নজরুল যেভাবে আমাদের হলেন

বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিকাশে কাজী নজরুল ইসলাম এক অবিস্মরণীয় নাম। তার লেখায় প্রকাশিত হয়েছে বাঙালি সংস্কৃতির বহুমাত্রিকতা। বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন-পূরণের সারথি ছিলেন তিনি। বাংলা সাহিত্যের নবদূত হিসেবে তার বিচরণ চিরসবুজ। জন্মভূমির মুক্তি, জনকল্যাণের শপথ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে কাজী নজরুল ইসলাম সর্বদা আধুনিক। নজরুলকে চর্চার মধ্য দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির দিগন্ত উন্মোচন করা সম্ভব।
দৃপ্ত শপথের অবিচল সত্যের কাণ্ডারি নজরুল। বহুগুণে তাকে অভিহিত করা যাবে। কিন্তু বড় পরিচয় তিনি আমাদের কবি—বাংলার নব জাগরণের আলোকবর্তিকা। আসানসোলের দুখু মিয়া বাল্যকালে জানতেন না তিনি বাঙালির মণিকোঠায় চিরভাস্বর হয়ে রইবেন। বাঙালির এমন কোনো প্রান্তর নেই যেখানে নজরুলকে পাওয়া যাবে না। প্রাত্যহিক জীবন থেকে শুরু করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বলয়ের সারথি কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাকে নিয়ে দুই বাংলায় যৎসামান্য কাজ হয়েছে। সমুদ্রের বালুকণার মতো এ কাজ দিয়ে নজরুলকে বিচার করা দুরূহ।
নজরুল লিখেছেন—'আমার কর্ণধার আমি/আমার পথ দেখাইবে আমার সত্য'। কবি সত্যকে ভালোবেসেছেন। রবীন্দ্রনাথ যেমনটা লিখেছেন—'সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম'। তার এ সত্য অভিধানের ব্যাখ্যা নয়। এ যেন সত্যকে ধারণ করার অগ্নিস্ফুরণ। বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশে লেখনি সত্য সোচ্চার হয়েছে মিথ্যার বিরুদ্ধে। গান, কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, ছড়া প্রভৃতি ক্ষেত্রে এ সত্য যেন বাঙালি জাতিকে আলোর পথ দেখানোর সলতে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে প্রেরণা দিতে তিনি কলমের মুখে সত্য প্রকাশ করেছেন। বিশ্বের বুকে এমন সাহসী কবি খুব কমই আছেন। জেল-জুলুম, জীবননাশের হুমকি—সবকিছুকেই তুচ্ছ করে তিনি লিখে গেছেন।
বিদ্রোহী কবিতার ভাষাপ্রয়োগ ও উচ্চশৈলীর ব্যবহার গবেষককে বিস্মিত করে। অনেকে মন্তব্য করেছেন—আর কোনো কবিতা না লিখলেও মাত্র এই কবিতা দিয়েই নজরুল সাহিত্যে বেঁচে থাকতেন। কী নেই এই কবিতায়। বিভিন্ন ধর্মের যেমন উল্লেখ আছে, তেমনি আছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ। মানুষকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার দীক্ষা দিয়েছেন তিনি। চণ্ডীদাসের মতো মানবিক সুরে তিনি উচ্চারণ করেছেন—'গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান'। 'মানুষ' কবিতায় নজরুলের এই অভিব্যক্তিই বুঝিয়ে দেয় মানুষকে তিনি কত ভালোবেসেছেন।
অন্তরের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে কবিতার চরণে। দেশ-কাল ভেদে সার্বিক মানুষের জয়গান তার কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে দারুণভাবে। তিনি হয়েছেন মানবতার কবি, বিদ্রোহের কবি ও সাধারণ মানুষের কবি। কবি নজরুল ইসলাম বাঙালির মননের কবি। বাঙালির ভালোবাসার উপাদান তার কবিতায় লক্ষণীয়। বাংলাদেশের মুসলমান সংস্কৃতির বড় উৎসব হলো দুটি ঈদ। একটি ঈদ নিয়ে তিনি লিখেছেন—'ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে/এলো খুশির ঈদ/তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে/শোন আসমানের তাগিদ'।
রমজানের রোজার শেষে গগনে চাঁদ দেখার পর এই গান যেন বাঙালি মুসলমানের চিরসাথি। মনের মধ্যে ঈদ-আনন্দ ধ্বনিত হয়। সবার মুখে আজানের ধ্বনির মতো উৎসারিত হতে থাকে সুরেলা আওয়াজ। মনের বাতায়ন খুলে যায়। ঈদ কেবল আমার নয়। ধনী-গরিব ঐক্যের মেলবন্ধনেই প্রকৃত ঈদানন্দ। এই প্রত্যয়ে মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। আমি থেকে আমরা এবং আমার থেকে আমাদের রূপান্তর হয় মনের অজান্তেই। একটি সাম্যবাদী চেতনা ধ্বনিত হতে থাকে মনের গহীনে। সামর্থ্যবানেরা এ দীক্ষায় অনাহারী মানুষকে আহার ও বস্ত্রহীন মানুষের মাঝে ঈদের পোশাক বিতরণ করেন। একে ওপরের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নেন। নজরুল এ অমর বাণী মুসলমানের মনে নাড়া দেয়। পৃথিবীতে মানবের আগমনের অনুসন্ধানে ব্যাপৃত থাকেন তারা। মানুষ মানুষের জন্য এমন মানস গঠনে এ কবিবাণী গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। কাল নিরবধি কবি কাজী নজরুল ইসলামের এ বাণী শাশ্বত রূপে দেখা দিচ্ছে বাঙালি মুসলমানের মননে। এটি কবিতা নয়, বাঙালি মুসলমানের চিরজনমের সঙ্গী।
নজরুল অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে কবিতায় স্থান দিয়েছেন। সাম্প্রদায়িক শক্তির মূলোৎপাটনে তার লেখনী হয়ে উঠেছিল হাতিয়ার হিসেবে। হিন্দু মুসলমানের সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার। সাম্প্রদায়িক চেতনাবিনাশী লেখা আজও সমভূমিকা পালন করে। 'বিদ্রোহী' ও 'মানুষ' কবিতায় সে বিষয়ের অবতারণা রয়েছে। কাজী নজরুল ইসলামের জাগরণী লেখার প্রাক্কালে হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক মনোভাব নেতিবাচক পর্যায়ে পৌঁছেছিল। ওই সময়ে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া ছিল দুঃসাহসের। কাজী নজরুল ইসলাম সেই সাহসী ভূমিকা পালন করেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভাস্বর কবি মননে আবিষ্ট হয়েছিল সাম্প্রদায়িক বিনাশী খড়গ। তাই তিনি মানুষের মনের গহীনে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন।
মহাবিদ্রোহী রণক্লান্তের পথিক কাজী নজরুল ইসলাম। সময় ও স্থানকে অতিক্রম করে তিনি হয়েছিলেন বাঙালি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। অত্যাচারীর রণভূমে তিনি আঘাত হেনেছেন। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করেছেন আজীবন। বাঙালি জাতিসত্তার পরিস্ফুটনে তিনি হয়ে উঠেছিলেন জাগ্রত সত্তার প্রতীক।
নতুন প্রজন্ম আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। নতুনের আবাহনে জাগ্রত হয় সমাজ ও সংস্কৃতি। ঘুণে ধরা সমাজে আশানিয়া হয়ে দেখা দেয় তাদের কর্ম। কাজেই তাদের মননে সত্যের বারতা প্রবেশ করানো জরুরি। কাজী নজরুল ইসলাম যুব সমাজের মধ্যে এই বীজ সঞ্চারিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। 'ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কালবৈশাখির ঝড়/তোরা সব জয়ধ্বনি কর'। নতুনের শক্তি ও উদ্যমতাকে তিনি সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে দেখেছেন। সমাজ রূপান্তরের এই হাতিয়ারকে জাগ্রত করার প্রয়াসে তার লেখার ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি দেখিয়েছেন তারুণ্যের শক্তিকে প্রতীকী হিসেবে।
কাজী নজরুল ইসলামের লেখনী সমাজ পরিবর্তনের শক্তি হিসেবে কাজ করে অবিরত। সাতচল্লিশের দেশভাগ, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ—প্রতিটি ক্ষেত্রে তার লেখার সুস্পষ্ট প্রভাব বিদ্যমান। বিনাশী শক্তির বেদীতে আঘাত হননে তার লেখার ধার অনেক। বর্তমান সমাজ বাস্তবতায়ও এই সত্য বর্তমান। গণঅভ্যুত্থানে বৈষম্যহীন সমাজ গঠনেও এ ধারা অব্যাহত ছিল। দেয়ালে দেয়ালে বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের বাণী শোভাবর্ধন করেছিল নজরুলের লেখা। তরুণদের মধ্যে আশা জাগানোর প্রত্যয়ে এমন লেখা চিন্তার খোরাক রূপে কাজ করে চলেছে।
মহাবিদ্রোহী রণক্লান্তের পথিক কাজী নজরুল ইসলাম। সময় ও স্থানকে অতিক্রম করে তিনি হয়েছিলেন বাঙালি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। অত্যাচারীর রণভূমে তিনি আঘাত হেনেছেন। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করেছেন আজীবন। বাঙালি জাতিসত্তার পরিস্ফুটনে তিনি হয়ে উঠেছিলেন জাগ্রত সত্তার প্রতীক। এ যেন বাঙালি জাতির আত্মার আত্মা। গত শতবছরে বাঙালির এমন দরদি লেখক জন্মায়নি। বাঙালির সংস্কৃতি যখন ইংরেজ শাসনের অপশাসনে চরম বৈষম্যের শিকার, তখনই বাংলার আকাশে তার আবির্ভাব তিমির হননের বার্তা বয়ে আনে। তার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়—'মহা-বিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত/ যবে উৎপীড়নের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না-বিদ্রোহী রণক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত'। তিমির হননের প্রত্যয়ী কবির লেখায় বিন্যস্ত শব্দাবলী বাঙালির মুক্তির প্রতীক হয়ে দেখা দেয় সর্বদা।
অসত্যের বিরুদ্ধে ধূমকেতুর প্রবেশ সব অন্যায়কে চুরমার করে ফেলে। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে কাজী নজরুল ইসলাম ধূমকেতু প্রকাশ করেন। ১৯২০ এর দশকে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন একসময় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এরপর বাংলার আকাশে 'ধূমকেতু'র আগমন সশস্ত্র বিপ্লব গঠনে বিপ্লবকে ঐক্যবদ্ধ করতে সহযোগিতা করে। এই পত্রিকার আবির্ভাব যেন বাংলার আকাশকে সত্যের বাতির বারতা দান করে। এ এক অন্ধকারে আলোর বাতি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবির ধূমকেতুকে আশীর্বাদ করে লিখলেন' কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু/আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন'। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই প্রত্যাশার প্রতিফলন দেখা গিয়েছিল পরবর্তী সব আন্দোলনে।
নজরুল বাঙালির সংস্কৃতি বিকাশের অগ্রপথিক। তার লেখায় চিরভাস্বর হয়েছে বাঙালির স্বপ্নপূরণ। রুটির দোকানের বালক, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক পর্বে বাংলার প্রতি তার ভালোবাসা উপলব্ধি করা যায়। নজরুল চর্চা গতিশীল হলেও কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উপনীত হয়নি। নজরুল চর্চা মানে বাঙালি সংস্কৃতিকে চর্চা করা, বাংলাদেশের মানুষের অকৃত্রিম বন্ধুকে স্মরণ করা। বাংলার বিস্তীর্ণ পল্লব ভূমিতে নজরুলের স্মৃতিচারণ বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার নামান্তর। বাংলার ভালোবাসার মানুষকে অন্নদাশঙ্কর রায় যথার্থই স্মরণ করেছেন—ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/আর সবকিছুই ভাগ হয়ে গেছে/ভাগ হয়নি কো নজরুল/এই ভুলটুকু বেঁচে থাক/বাঙালির বলে একজন আছে/দুর্গতি তার ঘুচে যাক'।
Comments