প্রধানমন্ত্রীর ১০ বছর মেয়াদে রাজি বিএনপি, এনসিসি নিয়ে আপত্তি

নিজ অবস্থানে বড় পরিবর্তন এনে প্রধানমন্ত্রী পদে সর্বোচ্চ ১০ বছর মেয়াদ রাখার প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে বিএনপি।
দলের নেতারা জানিয়েছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির ভাবমূর্তি উন্নত করতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আগের অবস্থানে অটল থাকার কারণে সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছিল দলটিকে।
তবে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন— যা নির্বাচন কমিশন এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো সংস্থাগুলোতে নিয়োগ তদারকি করবে তাতে আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি।
এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য নির্বাহী ক্ষমতার একচ্ছত্রতা কমিয়ে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ভারসাম্য ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। কিন্তু বিএনপি নেতারা আশঙ্কা করছেন, এই কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা খর্ব হতে পারে।
মঙ্গলবার রাতে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এই বিষয়ে আলোচনা হয়। লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যোগ দেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের সাথে দলের চলমান সংস্কার আলোচনার উপর একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। সভায় উপস্থিত সব সদস্য এই পরিবর্তনকে সমর্থন করেন বলে সভা সূত্র জানিয়েছে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'সাংবিধানিকভাবে এবং সংসদীয় পদ্ধতিতে ফ্যাসিবাদী তৈরির পথ বন্ধ করা আমাদের জাতীয় কর্তব্য। সেই দায়িত্ব থেকেই আমরা জাতির এই প্রত্যাশাকে গ্রহণ করি। সেই কারণেই আমরা এই প্রস্তাব গ্রহণ করেছি যে কেউ ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না।'
নিজের প্রস্তাব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, একটি পূর্ণ মেয়াদ আসলে কী তা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে—কারণ কেউ কেউ আংশিক মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন, যা এক বছরও হয় পূর্ণ না হতে পারে।
'এজন্যই আমি প্রস্তাব দিয়েছিলাম যে একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ কত বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন তার উপর আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। তবেই এটি একটি সঠিক সীমা হয়ে উঠবে,' বলেন তিনি।
দলের অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো জানিয়েছে যে, বিএনপি বিশ্বাস করে যে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিত করার বিষয়ে তাদের আপত্তি ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং তাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের আরও সমালোচনার সুযোগ করে দিচ্ছে।
সূত্র জানায়, দলটি আশঙ্কা করছে যে তাদের আগের অবস্থান ধরে রাখলে ব্যালট বাক্সে জনসমর্থনে প্রভাব পড়তে পারে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলের একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জনগণ কী ভাবছে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রস্তাবের সাথে দ্বিমত পোষণ করে আমরা ভোটারদের মনে সন্দেহ তৈরি করছিলাম। এমনকি জামায়াতও এটি আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে।'
তবে বিএনপি এখনো সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব নিয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। নেতারা বলেছেন, যদি এই প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হুমকির মুখে পড়ে, তবে দলটি তাদের আগের ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবে ফিরে যাবে, যেখানে প্রধানমন্ত্রীর টানা দুই মেয়াদ নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে।
বৈঠকে এক জ্যেষ্ঠ নেতা প্রস্তাবিত কাউন্সিলকে 'বিপজ্জনক' বলে মন্তব্য করেছেন বলে জানা গেছে। এর পরিবর্তে দলটি বিদ্যমান নিয়োগ আইন সংস্কার বা নতুন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে চায়, যাতে নির্বাহী ক্ষমতা হ্রাস না পায়।
তিন মাস আগে বিএনপি কেউ দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না—টানা হোক বা বিচ্ছিন্ন এমন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল।
সেই সময় বিএনপি বলেছিল যে একজন প্রধানমন্ত্রী দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করার পর বিরতির পরে আবারও ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারেন।
তবে এখন বিএনপি বলছে, তারা ১০ বছর মেয়াদ নির্ধারণে রাজি যদিও এটি তাদের ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই ঘোষিত 'বাংলাদেশে গঠনগত সংস্কারের জন্য ৩১ দফা রূপরেখা'র সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
তবে বিএনপি নেতারা বলেছেন যে তারা মনে করেন, কেউ কতক্ষণ প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন তা সীমাবদ্ধ করার প্রস্তাব "রাজনীতিবিদদের হাত বেঁধে তাদের কাজ করা থেকে বিরত রাখার" মতো।
মঙ্গলবারের বৈঠকে, দলটি দুইজন জ্যেষ্ঠতম বিচারকের মধ্য থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, নারীদের জন্য ১০০টি সংসদীয় আসন সংরক্ষণ এবং ১০০ সদস্যের একটি উচ্চকক্ষ তৈরির প্রস্তাবেও সম্মত হয়েছে।
বিএনপি বলেছে যে সংবিধানে যেকোনো বড় পরিবর্তন নির্বাচিত সংসদে বিতর্কের মাধ্যমে করা উচিত।
দলীয় নেতারা বলেছেন যে তারা সংস্কার আলোচনা দ্রুত শেষ করার লক্ষ্যে কাজ করছেন যাতে ঐক্যমত্য কমিশন জুলাইয়ের মধ্যে তাদের চূড়ান্ত 'চার্টার অব রিফর্ম' প্রকাশ করতে পারে, যা আগাম নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করবে।
Comments