জুনে ডেঙ্গু রোগী বেড়েছে তিনগুণ, জুলাইয়ে আরও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা

সারা দেশে মশা নিধন কার্যক্রমের দুর্বলতার কারণে ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক মোড় নিয়েছে। চলতি বছরের মে মাসের তুলনায় জুন মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এই বছর সারা দেশে ৯,০৬৫ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে জুন মাসেই (তিন দিন বাকি থাকতেই) ভর্তি হয়েছেন ৪,৭২০ জন, যা মে মাসে ছিল মাত্র ১,৭৭৩ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বছরের শুরুর দিকে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম ছিল। জানুয়ারিতে ১,১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪, মার্চে ৩৩৬ এবং এপ্রিলে ৭০১ জন হাসপাতালে ভর্তি হন। তবে মে মাস থেকে পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করে এবং জুনে এসে তা ভয়াবহ রূপ নেয়। আশঙ্কার বিষয় হলো, ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে, বিশেষ করে বরগুনায়, ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেক বেশি।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, এডিস মশার বিস্তার এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে। বিশেষ করে রাজধানীর বাইরের এলাকাগুলোতে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, 'মে মাসের তুলনায় জুনে আক্রান্তের সংখ্যা তিনগুণ হয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে জুলাইয়ে এ সংখ্যা চার থেকে পাঁচগুণ এবং আগস্টে দশগুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে।'
তিনি আরও বলেন, 'যখন এডিস মশা এবং ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী—দুটোই একসঙ্গে বাড়তে থাকে, তখন রোগটির বিস্তার দ্রুতগতিতে হয়। আমরা বারবার সতর্ক করার পরও কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়নি।'
অধ্যাপক কবিরুল বাশার মশা নিয়ন্ত্রণে প্রচলিত ফগিং বা ধোঁয়া দেওয়ার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, 'কর্তৃপক্ষের উচিত মশার লার্ভা ধ্বংস করা এবং উৎপত্তিস্থল নির্মূলের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া। শুধু যেখানে ডেঙ্গু রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে, সেই নির্দিষ্ট স্থানগুলোতেই ফগিং করা উচিত। ঢালাওভাবে ফগিং করে কোনো লাভ হচ্ছে না, অথচ এটিই এখন মশা নিধনের প্রধান পদ্ধতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।'
অধ্যাপক বাশার মশার বংশবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে 'ইনসেক্ট গ্রোথ রেগুলেটর' (আইজিআর) ব্যবহারের পরামর্শ দেন। এই কীটনাশক প্রায় তিন মাস পর্যন্ত কার্যকর থাকে। তিনি বলেন, 'লার্ভা ধ্বংসকারী ওষুধের পাশাপাশি আইজিআর ব্যবহার করতে হবে। আর যেখানে রাসায়নিক ব্যবহারের প্রয়োজন নেই, সেখানে জমে থাকা পানি পরিষ্কার এবং পাত্র উল্টে রাখার মতো কাজগুলো করতে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে।'
ঢাকার বাইরের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, 'দেশের ৬৪টি জেলাতেই আগের বছরগুলোর তুলনায় পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ এডিস মশা এখন সব জেলাতেই আছে।'
তিনি আরও বলেন, 'স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে দেশের সব জেলা প্রশাসক, পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশনকে মশার লার্ভা ও প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করার জন্য জরুরি নির্দেশনা দেওয়া। মন্ত্রণালয় আইজিআর সরবরাহ করতে পারে অথবা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথাযথ নির্দেশনাসহ এটি সংগ্রহের অনুমতি দিতে পারে।'
আরেক কীটতত্ত্ববিদ জি এম সাইফুর রহমান বলেন, 'এডিস মশার সংখ্যা বাড়ার কারণেই ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। একটি মশা একবার ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তার ডিম থেকেও রোগবাহী মশার জন্ম হয়, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।'
অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, বর্তমান আবহাওয়া মশা প্রজননের জন্য অনুকূল। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ এই সময়ে বৃষ্টির পানি ধরে রাখে, যা এডিস মশার প্রজননের জন্য আদর্শ স্থানে পরিণত হয়েছে।
তিনি মশা বাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে একটি স্বতন্ত্র 'ভেক্টর কন্ট্রোল' বিভাগ গঠনের ওপর জোর দিয়ে বলেন, 'বৈজ্ঞানিক ও কাঠামোগত পদ্ধতি ছাড়া বর্তমান প্রচেষ্টায় তেমন কোনো সাফল্য আসবে না। এই বিভাগের কাজ হবে নির্দিষ্ট এলাকা চিহ্নিত করা, নজরদারি চালানো এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া।'
Comments