হতে পারে তা সাহিত্য রচনায় বা গদ্য লেখায়।

জাতি সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে তার কাজ গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য নিয়ে সময়ের ক্ষয় পেরিয়ে থেকে যায়। অক্ষরের মাধ্যমে অক্ষয় হয়ে ওঠেন তারা। সাহিত্যিক, গদ্যলেখক ও গবেষকদের অনেকে এ পথে পা রাখেন ও দীপ্ত প্রত্যয়ে এগিয়ে চলেন।

মাহবুব সিদ্দিকী তেমনই একজন দায়বদ্ধ লেখক ও গবেষক। তার জন্ম ১৯৫১ সালে। ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। উনসত্তরের ১১ দফা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। ইনডোর গেমসে লন টেনিস ও টেবিল টেনিসে পারদর্শী মানুষটি আউটডোরে ছিলেন ঝানু ক্রিকেটার, কলেজে থাকতে একাদশকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। রাজশাহী কলেজ থেকে বিএ পাশ করে যোগ দেন পুলিশে। সেখানে ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন।

লিখতে শুরু করেন চাকরি জীবনের শেষ দিক থেকে। লেখার বিষয়—পরিবেশ, প্রকৃতি এবং এর ইতিহাস ও বর্তমানের দশা-দুর্দশা। বইগুলোর নাম থেকেই তার লেখার পরিধি ও পরিসর বোঝা যায়—আম, গঙ্গা পদ্মা পদ্মাবতী, ফিরিয়ে দাও সেই প্রবাহ, রাজশাহীতে পর্যটন সম্ভাবনা, বড়াল নদের ইতিকথা, নারদ নদ, শহর রাজশাহীর আদিপর্ব, কোন আমটি কখন খাবেন, বাংলাদেশের বিলুপ্ত দীঘি পুষ্করিণী জলাশয়, হারিয়ে যাওয়া সোনার ধান, ব্রহ্মপুত্র নদ। শেষোক্ত দুটি বই আকারে-প্রকারে বিস্তারে বিশাল ব্যাপ্তিসম্পন্ন।

সত্যিকার অর্থে তার একেকটি বই কতটা বিস্ময়কর ও মূল্যবান, তা তার নিবিড় পাঠকমাত্রই জানেন। নদী নিয়ে তার কাজগুলো রীতিমতো আইকনিক হয়ে উঠেছে এবং তৈরি হয়েছে নিজস্ব পাঠকশ্রেণি। তদুপরি তার বইগুলো বৃহত্তর পাঠকের কাছে যতটা পৌঁছানোর কথা, ততটা কি পৌঁছেছে? 

বিশেষ করে 'আম' (২০১১) নিয়ে তার বইটি (এ নিয়ে দুটো বই তিনি লিখেছেন) ২০১২ সালে কলকাতার 'বইয়ের দেশ'র জুলাই- সেপ্টেম্বর ৮ম বর্ষ ৩য় সংখ্যার আলোচনার বলা হয়, 'মাহবুব সিদ্দিকীর বইটি না পড়লে এই উপমহাদেশের ভূগোল আম্রকাননগুলোর বিশিষ্ট ইতিহাসের দিকে নজর ফিরত না। ঐতিহাসিক স্থাপত্য-ভাস্কর্য যেমন এক এক অঞ্চলের ভূগোলকে বিশিষ্ট করে রেখেছে, তেমনই ভূমিকা যে এখানকার আমবাগানগুলো, তা আমরা কবে মনে রেখেছি?' বইটি প্রকাশের পর বাংলাদেশে মাত্র একটি দৈনিকে বিস্তারিত আলোচনা প্রকাশিত হয়েছিল। এরপরও আম বইটি নিয়ে বারবার আলোচনা হতেই পারে। হতে পারে সব বই নিয়েই। কারণ, তিনি বিস্মৃতির অন্ধকার থেকে তুলে এনেছেন একটির পর একটি বিষয়।

আম নিয়ে ব্যবসার নামে অনেক অসৎ ব্যবসায়ী ভোক্তাকে ঠকিয়ে বিপুল মুনাফা করছেন। এ সময়ে আমরা মাহবুব সিদ্দিকীর 'আম' (২০১৩ পরিবর্ধিত ২য় সংস্করণ) ও 'কোন আমটি কখন খাবেন' (২০১৭) বই দুটি দারুণভাবে কাজে লাগাতে পারি।

সত্যিকার অর্থে তার একেকটি বই কতটা বিস্ময়কর ও মূল্যবান, তা তার নিবিড় পাঠকমাত্রই জানেন। নদী নিয়ে তার কাজগুলো রীতিমতো আইকনিক হয়ে উঠেছে এবং তৈরি হয়েছে নিজস্ব পাঠকশ্রেণি। তদুপরি তার বইগুলো বৃহত্তর পাঠকের কাছে যতটা পৌঁছানোর কথা, ততটা কি পৌঁছেছে? 

'আম' বইটি থেকে কত কিছু যে জানা যায়, তার ইয়ত্তা নেই। আমরা জানি, রামায়ণ ও মহাভারতে আম্রকাননের কথা এসেছে। বৃহদারণ্যক উপনিষদে 'আম্র'র উল্লেখ আছে। সংস্কৃতে একে রসাল ও সহকার বলা হয়েছে। বৌদ্ধধর্মে আছে, আমগাছ ও আম পবিত্র গাছ ও ফল। পলাশীর প্রান্তরের পরাজয়ের ইতিহাসের সঙ্গেও আমবাগানের যোগ। আমের কত পদ, কত উপযোগিতা, বলে শেষ করা যাবে না।

আম বাংলা অঞ্চলের কেবল ফলই নয়, মাহবুব সিদ্দিকীর ভাষায় এ 'এমন একটি ফল যার সাথে জড়িয়ে রয়েছে রাজনীতি, গল্প, কাব্য, সঙ্গীতসহ নানা ধরনের সাংস্কৃতিক ক্রীয়াকা।' আম নিয়ে তার দুটি বইকে সমন্বিতভাবে 'আম্রসংহিতা'ই বলতে পারি।

প্রথম বই 'আম' আমের ইতিহাস, ঐতিহ্য, চাষপদ্ধতি ও বিচিত্র আমের নাম, পরিচিত ও বৈশিষ্ট্যের খোঁজ দিয়েছে। দ্বিতীয় বইটি দিয়েছে আম নামের এই 'ফলের রাজা' কীভাবে সাধারণ ভোক্তারা পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে কাজে লাগাবেন, সেই উপায়।

বলা হয়, মৌসুমে সঠিকমাত্রায় আম খেলে শরীরে এমন কিছু পুষ্টিগুণ তৈরি হয়, যা বলতে গেলে সারাবছর জুড়ে শরীরে কাজ করতে পারে। এই বইয়ের পরিবর্ধিত সংস্করণে যুক্ত 'আমের ভেষজ গুণাগুণ' অধ্যায়টি কত রোগের কতভাবে আম কাজে আসতে পারে, সেটি হাজির করেছে।

'আম' পড়তে পড়তে একদিকে যেমন এর সম্পর্কে অজ্ঞতা আবিষ্কার করি, তেমনই চমৎকৃত হই লেখকের অনবদ্য উপস্থাপনায়। তিনি আম নিয়ে সম্রাট আকবর ও বীরবলের কৌতুকদীপ্ত ঘটনা দিয়ে বইটি শুরু করেছেন। সেখান থেকে বোঝা যায় যে তিনি কেবল লেখক ও গবেষক নন, অসামান্য জীবনরসিক মানুষও।

সতেরোটি অধ্যায়ে লেখা বইটির প্রথম অধ্যায় 'সাধারণ কথা' এবং সপ্তদশ অধ্যায় 'আমের শ্রেষ্ঠত্ব বিচার'। মাঝের অধ্যায়গুলো হলো—'আমের নাম পরিচয়', 'আম শিল্পে, সাহিত্যে, কাব্যে ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে', 'আম চাষের ইতিবৃত্ত, জলবায়ু ও মাটি', 'আমের উদ্ভিদতত্ত্ব', 'আমের ভেষজ গুণাগুণ', 'আমের জাত', 'আম্রকুঞ্জ', 'আম সংগ্রহ এবং সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি', 'আম থেকে প্রস্তুত খাদ্যসামগ্রী', 'আমবাগান তৈরি ও এর ব্যবস্থাপনা', 'আমগাছের কলম তৈরি ও অঙ্গজ পদ্ধতিতে বংশবৃদ্ধি', 'উৎপাদন বিপণন ও রপ্তানি বাণিজ্য', 'আমের রোগ ও প্রতিকার', 'দেশের পূর্বাঞ্চলে আম চাষ'।

বইয়ের সূচি লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়, একটি ফল নিয়ে প্রধান প্রধান দিকের কোনোটিই বাদ পড়েনি। যেটুকু বাদ পড়েছিল, 'কোন আমটি কখন খাবেন' বইতে তাও পূরণ হয়েছে বলে বোধ করি।

প্রায় ছয় হাজার বছর ধরে আমের প্রচলন। ঐতিহাসিকরা একমত যে, ইন্দো-বার্মা অঞ্চলেই আমের উদ্ভব। ভারত পৃথিবীর সর্বোচ্চ আম উৎপাদনকারি দেশ। মিয়ানমারের ইরাবতী ও স্যালুইন নদীর অববাহিকা আম উৎপাদনে প্রসিদ্ধ। থাইল্যান্ডে মেনাম ও মেকং অববাহিকা, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামের মেকং অববাহিকায় বিপুল পরিমাণে আম উৎপাদিত হয়। অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড আম চাষের জন্য বিখ্যাত। শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিনস, মেক্সিকো, জামাইকা, চীন, মাদাগাস্কার, জাঞ্জিবার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা ও ক্যালিফোর্নিয়ায় এবং ইসরাইলে প্রচুর আম জন্মে। দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল, পেরু, ভেনিজুয়েলা, গিয়ানা ও কলাম্বিয়াতে আম উৎপাদন হয়।

মাহবুব সিদ্দিকী খুশবন্ত সিংয়ের 'দিল্লী' উপন্যাসে থাকা আমের প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে উল্লেখ করেন, 'পৃথিবীর বড় বড় শহরের মধ্যে দিল্লী, লাহোর, কলকাতা, ঢাকা, চেন্নাই, মুম্বাই, করাচি, লখনৌ, পাটনা, ম্যানিলা, ব্যাংকক, ইয়াংগুন, কিংস্টন,সাওপাওলো, মেক্সিকো সিটি, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, বরিশাল, মালদহ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, খুলনা এই শহরগুলোর নাগরিকগণের জীবন আম সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত। পৃথিবীতে এরাই সবচেয়ে বড় আম ভোক্তা।'

আম নিয়ে ভাবনা ও ভোগান্তিও কম হয় না। সেটি যেমন ব্যবসায়ীদের দিক থেকে, ততটাই ক্রেতাসাধারণের দিক থেকে। বিশেষ করে কার্বাইড বা বিষাক্ত রাসায়নিক দিয়ে আমের পচন ঠেকিয়ে সেই আম বাজারে বিক্রি করা হরদম চলছে। আম কিনে প্রতারিত হওয়া নিত্যদিনের ঘটনা। এই দিকটি লক্ষ্য রেখে মাহবুব সিদ্দিকীর 'কোন আমটি কখন খাবেন' একটি অতীব প্রয়োজনীয় বই।

নদী ও প্রকৃতি গবেষক মাহবুব সিদ্দিকীর বই

'আম গাছের উদ্ভিদ তত্ত্ব', 'আমের জাত' মূলত এই দুটো অধ্যায়ে ছোট আকারের এই বইটি লেখা। শুরুতে 'কথা প্রসঙ্গে' শিরোনামে তিনি আম, আমের ব্যবসা, ব্যবসায় অসাধু ও ক্রেতার সতর্কতার জন্য কিছু কথা বলেছেন। আম গাছের উদ্ভিদ তত্ত্ব মূলত তথ্যবহুলভাবে লেখা। আমের জাত অধ্যায়ের শুরুতে 'আম' বইটির বিস্তারিতভাবে বলা কথাগুলোর সারসংক্ষেপই করা হয়েছে।

ফজলি, ল্যাংড়া, আশ্বিনা, ক্ষীরশাপাত, গোপালভোগ, রানিপছন্দ, হিমসাগর, আম্রপালি/বারি,  আম-৩, লক্ষণভোগ/লখনা/ বারি আম-২, বারি  আম-৪, বোগলাগুটি, বোম্বাই, গোবিন্দভোগ, হাঁড়িভাঙ্গা, সূর্যপুরী, নাকফজলী, তোতাপুরী, মল্লিকা, চৌষা, গৌরমতি আমগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এগুলোর নাম, বৈশিষ্ট্য, পুষ্টিগুণ, স্বাদ নিয়ে বিচিত্র সব কথা উঠে এসেছে।

বইয়ের একদম শেষে আমের নাম, কেনার সঠিক সময়, কোন জেলায় জন্মে—এই তিনটি দিক উল্লেখ করে তিনি একটি গ্রাফ দিয়েছেন। সেখানে ১৫ মে থেকে ৩০ মে গোবিন্দভোগ আম কেনা দিয়ে শুরু হয়ে শেষ হয়েছে ৫ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট ফজলি আম কেনার মধ্যে দিয়ে।

হাজার জাতের আম হয়—মাঠে, জঙ্গলে, বাড়ির বাগানে কত আমের গাছ। এর ভেতরে চাষ করে লাভজনক হওয়া আমের সংখ্যাও কম নয়। আমের চাষ ও ব্যবসা করতে চাইলে মাহবুব সিদ্দিকীর আম নিয়ে বই দুটো নিঃসন্দেহে উপকারে আসবে।

তবে ছিদ্রান্বেষীদের কথা বলাবাহুল্য; বা 'ভালো হতো আরও ভালো হলে' বলার লোকেরও অভাব নেই। অতিকথন ও অনর্থক বিস্তারিতকরণের দোষ ধরতে পারেন।

বই হিসেবে 'আম' সাধারণ পাঠকের জন্য ফল-বিষয়ক আলোচনা, গবেষণা ও গ্রন্থরচনার নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশের অন্যান্য ফল, বিশেষ করে জাতীয় ফল কাঁঠাল, কলা, আনারস, পেয়ারা, আমড়া, জাম, লিচু, কমলালেবু, সফেদা, তাল, ডাব, নারকেল ইত্যাদি কত কত ফল নিয়েই না এমন দারুণ গ্রন্থ লেখা হতে পারে।

'আম' বইটি তথ্যে-তত্ত্বে বিপুল হলেও একদিক সুবিন্যস্ত অন্যদিক সবখানে সুপাঠ্য; সবচেয়ে বড় কথা রসসিক্ত ও রসোদ্দীপ্ত—বিশেষ করে কৃষি নিয়ে যারা পড়ালেখা করেন, গবেষণা করেন তাদের জন্য।

Comments

The Daily Star  | English

Dengue cases see sharp rise in early July

Over 1,160 hospitalised in first 3 days, total cases cross 11,000

11h ago